Logo

আধুনিক সভ্যতায় প্রবীণ বয়সীরা : সংকট উত্তরণে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস

অনিন্দ্য বাংলা
শনিবার, অক্টোবর ৩, ২০২০
  • শেয়ার করুন

ড. দেওয়ান রাশীদুল হাসান: আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস ও পৃথিবীর সময়কে মোটাদাগে তিনভাগে ভাগ করা হয়। প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সভ্যতার পতনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন যুগের সমাপ্তি ঘটে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে কারো জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষতা ছিল, কারো ছিল দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। তবে যার যা-ই থাক না কেন, সব সভ্যতারই বৃহৎ বা ক্ষুদ্র অবদানে আশীর্বাদপুষ্ট আজকের এই আধুনিক সভ্যতা। আজ সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন প্রবীণ বয়সীরা। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এমন তথ্য মানুষের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এনেছে।বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি তেমনই পরিসংখ্যান ফুটিয়ে তুলেছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে ষাটোর্ধ মানুষ বেশি। তাই প্রবীণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নাজুক হওয়ার কারণে সতর্ক হয়ে চলার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।বার্ধক্যের নানা সমস্যা সমাধানে নিজেকেই সচেতন থাকতে হবে। নিজেকে বৃদ্ধ না ভেবে সুস্থ সবল ভাবাই শ্রেয়। সব সময় নিজেকে কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে।

এখানে সবিশেষ উল্লেখ্য, করোনায় প্রবীণদের মৃত্যু নিয়ন্ত্রণহীন। দেশে করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) প্রবীণদের মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। গত ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩২ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এ ভাইরাস। ফলে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ হাজার ২৫১ জনে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, করোনায় মোট মৃতদের মধ্যে ৫১ শতাংশই প্রবীণ অর্থাৎ ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ। তবে রোগতত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবীণরা শুধু করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হওয়ার কারণে মারা যাচ্ছেন এমন নয়। তারা আগে থেকেই বার্ধক্যজনিতসহ নানা অসংক্রামক রোগে (ক্যানসার, কিডনি সমস্যা, লিভার, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) আক্রান্ত থাকায় তাদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে। অন্য দিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে যে পারিবারিক বন্ধন, আর্থসামাজিক বন্ধন, বাস্তবতা এবং প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণেই বাংলাদেশে প্রবীণরা ভালো আছে। কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরঞ্চ সকলকে নিয়ে বিশ্বসমাজের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির অভিযাত্রা চলমান রাখতে হবে৷

স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া এ পর্যন্ত করোনায় মৃত পাঁচ হাজার ২৫১ জনের মধ্যে বয়সওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী ২৪ জন (শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ), ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী ৪২ জন (শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ), ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১১৯ জন (দুই দশমিক ২৭ শতাংশ), ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ২৯৯ জন(পাঁচ দশমিক ৬৯ শতাংশ), ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৬৭৮ জন (১২ দশমিক ৯১ শতাংশ), ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী এক হাজার ৪১২ জন (২৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ) এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সী দুই হাজার ৬৭৭ জনের (৫০ দশমিক ৯৮ শতাংশ) মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী ৩২ জনের মধ্যে ত্রিশোর্ধ্ব দুইজন, চল্লিশোর্ধ্ব তিনজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব তিনজন এবং ষাটোর্ধ্ব ছিলেন ২৪ জন। করোনাভাইরাস শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৮টি পরীক্ষাগারে ১৩ হাজার ১৫৫টি নমুনা সংগ্রহ হয় এবং ১৩ হাজার ৪০৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৪৭ হাজার ৪৫৫টি।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১ অক্টোবর দেশব্যাপী বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালিত হয়। ১৯৯১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪৫/১০৬ নং রেজুলেশন অনুযায়ী অক্টোবরের প্রথম দিনটি ‘বিশ্ব প্রবীণ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। প্রবীণ ব্যক্তিরা যাতে সম্মান, মর্যাদা ও তাদের অধিকার নিয়ে পরিবার-সমাজে বসবাস করতে পারেন, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং তাদের যাতে কেউ অবহেলা বা অসম্মানের চোখে না দেখেন সে বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এ দিবসটি পালিত হয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা, সরকার প্রধান, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, স্পিকারসহ নেতৃস্থানীয় অধিকাংশই প্রবীণ। কাজেই তারা প্রবীণদের সামাজিকভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে দ্রুত এগিয়ে আসবেন এবং প্রবীণদের কল্যাণে সাহায্যের হাত প্রসারিত করবেন-প্রবীণ দিবসে দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর এটাই প্রত্যাশা। এ বছর জাতিসংঘের ৭৫তম বার্ষিকী ও আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের ৩০তম বার্ষিকী চলছে। ২০২০ থেকে ২০৩০ সালকে ডিকেড অ্যান্ড হেলদি এজ হিসেবে পালন করা হবে বাংলাদেশেও। দশকটিতে প্রবীণ স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে তাদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি অগ্রাধিকার হিসেবে সুলভে বা বিনা ব্যয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিও নিশ্চিত করতে হবে।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় প্রবীণ নীতি বাস্তবায়ন হয়েছে অনেক আগেই। শ্রীলংকা এ ব্যাপারে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের উচিত ২০১৩ সালের প্রবীণ নীতিটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা, এটিকে সাত বছর ঝুলিয়ে রেখে, প্রবীণদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। ঢাকায় প্রবীণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রতিটি জেলা-উপজেলা হাসপাতালে সার্বক্ষণিক আলাদা ওয়ার্ড বা বেড নিশ্চিত করতে হবে। তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগ দিতে হবে। সক্ষম প্রবীণদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কোনো অংশে কম নয়, এতে দেশ উপকৃত হবে। প্রবীণদের অবসর বিনোদনের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি রাষ্ট্রের দায়িত্ব আর এসব কাজে প্রবীণদের সম্পৃক্ত করেই সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে।

রাষ্ট্র একটি দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি। তাই প্রবীণদের সমস্যা সমাধানে ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ যতটা কার্যকর, তারচেয়েও অধিক কার্যকর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। প্রবীণদের সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র যতটা সহজে নিশ্চিত করতে পারে, তা’ অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।একজন প্রবীণ যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী থাকেন, তবে তাঁর সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরকারিভাবে অবসর ভাতা, বয়স্ক ভাতা এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুস্থ নারীদের ভাতা প্রদান কার্যক্রম প্রবীণদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছে। কিন্তু যদি ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়, তবে তা আরো উপকারে আসবে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে প্রবীণ বয়সে সঠিক চিকিৎসা সেবা পাওয়াও সবার জন্য সহজ নয়।দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার চিত্র অনুসারে সুচিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক নিয়মে সবাই একসময় প্রবীণ হবে। তাই প্রবীণদের প্রতি সবার যত্নবান হওয়া উচিত। প্রকৃত চিএ তুলে ধরা ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রবীণদের নিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জাতীয় ঐক্য ও দেশপ্রেম যে কোন সংকট উত্তরণের ক্ষেত্রে মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে।


–ড. দেওয়ান রাশীদুল হাসান, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক