Logo

করোনা পরীক্ষার কিটের মজুত নিয়ে অস্পষ্টতা

অনিন্দ্য বাংলা
শুক্রবার, এপ্রিল ২৪, ২০২০
  • শেয়ার করুন

কোভিড-১৯বর্তমানে দেশের ২১টি কেন্দ্রে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষার কেন্দ্র ও সক্ষমতা বাড়লেও পরীক্ষার সেভাবে সংখ্যা বাড়েনি। আবার পরীক্ষা বাড়াতে গেলে শনাক্তকরণ কিটের মজুত বাড়াতে হবে। কিন্তু এখন দেশে কিটের মজুত কত আছে, সেটাও কর্তৃপক্ষ আর জানাচ্ছে না। ফলে এ নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।

তবে কিটের মজুত নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সর্বশেষ যে তথ্য জানিয়েছিল, সেটা থেকে এরপর ব্যবহৃত কিটের সংখ্যা বাদ দিলে মজুত দাঁড়ায় প্রায় ৫৬ হাজার। এখন দৈনিক তিন হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষার সংখ্যা না বাড়ালেও বর্তমান মজুতে ১৭–১৮ দিন চলবে। নতুন কিট কবে নাগাদ আসবে, সেটাও পরিষ্কার করে বলছে না কর্তৃপক্ষ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ৩১ মার্চ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার ৯২ হাজার পিসিআর কিট সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২১ হাজার কিট পরীক্ষার জন্য বিতরণ করা হয়েছে। মজুত রয়েছে ৭১ হাজার কিট। ১১ এপ্রিলের বিজ্ঞপ্তিতেও ওই ৭১ হাজার কিট মজুতের কথা বলা হয়। এরপর আর নিয়মিত সংবাদ বুলেটিন বা বিজ্ঞপ্তিতে কিটের মজুত জানায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এখন মজুত কত, বলতে চাইছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। হিসাবে বোঝা যাচ্ছে, পরীক্ষা না বাড়ালেও বর্তমান মজুতে ১৭–১৮ দিন চলবে।

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে মোট ৩৬ হাজার ৯০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। সে হিসাবে দেশে কিটের মজুত থাকার কথা ৫৫ হাজার ৯১০টি। যদিও এর মধ্যে কোনো কোনো নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে একাধিক কিটও ব্যবহার করতে হয়। সে ক্ষেত্রে মজুত আরও কিছুটা কমতে পারে।

কিটের মজুত কত আছে, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিটের মজুতের তথ্য দিয়ে আপনাদের কোনো কাজ আছে বলে আমি মনে করি না।’ তিনি বলেন, ‘কিটের বিষয়টি আমদানির ব্যাপার। কারিগরি ত্রুটির কারণে একটি নমুনা পরীক্ষায় একাধিক কিট লাগতে পারে। তাই ১০০ কিটের মজুত রয়েছে বললাম। কিন্তু তাতে ৭০টি নমুনা পরীক্ষা হলে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই কিটের কত মজুত আছে, সেটি বলতে চাচ্ছি না।’

জনসংখ্যার অনুপাতে পরীক্ষা কম

গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে মোট ৩৬ হাজার ৯০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ১৯৮ জনের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে যা বেশ কম।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তের দিক থেকে শীর্ষ দেশগুলোর প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সব দেশেই এক থেকে দেড় মাস পরে রোগীর সংখ্যায় বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে। দেশগুলো ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত করছে। বেশি শনাক্ত হয়েছে বিশ্বের এমন দেশগুলোতে পরীক্ষার হার প্রতি ১০ লাখে ১০ হাজার থেকে প্রায় ২৫ হাজার পর্যন্ত।

 দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে

পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে আসছে। গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডোমিটারসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে ১৯৮ জনের করোনার পরীক্ষা করা হচ্ছে।

ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা হচ্ছে ভুটানে। দেশটিতে প্রতি ১০ লাখে ১১ হাজার ৬০৩ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। মালদ্বীপে প্রতি ১০ লাখে ৮ হাজার ৬৮৮, পাকিস্তানে ৫৬৪, শ্রীলঙ্কায় ৩৪৫, নেপালে ৩০১ এবং ভারতে ৩৬৩ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে।

ইতালিতে প্রতি ১০ লাখে ২৫ হাজার ২৮, জার্মানিতে ২৪ হাজার ৭৩৮, স্পেনে ১৯ হাজার ৮৯৬, যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ হাজার ৭১ এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ১১ হাজার ৩৯০ জনের করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করা হচ্ছে।

সক্ষমতার অর্ধেক অব্যবহৃত

বাংলাদেশে বর্তমানে যে ২১টি ল্যাবরেটরিতে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে, এর মধ্যে ঢাকায় ১০টি এবং ঢাকার বাইরে ১১টি। গতকাল পর্যন্ত এসব ল্যাবরেটরিতে এক দিনে সর্বোচ্চ পরীক্ষা হয়েছে ৩ হাজার ৪১৬টি। অথচ এসব ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা কমবেশি ৬ হাজার। অর্থাৎ সক্ষমতার প্রায় অর্ধেকই অব্যবহৃত রয়েছে।

ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিনের দিনে ৫০০ নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। ৩১ মার্চ থেকে গত বুধবার পর্যন্ত ২৩ দিনে ৩ হাজার ১ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে। অথচ এখানে ২৩ দিনে সাড়ে ১১ হাজার পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল।

ঢাকায় ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস দৈনিক ৪৫০টি নমুনা পরীক্ষা করতে পারে। গত বুধবার পযন্ত ২৩ দিনে প্রতিষ্ঠানটি নমুনা পরীক্ষা করেছে ১ হাজার ৩০৫টি। অথচ এত দিনে প্রায় ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল এখানে।

ঢাকার বাইরের কয়েকটি পরীক্ষাকেন্দ্রেও সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। খুলনা মেডিকেল কলেজে গত বুধবার পর্যন্ত ১৬ দিনে মোট ১ হাজার ৫৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অথচ এখানে দিনে ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে।

এর বিপরীত চিত্র রয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের পরীক্ষাকেন্দ্রে। এখানে ১ এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হয়। শুরুতে ৯৪টি করে নমুনা পরীক্ষা করা হলেও এখন প্রতিদিন ১৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ চিত্তরঞ্জন দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দিকে নমুনা সংগ্রহের পরিমাণ কম থাকায় পরীক্ষাও কম হতো। নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষার হার বাড়ানো হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগী শনাক্ত করা এবং তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার বিষয়ে জোর দিয়ে আসছে। বাংলাদেশে শুরুতে পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল কেবল একটি। এখন সেটা বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পরীক্ষার কিট।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা দিন দিন বাড়ছে। কিটের মজুত কত, তা না জানালে জনগণ অন্ধকারে থাকছে। সঠিক সংখ্যাটা জানা থাকলে তারা আশ্বস্ত হবে। তিনি মনে করেন, পরীক্ষাকেন্দ্রের পাশাপাশি নমুনা সংগ্রহকারী ও টেকনিশিয়ানের সংখ্যা বাড়ানো এবং তাঁদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।