Logo

কোটি ভক্তদের কাঁদিয়ে ম্যারাডোনা চলে গেলেন না ফেরার দেশে !

অনিন্দ্য বাংলা
বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২৬, ২০২০
  • শেয়ার করুন

অনিন্দ্যবাংলা ডেস্ক : কোটি ভক্তদের কাঁদিয়ে ম্যারাডোনা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ২৫ নভেম্বর, বুধবার রাতে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, নভেম্বরের প্রথম দিকে মস্তিস্কে রক্তজমাট বাঁধার কারণে অস্ত্রোপচার হয় ম্যারাডোনার। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার দুই সপ্তাহ পর তার মৃত্যু হলো। সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার খ্যাত ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতান ১৯৮৬ সালে। খেলেছেন বোকা জুনিয়র্স, নাপোলি ও বার্সেলোনায় আর্জেন্টাইন নিউজ আউটলেট ক্লারিন বুধবার বাংলাদেশ সময় রাতে ম‌্যারাডোনার মৃত‌্যুর ব্রেকিং নিউজ দেয়। এ খবর প্রকাশের পর তা বিশ্বে আলোড়ন তোলে।

মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের ৮ দিন পর গত ১১ নভেম্বর হাসপাতাল ছাড়েন ম্যারাডোনা। বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বেসরকারি ওলিভোস ক্লিনিক থেকে তাকে বাড়িতে নেওয়া হয়। ওই সময় তাকে এক নজর দেখার জন্য অগণিত দর্শক ভিড় করেন এবং ছবি তোলেন। সেসময় তার অবস্থা জানতে ও ছবি তুলতে তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে ছুটতে থাকেন আর্জেন্টাইন টিভি সাংবাদিকরা।

ম‌্যারাডোনার আইনজীবী মাতিয়াস মোরলাহাস বলেন, ‘অ্যালকোহল আসক্তি কাটানোর জন্য তার চিকিৎসা চলছিল। বিশ্বকাপ জয়ী ম্যারাডোনা সম্প্রতি স্বদেশী ক্লাব জিমন্যাসিয়ার কোচ হন।’ গত কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন ম্যারাডোনা। পাকস্থলীতে রক্তক্ষরণের কারণে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। অসুস্থবোধ করায় ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার ম্যাচে শেষ পর্যন্ত খেলা দেখতে পারেননি তিনি।

মাঝেমধ্যে আমি চিন্তা করি, আমার পুরো জীবনই যেন এক সিনেমা৷ সিনেমার রিলে যেন আমার জীবনের সব ছবি ধারণ করে রাখা আছে৷ সবাই ছোটবেলায় বিখ্যাত কাউকে অনুসরণ করে৷ আমার ছোটবেলায় আর্জেন্টিনায় সত্যিকারের বিখ্যাত অনুকরণীয় ফুটবলার কেউ ছিল না৷ ফুটবল ছিল তখন আর্জেন্টিনার গরিব আর বস্তিতে থাকা ছেলেদের মুক্তির একটা বড় উপায়৷ দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে আমরা ফুটবলকে বেছে নিতাম৷ বুয়েনস এইরেসে আমরা খুব ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকতাম৷ ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে যেত৷ আমার বয়স যখন তিন, তখন আমার এক কাজিন আমাকে একটা চামড়ার বল উপহার দেয়৷ সেটাই ছিল আমার প্রথম বল৷ আমি সেই বলটিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতাম।

আমার বাড়ির পেছনেই ছিল চতুর্থ লিগের এক ফুটবল দলের স্টেডিয়াম৷ আমি সারা দিন এলাকার আনাচকানাচে ফুটবল খেলতাম৷ সন্ধ্যায় অন্য সব ছেলেপেলে বাড়ি ফিরে গেলে আমি আরও খেলতাম৷ অন্ধকার হওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পরও আমার পায়ে ফুটবল থাকত৷ অন্ধকারে আমি চোখে কিছুই দেখতাম না৷ সে জন্য আমি শুধু সামনের দিকে বল কিক করে যেতাম৷ আমি দুটি কাঠি দিয়ে গোলপোস্ট বানাতাম৷ অন্ধকারে সেই গোলপোস্টের অদৃশ্য জালে কিকের পর কিক করে যেতাম৷ এর বছর দশেক পর, যখন আমি প্রথম ক্লাব আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সের হয়ে চুক্তি করি, তখন বুঝেছিলাম অন্ধকারে সেই ফুটবলচর্চা আমার কত কাজে লেগেছে৷ আমার প্রথম আয় করা টাকা দিয়ে আমি এক জোড়া ট্রাউজার কিনেছিলাম৷

আমার জন্ম বুয়েনস এইরেসের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অংশ ফ্যাবেল ফিওরিটোতে৷ সেই অঞ্চলের দারিদ্রের মাত্রা আর আমার ছোটবেলার বন্ধুরা এখনো সেই আগের মতোই আছে৷ শুধু রাজনীতিবিদ আর সরকারি লোকেরাই দিনকে দিন ধনী হচ্ছে৷ আমার সামনেও ধনী হওয়ার অনেক সুযোগ ছিল৷ কিন্তু আমি সেই সুযোগকে ‘না’ করে দিই৷ আমার ‘না’ বলার পেছনে যুক্তি ছিল, আমাকে ধনী হতে হলে গরিবের কাছ থেকে চুরি করতে হবে৷

