Logo

নগরবধু আম্রপালী মহাকাব্য- ডঃ এম এ আলী

অনিন্দ্য বাংলা
মঙ্গলবার, আগস্ট ১১, ২০২০
  • শেয়ার করুন

ভুমিকা: উপনিষদে নারীর স্বাধীন ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণে বানপ্রস্থ এবং সন্যাস গ্রহণের বর্ণনামূলক অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতে কিছু রাজ্যে নগরবধূর মতো প্রথা প্রচলিত ছিল। নারীরা নগরবধূর ঈপ্সিত শিরোপা জয় করতে প্রতিযোগিতা করতো। বৈশালীর শ্রাবস্তিতে বেড়ে উঠা আম্রপালী (আমগাছের নীচে পেয়েছিল বলে নাম রাখা হয়েছিল আম্রপালী) এরকমই একজন জনপ্রিয় নগরবধূ যার কাহিণী কাব্যকারে সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরা হয়েছে ।

 

শ্রাবস্তির আম্রবনে গাছের নীচে পরিত্যক্ত
একটি কন্যাশিশু পেয়েছিল মালী দম্পতি
সন্তানসম স্নেহে বড় হতে থাকে শিশুটি
কৈশোরে পা রাখতেই পরে সংকটে।
ছবি৩: সুন্দরী আম্রপালী ( রূপকল্প )

সংকটের কারণ মেয়েটির আগুনে রূপ
সকলেই দিতে চায় সেই আগুনে ঝাঁপ
জনপদের রাজা শহরের বণিক গ্রামের মহাশয়
নগরের শ্রেষ্ঠী কে নেই তাঁর প্রণয়ীর তালিকায়।

বৈশালী ছিল অধুনা ভারতের বিহারের
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সমৃদ্ধ এক নগরি
ক্ষত্রিয় সম্প্রদায় লিচ্ছবিদের রাজধানী
কায়েম ছিল সেথায় বজ্জিয়ান গণতন্ত্র।

বৈশালী ছিল বিশ্বের প্রাচীন গণতন্ত্রের একটি
রাজা হতো নির্বাচনের মাধ্যমে জনতার ভোটে
ছিলনা কোন পরিবারতন্ত্র, যোগ্য হলে তবেই
নির্বাচিত হয়ে বসার সুযোগ পেত রাজ্যপটে।

বৈশালীর এক রাজা মনুদেবের অসির ঘাতে
কতল হয়েছিল আম্রপালীর বাল্য প্রেমিক
বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তাদের সে রাতে
বিচারের তরে তাই সভা বসে বৈশালী সংসদে।

আম্রপালীকে সভায় তলবের পরে তাকে দেখে
সমস্বরে বলে সবে এ যে স্বর্গের অপ্সরা- স্ত্রীরত্ন
ঐশ্বরিক সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার সবার
ঈশ্বর সৃষ্ট চাঁদ হতে পারেনাতো কারো একার।

গণতন্ত্র দেয় বিধান বৈশালীর আম্রপালী
কোন দিন পারবে না করতে বিয়ে কারণ
এত রূপ-যৌবন নিয়ে সে কেবল একজন
পুরুষের ভোগ্যা হতে পারেনা ইচ্ছা মতন।

বৈশালীর গণতন্ত্রের সর্বসন্মত রায়
অপরূপা সুন্দরী নৃত্যপটিয়সি নারী
আম্রপালী হবেন বৈশালীর নগরবধূ
অর্থাৎ নগড় পুরুষদের জন্য ভোগ্যা ।

বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থেও তাঁকে জনপদ-কল্যাণী
তথা নগরবধু হিসাবে হয়েছে বলা এছাড়া
জনপদ-কল্যাণী নগরবধূ শুধু এক সামান্য
গণিকাই নহেন, নৃত্যগীতেও তিনি অসাধারন।

অভিজাত সব আদব কায়দা রপ্ত এই সুন্দরীর
সঙ্গসুখ উচ্চবংশের পুরুষই কেবল পাবে তার
নিজের সঙ্গী নিজেই নির্বাচন করতে পারবে তবে
জনপদ-কল্যাণী বলে তাঁর বিয়ে কভু নাহি হবে ।

নগরবধু সুবাদে তিনিই ছিলেন বৈশালীর রাজনর্তকী
ছিল তার বিশাল উদ্যান আর মর্মর পাথরের অট্টালিকা
শর্ত মতে আম্রপালীর সঙ্গে এক আন্দঘন নিশিযাপনের
দাম ছিল পাঁচশত কার্শপণ (মুদ্রা) রাজসিকতো বটেই ।
ছবি-৪ আম্রপালীর নৃত্যগীত দৃশ্য(ছায়াছবি অবলম্বনে)

জগতখ্যাত আম্রপালীর রূপের আগুনে ঝাঁপ
দিতে চাইলেন মগধের গুণধর সম্রাট বিম্বিসার
এদিকে দুই রাজ্য আবার ঘোরশত্রু একে অপরের
শত্রুর নগরবধূ সনে মিলনের তরে খুঁজলেন ফাঁক ।
ছবি-৫ মগধ সম্রাট বিম্বিসার

বনিকের বেশে মুসাফির সেজে রাতের আঁধারে
ঘোড়সওয়ারী হয়ে বিম্বিসারের বৈশালীতে প্রবেশ
ভোরেও আম্রকুঞ্জের সামনে বিশাল তাবুর বহর
অর্থের লেন দেন সেরে গেলেন আম্রপালীর ঘর।

দিবস-রজনী কেটে গেল ধ্রপদি সঙ্গিত আর নৃত্য গানে
বিম্বিসার সাথে আম্রপালীর হয়েছিল গভীর প্রেম তবে
বিম্বিসারের বিবাহ প্রস্তাব আম্রপালি হেলায় দিয়েছিল ঠেলে
তা না হলে দুই রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ যে ছিল অবিসম্ভাবি।

যদিও বৈশালী দখল করে নেয়ার ক্ষমতা ছিল বিম্বিসার
প্রেয়সীর অনুরোধে বৈশালী ছেড়ে চলে যায় মগধরাজ
তবে বিম্বিসার ঔরসজাত পুত্র এক জন্মে আম্রপালী গর্ভে
পুত্রটির নাম বিমল কোদান্না বলে হয়েছিল বিশ্বময় প্রচার ।

কিছুদিন বাদেই বিম্বিসাপুত্র আক্রমণ করেছিল বৈশালী
ইতিহাস কুখ্যাত অজাতশত্রুর হাতে বন্দি হল আম্রপালী
বন্দিনী নগরবধূর রূপমুগ্ধ অজাতশত্রু পুড়িয়ে দিয়েছিল
গোটা বৈশালী, শুধু বাদ রেখেছিল আম্রপালীর বাড়ীটি ।

দেশের এহেন অবস্থায় বিধ্বস্ত হয়েছিলেন বৈশালীর নগরবধূ
কিন্তু তবু তিনি মগধ রাজ অজাতশত্রুর কুক্ষিগত হননি কভূ
অজাতশত্রুর ধ্বংসলীলার পর ফের মাথা তুলে দাঁড়ায় বৈশালী
দু:খ সুখের দোলায় দুলে দুলে দিবস রজনী কাটায় আম্রপালী।

আনন্দ বিধুর আম্রপালী এক বর্ষা সজল দিনে
মহলের অলিন্দ হতে দেখল সৌম্যদর্শন এক সন্ন্যাসীকে
তাঁর রূপে মুগ্ধ রাজ নর্তকী ভাবল একেই করবে সে বশ
দেশবিদেশের পুরুষসিংহের তুলনায় সেতো এক সন্ন্যাসী!
ছবি-৬ অলিল্দ হতে আম্রপালীর দৃশ্য লোকন(রূপক চিত্র)

আম্রপালী খবর পেল বৈশালীতে এসেছেন তথাগত বুদ্ধ
সঙ্গে কয়েকশো শ্রমণ বর্ষার চারমাস কাটাবেন এখানেই
বর্ষায় তাঁরা করেন না ভ্রমন যতি টানেন নগরের উদ্যানে
আর নগরবাসীর গৃহে গৃহে যান ভিক্ষা ও আশ্রয় সন্ধানে।

সেই তরুণ সন্ন্যাসী বৌদ্ধ শ্রমণ ভিক্ষা ও আশ্রয়প্রার্থী হলে
আম্রপালী তাঁকে ভিক্ষা দিয়ে বলে করতে যাপন বর্ষাকালে
তাঁর প্রাসাদবাসী হয়ে, শুনে এ কথা সন্যাসী জানায় তাঁরে
তথাগতর আদেশ ছাড়া নেয়া যাবেনা আশ্রয় আ’ম্লির ঘরে ।

বৈশালীতে তথাগত বুদ্ধর কাছে অনুমতি চাইল তরুণ শ্রমণ
সবাইকে বিস্মিত করে তথাগত বুদ্ধ অনুমতি দিলেন তারে
এনিয়ে ভিক্ষুসঙ্ঘে বইল আলোচনা আর সমালোচনার তুফান
এক নগরবধূর বাড়িতে কি করে থাকবেন বৌদ্ধ তরুন শ্রমণ ?

বুদ্ধ বলেছিলেন ওই শ্রমণের চোখে কোনও কাম দেখিনি
নিশ্চিত তিনি বর্ষা অতিবাহিত হলে নিষ্কলুষ হয়েই শ্রমণ
ফিরবেন তাঁর কাছে এ এক অগ্নিপরীক্ষা , নিশ্চিত তিনি
এতে জয়ী হবে শ্রমণই,তবে এ কথায় কেও আশ্বস্ত হলনা।

বর্ষা কাটলে পর একে একে জড়ো হলেন সকল শ্রমণেরা
বৈশালীতে যাঁরা ছিলেন সমবেত হলেন বুদ্ধর কাছে তারা
নগরবধূর প্রাসাদে কাটিয়ে চার মাস এল সেই তরুণ ভিক্ষু
আগের মতোই নিষ্কলুষ দাঁড়ালেন তথাগতবুদ্ধের সন্মুখ ।

পিছন পিছন এলেন আম্রপালী যার গায়ের রং দুধে আলতা
বেদানার মতো লাল ঠোট,আভাযুক্ত কপোল, হরিণ হরিণ নয়ন
রূপযৌবনে পরিপূর্ণা সেই আম্রপালীর পরনে মোটা কাষার বস্ত্র
চাঁপাফুলের মতো আঙুল জোরে করল প্রণাম গৌতম বুদ্ধকে।

জানালেন তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করার জন্য হেন কোন
চেষ্টাই রাখেননি বাকি কিন্তু এই প্রথম কোন পুরুষকে
বশ করতে হয়েছেন ব্যর্থ বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালী
উল্টে সর্বত্যাগী তরুণ শ্রমণের কাছেই বশীভুত তিনি ।

আজ সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধর চরণে আশ্রয় চান আম্রপালী
বাকি জীবন কাটাতে চান প্রব্যজ্যা নিয়ে তবে তার আগে
আম্রপালীর সঙ্গে তাঁর ঘরে অতিথি হয়ে তাঁর হাতে অন্নগ্রহণ
করবেন তথাগত বুদ্ধ এটা তাঁর প্রতি আম্রপালীর অমর দাবী।

নিজের সব সম্পদ‚ প্রাসাদ‚ উদ্যান বৌদ্ধ সঙ্ঘে করে দান
মোহমুক্ত হয়ে বাকি জীবন উৎসর্গই করেছিলেন আম্রপালী
জীবনের অর্ধাংশ ভিক্ষুনী হয়েই বৌদ্ধ সঙ্ঘে করেন অর্পণ
হিংসা-লালসা জাত কুপ্রবৃত্তিকে দূর করে হলেন সর্বত্যাগী।

কাহিনীর দ্বিতীয় অধ্যায় :ভিক্ষুনী আম্রপালী

শহরবাসী অনেকেই আজো তাঁকে সেই বাঁকা চোখেই দেখে
কিশোরী কালের রূপ যৌবনের কথা কেউ রাখেনি স্মরণ
রূপোজীবিনী হননি তিনি নীজের শখে,বৈশালীর গনতন্ত্রের
সবটাই ছিল গণরাজের খেয়ালীপনা, বানালো তাকে নগরবধু ।

ভিক্ষুনী আম্রপালী একদিন বেরিয়েছিলেন ভিক্ষার তরে
মুণ্ডিত মস্তক, পরণে কাষার বস্র ,ঠোঁটে বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি
বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করে ফিরার কালে কানে এল কথা
যুবকেরা পথে একে অপরে বলছে বুড়ি হয়েছে, চুল পেকেছে,
চামড়া ঝুলেছে অথচ এক কালে রূপে বৈশালী কাঁপিয়েছে !।

ছিল সে বৈশালী রাজ্যের নগরনটী
পুরুষেরা সে কথা ভুলতেই পারেনি
শিশু আম্রপালী মা বাবাকে যে দেখেইনি
হল নগরনটী সে তো পুরুষেরই কারণে।

তথাগতর দর্শন সেরে সে দিনের ফেরাটা
এখনও দিব্বি মনে গেথে আছে তাঁর
পুরুষেরা রথে চড়ে বুদ্ধ দর্শনে যাচ্ছেন
সুন্দরী নগরনটী এমনি এমনি যাবে ফিরে?।

