Logo

প্রখ্যাত আবৃত্তিকার তারিক সালাউদ্দিন আর নেই। শেষ পর্যন্ত লাশ কাঁধে তুলে নিলেন কবি, সংগঠক ও সমাজকর্মীরা !

অনিন্দ্য বাংলা
বুধবার, মে ১৩, ২০২০
  • শেয়ার করুন

অনিন্দ্যবাংলা ডেস্ক : মৃত মানুষের লাশ বহন করতে অন্তত চার জন মানুষের প্রয়োজন হয়। প্রখ্যাত আবৃত্তি শিল্পী তারিক সালাহউদ্দিন মাহমুদের লাশ যখন আমরা বহন করে কবরের উদ্যেশে নিয়ে যাব তখন জয়দেব সাহা,স্বাধীন চৌধুরী ও আমি সহ আমরা মাত্র মাত্র তিন জন! এই আবেগঘন লিখাটি পোস্ট দিয়েছেন, কবি আলী ইউসুফ।

দীর্ঘদিন যাবৎ রোগে ভুগছিলেন ময়মনসিংহের বিশিষ্ট শিল্পীজন প্রখ্যাত আবৃত্তিকার তারিক সালাহ উদ্দিন। মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে গতকাল ১১ মে সোমবার তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ( ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন) মৃত্যুকালে এক কন্যা সন্তান রেখে গেছেন।

তারিক সালাউদ্দিনের মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য প্রতিবেশী ও এলাকাবাসীরা কেউ তেমন এগিয়ে আসেন নি ! করোনা ভয়ে সবাই যার যার স্থানে থেমে রইলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে সমাহিত করার জন্য এগিয়ে আসলেন, কবি স্বাধীন চৌধুরী, আলী ইউসুফ, আবৃত্তিকার জয়দেব সাহা।

কবি আলী ইউসুফ লিখেছেন…

 

#করোনা_আমাদের_কতটা_অসহায়_করেছে!

“মানুষ বেঁচে থাকতে যত না মানুষের প্রয়োজন হয়।
মরে যাবার পর তারচেয়ে বেশি মানুষের প্রয়োজন হয় তাকে কবরে নিয়ে যাবার জন্য।
এই ছবি গুলো তুলবার সময় অামার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল।”

এই কথা গুলো বলে বলে কেঁদে ফেলছিল আবৃত্তি শিল্পী ও আবৃত্তি সংগঠক জয়দেব সাহা।

মৃত মানুষের লাশ বহন করতে অন্তত চার জন মানুষের প্রয়োজন হয়। প্রখ্যাত আবৃত্তি শিল্পী তারিক সালাহউদ্দিন মাহমুদের লাশ যখন আমরা বহন করে কবরের উদ্যেশে নিয়ে যাব তখন জয়দেব সাহা,স্বাধীন চৌধুরী ও আমি সহ আমরা মাত্র মাত্র তিন জন!
পরে এপেক্সিয়ান আশরাফ এসে যোগ দেয়ার পর হাফেজ এমদাদ সাহেবকে নিয়ে আমরা ছয় জনে একটি পিকআপ ভাড়া করে গুলকিবাড়ী বাড়ির উদ্দেশ্যে নিয়ে রওনা হই……….।

 

কবি স্বাধীন চৌধুরী লিখেছেন;

দেশবরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী ও তাত্ত্বিক তারিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
গুলকিবাড়ী কবরস্থানে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সমাহিত আজ

দুইঃ ‘গভীর শিল্পবোধে শাণিত, যুক্তিবাদী আর মানবিকসত্তায়- বাতিঘর’

আবৃত্তিগুরু তারিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।জন্মেছিলেন ১৯৪১ সনের ১৪ অক্টোবর। গতকাল ১১ মে সোমবার ২০২০ সন্ধ্যা সাতটায় ঈশান চক্রবর্তী রোডের ভাড়া বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।আজ সকাল ১০ টায় জানাজা শেষে গুলকিবাড়ী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

তারিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ দীর্ঘদিন মস্তিষ্কের জটিলতায় ভুগছিলেন।তারপর মাইলড স্ট্রোক হয় এবং হার্টে ব্লক ধরা পড়ে। কিডনি সমস্যাও ছিল।প্রায় দশ বছর ধরে ডায়বেটিসে ভুগছিলেন।সম্প্রতি দ্বিতীয়বার স্ট্রোকের পর পিঠে ঘা হয় এবং তাতে ক্ষত তৈরি হয়ে পচন ধরতে শুরু করে।
এমতাবস্থায় হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

করোনাকালের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে জানাজায় মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ হাফিজুর রহমান সজল, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ময়াজ্জেম হোসেন বাবুল এবং ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক স্বাধীন চৌধুরী।ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কবি আলী ইউসুফ শ্রদ্ধা-নিবেদনপর্ব পরিচালনা করেন।

উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্সামধারণ সম্পাদক কাজী আজাদ জাহান শামীম,ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সাবেক সভাপতি কবি ইয়াজদানী কোরায়শী, আবৃত্তিকার আমজাদ দোলন, জেলা আওয়ামীলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের নেতা মস্তাফিজুর বাসার ভাষানী,জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সদস্য উপস্থাপক সারওয়ার জাহান, নিরাপদ সড়ক চাই- ময়মনসিংহের সভাপতি আব্দুল কাদের চৌধুরী মুন্না, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক জয়দেব সাহা প্রমুখ।

সত্তর-আশির দশকের দেশ কাঁপানো আবৃত্তিকার তারিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।বাংলাদেশে তিনি আবৃত্তিকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং নবতর চিন্তা ও ধ্যান- ধারণায় সমৃদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন । ‘বস্তুবাদী আবৃত্তি তত্ত্ব ‘ আবৃত্তি বিষয়ে তাঁর মুল্যবান-আকর এক গ্রন্থ।এটি বাঙলা ভাষায় রচিত মৌলিক গ্রন্থের একটি। এই গ্রন্থ প্রকাশে আবৃত্তিগুরু তারিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ তাঁর অনুসারী প্রিয় অনুজ আবৃত্তির আরেক কুশীলব প্রয়াত কামরুল হাসান মঞ্জুর প্রতি বরাবরই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ।
তিনি প্রথাগত আবৃত্তির ফর্মকে ভেঙ্গে নতুন মাত্রা দিয়েছেন। তাঁর আবৃত্তি বিষয়ক চিন্তাশীল বিশ্লেষণী প্রবন্ধগুলো নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে।তাঁর মননশীল সমাজভাবনার গদ্যসমূহ সমাজ বদলের দিশা দেয়।যা গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হওয়া খুব জরুরী বটে।
তিনি জীবনের এক উজ্জ্বল সময় ঢাকায় কাটিয়েছেন। আবৃত্তির আলোকিত উন্মেষ ও বিকাশে ধ্যানমগ্ন হয়ে কাজ করেছেন। তৈরি হতে পথ দেখিয়েছেন দেশখ্যাত আবৃত্তি শিল্পীর অনেককেই। কবি জীবনানন্দ দাশ এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অধিক পছন্দের কবি হিশেবে তাঁর আবৃত্তির ক্যানভাসজুরে রয়েছেন। তিনি একজন সাম্যবাদী মানবিক মানুষ।পেশাগত জীবনে তিনি আলমগীর মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল কলেজে সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে সময়ে আশির দশকে প্রভাষক হিশেবে শিক্ষকতা করেছেন। পরবর্তীতে মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়য়ে শিক্ষক হিশেবে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সংস্কৃতিজন অধ্যাপক আমীর আহাম্মদ চৌধুরীর সাথে কাজ করেন। এক সময় মস্তিষ্কের অসুখটা প্রবল হয়ে উঠলে আর চাকুরী চালিয়ে যেতে পারেন নি। তারপর এভাবেই চিকিৎসা আর গৃহস্থালি-সংসার টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ-জীবন । তারিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ চাকুরী জীবনে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এবং অধ্যাপক আমীর আহাম্মদ চৌধুরী এই দু’জনেরই পছন্দের মানুষ ছিলেন এবং তাঁদের সহযোগিতাও পেয়েছেন সেই সময়, এ কথা জানিয়েছেন তিনি নানা আলাপচারিতায় ।

তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী দেশের কৃতি মানুষ আসাদুজ্জামান নূর ঘনিষ্ঠজন হিশেবে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা করেছেন সে জন্য তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।তিনি সকল মানুষের কাছেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য।
উল্লেখ্য, ১৯৬৮ সালে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারস ইন্সটিটিউটে তারিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদের আবৃত্তি শুনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন। তার ক’দিন বাদেই ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান টেলিভিশনে আবৃত্তি প্রোগ্রাম করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলেন প্রয়াত কবি শহীদ কাদরী।
তিনি ব্যক্তিগত জীবন-আচরণে যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন শিল্পের সৃজনেও। সামাজিক দায়বদ্ধতাকে মানতেন। পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন শিল্পকে।তাই তিনি শিল্পের শৈল্পিক-প্রায়োগিক নানা অনুষঙ্গ চেতনসূচকে বিচার করতে পছন্দ করতেন। যুক্তিবাদী মানস গঠনে উৎসাহিত করতেন সহযাত্রী, স্বজন, চিন্তকদের।কিন্তু যা মানুষের জন্যে কল্যাণকর নয়-তা প্রশ্রয় আশ্রয় দিতেন না কখনও। সমাজের মৌলিক সংকটের কার্যকারণ সবসময় অনুধাবনে রাখতেন।তাঁর লেখাগুলো আমাদের ধরিয়ে দেয় সেইসব বিষয় এবং তার থেকে উত্তরণের পথ ও পদ্ধতি।তাঁর সতত চাওয়া ছিল একটিই- মানবিক সমাজ, মানবিক পৃথিবী।জরাগ্রস্থ সমাজকাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে যে একদিন বৈষম্যহীন সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে- এমন বিশ্বাস সব সময় পোষণ করতেন তারিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।