আমি সব সময় আমার বাবার কথা মনে আনি৷ বাবা যখন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতেন, আমরা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম৷ আট সন্তানের জন্য তিনি বেশি কিছু আয়ও করতে পারতেন না৷ আমরা চুপ করে বাড়িতে বসে থাকতাম৷ আমাদের কোনো খাবার থাকত না৷ আমাদের কষ্ট কেউ বুঝবে না৷ আপনি যদি ক্ষুধার্ত না হন, তাহলে আমার কষ্ট বুঝতে পারবেন না৷

আমি একবার গরিবদের কথা বলার জন্য আর্জেন্টিনার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ আমার একটি কথাও শোনেনি৷ আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল কিংবা কিউবা সব জায়গাতেই একই সমস্যা—দারিদ্র। ধনী দেশগুলো জন্য আমাদের এই দীনতা৷

এটা সত্য, কোনো কিছু বদলে দেওয়া বেশ কষ্টকর৷ কিন্তু এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা সেই কুশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে জানি৷ কেউ গরিবদের পক্ষে কথা বলে না৷ সেটা স্বয়ং পোপ থেকে শুরু করে সব দেশের রাজনীতিবিদেরা৷ বার্লিন ওয়াল ধ্বংসের পরে সারা পৃথিবীতে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে নয় গুণ৷ এদের দেখার কেউ নেই৷

ফুটবল মাঠে বলের পেছনে দৌড়ানোই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের স্মৃতি

ফুটবল মাঠে বলের পেছনে দৌড়ানোই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের স্মৃতি
সংগৃহীত

আমি সব সময় আমার বাবার কথা মনে আনি৷ বাবা যখন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতেন, আমরা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম৷ আট সন্তানের জন্য তিনি বেশি কিছু আয়ও করতে পারতেন না৷ আমরা চুপ করে বাড়িতে বসে থাকতাম৷ আমাদের কোনো খাবার থাকত না৷ আমাদের কষ্ট কেউ বুঝবে না৷ আপনি যদি ক্ষুধার্ত না হন, তাহলে আমার কষ্ট বুঝতে পারবেন না৷ আমার বোন কম খেত, যেন আমি রাতের বেলায় বেশি খেতে পারি৷ এমন পরিস্থিতিতে আপনার অন্য মানুষের প্রতি মায়া, মমতা আর ভালোবাসা তৈরি হবে৷ আমার মা পেটব্যথার ভান ধরে কিছু খেতেন না৷ তিনি সেই খাবার তাঁর সন্তানদের জন্য রেখে দিতেন৷ পাত্রের শেষ দানাটুকু পর্যন্ত তিনি আমাদের দিয়ে দিতেন৷ এই কষ্ট নিয়েই আমার বেড়ে ওঠা৷ আমার মা আমাকে মিথ্যা বলে খাওয়াতেন৷ কেউ কেউ একে কল্পকাহিনি বলে উড়িয়ে দেয়৷ কিন্তু আমার কাছে দারিদ্র্যই সত্য, বাস্তবতা৷ আমি সেসব কষ্টের সময়ের কথা ভুলিনি৷ আমি যে ভুলতে পারব না৷ আমার বাবা কাভানটাকা মার্কেটে কাজ করতেন৷ তিনি সব সময় ভারী ব্যাগ বহন করতেন৷ বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ঘাড়ে ব্যাগ টানতেন৷ বাবা যখন বাড়ি ফিরতেন, তাঁর পিঠ আর ঘাড়ে বরফের ব্যাগ রেখে দিতেন মা৷ আমরা ভাইবোনেরা অবাক হয়ে তা দেখতাম৷

আমি ছোটবেলায় কখনো জন্মদিন উদ্‌যাপন করতে পারতাম না৷ আমাদের কখনোই টাকাপয়সা হাতে থাকত না৷ জন্মদিনে আমার পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন আমার গালে চুমু দিত৷ সেই চুমুই ছিল আমার জন্য বড় উপহার৷

আমি ম্যারাডোনা, যে কিনা গোল করতে পারে, আবার ভুল করতে জানে৷ আমি সব বাধা নিজের মতো করে লড়তে জানি৷ আমার মা সব সময় চিন্তা করতেন আমিই সেরা৷ নিজের ওপর বিশ্বাস রাখাই সবচেয়ে কঠিন শ্রমের কাজ৷ আমি ছোটবেলা থেকে আমার মায়ের বিশ্বাসকে শক্তভাবে ধারণ করেছি৷ ফুটবল মাঠে বলের পেছনে দৌড়ানোই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের স্মৃতি৷ সমালোচকেরা আমার নামে অনেক কিছুই বলে৷ কিন্তু কেউ বলতে পারবে না আমি ঝুঁকি নিতে পারি না৷