হবে না কিছু খেলা? আম্রপালীর রথ ছুটছে
আচমকা চাবুক খেয়ে কোন কোন ঘোড়া
সামনের পা দুটো ওপরে দিকে দিচ্ছে তুলে
আম্রপালী যেন পড়ে যায় রথ থেকে ছিটকে ।
ছবি -৯: রথের ঘোড়ার কান্ডকির্তী( রূপক চিত্র)

কিছু কিছু পুরুষের রথ ইচ্ছা করে
উঠে পরছে আম্রপালীর রথের পরে
ছুটন্ত রথে ‘ইভটিজিং’-এর কৌশল
ঐ সব পুরুষদের ভালই করায়ত্ত ।

তবে আম্রপালী আজ দমবেনা
তিনি আর সেই মেয়েই নন
যাকে এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও
মানতে হবে বহুবল্লভা জীবন।

আক্রমণ শুরু করতেই হবে এখন
ধাবমান রথের অক্ষের সঙ্গে অক্ষ
চক্রের সঙ্গে চক্র স্বেচ্ছাকৃত ভাবে
লাগিয়ে দিচ্ছেন আম্রপালী কৌশলে।

একটা সময় উঠল চিৎকার
আম্রপালী, একি করছ তুমি ?
আমাদের এ জীবন যে যায়
গণিকার উত্তর যেতে দাও আগে।

কাল সকালে ভিক্ষুসঙ্ঘ নিয়ে
গৌতম আসবেন আমার ঘরে
ব্যস্ত আছি তাঁদের ভোজের তরে
সে সুখেই আছি কেটে পর এক্ষনে।

এবার রথারূঢ় পুরুষদের চিৎকার,
হে আম্রপালী, লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে
এই নেমন্তন্ন আমাদের দাও ছাড়ি
আমরা সভাগৃহে ওঁদের করাব আহার।

ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে আম্রপালী দিলেন উত্তর
সারা বৈশালী নগর আমাকে দিলেও হবে না সেটি
গণরাজ্যের পুরুষরা নিজেদের মধ্যে করছে বলাবলি
ইস একটা মেয়ে তাও গণিকা তারি কাছে গেলাম হারি।

এই জয়ের পরদিনইতো আম্রপালী
প্রব্রজ্যা নিয়ে হয়েছিলেন ভিক্ষুণী
জয়? পরাজয়? এ সবের বাইরেও
তো আছে নারীর নিজস্ব স্বর।

ভিক্ষুণী বেশে থাকলেও কি তাঁর
পক্বকেশ আর শিথিল স্তন নিয়ে
হাসি ঠাট্টা করবে বৈশালী নগরী?
দর্পণে নিজেকে দেখেও সে দিন
একদন্ড শান্তি পাননি তিনি।

জানিয়েছিলেন তার দুঃখ গৌতম বুদ্ধকেও
আমার চুল ছিল কালো, আজ তা শনের নুড়ি
সত্যবাদী বুদ্ধ বলেন, কখনও বা এক দিন
আমার ঘাড় ছিল মসৃণ আজ বেঁকেচুরে একসা ।

সত্যবাদী বুদ্ধ বলেন, এতে কোনও তফাৎ নাই
বহু স্তবকে লেখা আম্রপালী কবিতা একটাই
এতে কোনও তথাগত বুদ্ধ নির্বাণের কথা নাই
আছে শুধু নারীর নিজস্ব স্বরটুকু জানিয়ে দেয়াই।

আজ যে সুন্দর কাল সে তা থাকে না
তাই জীবনে হা-হুতাশ আর করো না
সত্যবাদী বুদ্ধ বলেন তফাত কোন নাই
তাবত জীব জগতে অনিত্য সবাই।
ছবি -১১: হাতীর দাতে খোদাই করা গৌতম বুদ্ধের সাথে আম্রপালী

উল্লেখ্য ১৯৬৬ সালে হিন্দী ভাষায় মুক্তিপ্রাপ্ত লেখ ট্যান্ডন পরিচালিত ‘আম্রপালী’ নামক চলচ্চিত্রটি বেশ পরিচিতি পেয়েছিল ।

ছবিসুত্র: কৃতজ্ঞতার সহিত গুগল অন্তরজাল (৬টি ছবি) ও ৩টি ( ১, ২ ও ৫) সামুর ব্লগার ইসতিয়াক অয়ন
তথ্য সুত্র : জৈন ধর্মগ্রন্থ ,অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ , বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ , পালি ভাষায় লেখা আম্বপালিকাসূত্র ,
শ্রী শান্তিকুসুম দাশ গুপ্ত রচিত বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম এবং প্রাচীন বৌদ্ধসমাজ