টেকনাফ উপকূলে বঙ্গোপসাগরের গভীর পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন জেলেরা। মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন ‘আরাকান আর্মি’র হামলা, ট্রলার জব্দ ও মালামাল লুটের ঘটনায় আতঙ্কে পড়েছেন তাঁরা। গত ১৩ জুন গভীর সাগর থেকে মাছ ধরে ফেরার সময় টেকনাফের তিনটি মাছ ধরার ট্রলার অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ১৪ জুন থেকে অধিকাংশ জেলে গভীর সাগরে যাওয়া বন্ধ রেখেছেন। ফলে সাগরে মাছ ধরায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় জেলে, ট্রলার মালিক ও জনপ্রতিনিধিদের তথ্যমতে, বর্তমানে টেকনাফে প্রায় চার শতাধিক বড় মাছ ধরার ট্রলার নোঙর করে অলস পড়ে রয়েছে। বহু জেলে কাজ না থাকায় অর্থসংকটে ভুগছেন। এমনকি, গভীর সাগরে মাছ ধরার উপযুক্ত পরিবেশ থাকলেও আরাকান আর্মির তৎপরতায় সেই সুযোগও হাতছাড়া হচ্ছে। অথচ এটি ইলিশ মৌসুম— বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়।
ট্রলার মালিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৩ জুন রাতে মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়ার সীমান্তবর্তী সাগর এলাকায় টেকনাফের তিনটি মাছ ধরার ট্রলারকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে আরাকান আর্মির সদস্যরা। প্রতিটি ট্রলারে ৬ থেকে ৮ জন করে জেলে ছিলেন। অপহরণের পর তাদের মাছ, জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রী লুট করে কিছু জেলেকে মারধর করা হয়। পরে নৌযানসহ তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। একই সময় আরও কয়েকটি ট্রলারকে ধাওয়া করা হয়। এরপর থেকেই গভীর সাগরে মাছ ধরার কাজ বন্ধ রয়েছে।
তবে উপকূলীয় এলাকাগুলোয়, বিশেষ করে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশের অগভীর সাগর এলাকায় ছোট নৌকায় মাছ ধরা এখনো সীমিত আকারে চলছে। প্রায় পাঁচ হাজার ছোট নৌকা মাছ ধরছে বলে জানা গেছে। তবে বড় আকারের ট্রলার এখনো সাগরে নামতে সাহস পাচ্ছে না।
মাছ ধরায় স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় স্থানীয় বাজারে মাছের সরবরাহ কমে গেছে। টেকনাফের কায়ুকখালিয়া ঘাট ও শাহপরীর দ্বীপের বাজারপাড়াসহ বিভিন্ন ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, নৌঘাটগুলোতে সারি বেঁধে নোঙর করা আছে শত শত মাছ ধরার ট্রলার। অনেক জেলে জাল মেরামতের কাজ করছেন, কেউ কেউ নৌযান পাহারা দিচ্ছেন। জেলেরা বলছেন, মাছ ধরতে না পারায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকেই ধারদেনায় দিন পার করছেন।
মাছের ব্যবসায়ী ও পরিবহনকারীরা জানান, মাছ ধরা বন্ধ থাকায় বর্তমানে ঘাট থেকে কোনো ট্রাকেই মাছ যাচ্ছে না। আগে প্রতিদিন ১৫-২৫টি ট্রাক ঢাকা ও চট্টগ্রামে মাছ পাঠানো হতো। এখন সেই কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ না করলে উপকূলীয় এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে। টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্যরা জানান, এই সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য কূটনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক উদ্যোগ জরুরি।
বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান জানান, অতীতে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে। তাঁদের প্রচেষ্টায় কয়েক দফায় মিয়ানমার থেকে ১৮৯ জন জেলে ও ২৭টি ট্রলার ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর বিষয়ে এখনো কেউ বিজিবিকে অবহিত করেনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের দিক থেকে কোনো অনুপ্রবেশ বা হুমকি ঠেকাতে কোস্টগার্ড সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। জেলেদেরও সতর্কভাবে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ আন্তর্জাতিক জলসীমা লঙ্ঘন না করেন।
উপকূলের জেলেরা বলছেন, শুধু নিষেধাজ্ঞার সময় নয়, বর্তমানে যখন মাছ ধরার সুযোগ রয়েছে, তখনও নিরাপত্তার অভাবে তাঁরা সাগরে যেতে পারছেন না। ফলে তাঁদের জীবন-জীবিকা এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে। দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে সামনের দিনে এই সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।