অন্যান্য খবর ব্যবসা ও বাণিজ্য

ভারতে বাংলাদেশি পণ্যে অশুল্ক বাধা, স্থলপথে রপ্তানি বন্ধে শঙ্কায় বড় বাজার হারানোর আশঙ্কা!

অনিন্দ্যবাংলা ডেস্ক:

প্রকাশ : ১৯-৫-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০৪৫

ভারত হঠাৎ করেই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর একের পর এক অশুল্ক বাধা আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের বাজারে রপ্তানি সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, আসবাবপত্র, সুতা ও তার উপজাত এবং ফল-মূলের পানীয়সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের রপ্তানি কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।

গত শনিবার ভারত সরকার বাংলাদেশের বেশ কিছু পণ্য স্থলপথে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে করে বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত রাজ্যগুলোতে রপ্তানির সহজ ও সাশ্রয়ী পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে গত ৯ এপ্রিল কলকাতা বিমানবন্দর হয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে পণ্য পাঠানোর সুবিধাও বন্ধ করে দেয় ভারত।

বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বিকল্প পথে—সমুদ্রপথে—রপ্তানি করতে হলে সময় ও খরচ উভয়ই অনেক বেড়ে যাবে। এতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা কমে যাবে, এবং বাজার হারানোর ঝুঁকি বাড়বে।

স্থলপথে ৩১ শতাংশ রপ্তানি
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে প্রায় ১৫৯ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের পণ্য গেছে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা স্থলপথ ব্যবহার করে, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৩১ শতাংশ।

স্থলপথের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক। গত অর্থবছরে প্রায় ৫৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ভারতে, যার মধ্যে ৭৬ শতাংশই গেছে স্থলপথে। এই পথ দিয়েই দেশের প্রায় ৫৩০টি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পণ্য পাঠিয়েছে। মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, লেভি স্ট্রসের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্যও পোশাক সরবরাহ হয় বাংলাদেশ থেকে।

প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক ও আসবাব রপ্তানিতেও বড় অংশ গেছে নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত স্থলবন্দর ব্যবহার করে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ও হাতিলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এই অঞ্চলকে রপ্তানির অন্যতম বড় বাজার হিসেবে গড়ে তুলেছে। কিন্তু এখন সেই বাজার ধরে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তারা।

‘বাজার হারাতে বসেছি’ — বলছেন রপ্তানিকারকেরা
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রাণের বড় বাজার তৈরি হয়েছিল। এখন এই বাজার ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। ব্যবসায়িক স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার।”

হাতিলের চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান বলেন, ভারতের নিষেধাজ্ঞা এবং আসবাব রপ্তানিতে নতুন নতুন শর্ত যোগ হওয়ায় আমাদের জন্য বাজার ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, আবার বিআইএস সনদের বাধ্যবাধকতা আগামী আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।”

বিকল্প পথে সময় ও খরচ বেশি
স্থলপথের পরিবর্তে সমুদ্রপথে রপ্তানির বিকল্প থাকলেও তা খুবই ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। চট্টগ্রাম থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় বন্দর নভো সেবা পর্যন্ত পণ্য নিতে হয় কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে ঘুরপথে, যা সময় নেয় ২১ দিন পর্যন্ত। কলম্বো বন্দরের জট এবং শিডিউল সমস্যা সময় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

নভো সেবা বাদে ভারতের পূর্বাঞ্চলে কলকাতা বন্দরে রপ্তানির সুযোগ থাকলেও সেখানে কেবল ছোট আকারের দুটি কনটেইনার জাহাজ চলাচল করে, যার একটি অনিয়মিত। এতে পণ্য পরিবহনে নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রপ্তানিকারকেরা।

‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যে রপ্তানি প্রায় বন্ধ
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যে সমুদ্রবন্দর না থাকায় স্থলপথই ছিল সহজতম মাধ্যম। এখন নিষেধাজ্ঞার কারণে এই বাজার প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে।”

‘দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’
নীতি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতীয় আমদানিকারক ও ভোক্তার জন্যও ক্ষতিকর। ব্যবসা ও বাণিজ্য যেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।”

তিনি আরও বলেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন সাফটা ও বিসিমস্টেক কার্যকরভাবে কাজ করছে না। এসব প্ল্যাটফর্ম সক্রিয় হলে এমন বাণিজ্যিক জটিলতা সহজেই সমাধান করা যেত।”