Logo

বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান নিয়ে তারাকান্দা কৃষি অফিসারের মত বিনিময়

অনিন্দ্য বাংলা
বুধবার, জুন ৭, ২০২৩
  • শেয়ার করুন

অনিন্দ্যবাংলা ডেস্ক :   শিশুরা কাঁদামাটির মত, তাদেরকে যেভাবে আমরা গড়ে তুলবো সেভাবেই তারা গড়ে উঠবে। সাদা কাগজের মত তাদের মন। আমরা যা তাদের মনে গেঁথে দেবো,সেটা নিয়েই তারা বেড়ে উঠবে। শিশুদের যদি শুরুতেই আমরা খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ খাদ্য,পরিবেশ বান্ধব কৃষি,পরিবেশ বাঁচাতে গাছের ভূমিকা,সুস্থতা নিশ্চিত করতে কেমন খাদ্যাভাস হওয়া উচিত তা জানাতে পারি,শেখাতে পারি, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই শিক্ষা ছড়িয়ে যাবে সবুজ পাঠশালা হবে এই দীক্ষার ভিত্তি।।
এরই উদ্দেশ্যে, অনাবাদী পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন” প্রকল্পের
আওতায় ৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুসারে প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনার লক্ষ্যে পারিবারিক পুষ্টি বাগানের উপকরণ বিতরণ করা হয় এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আয়োজনে অনাবাদী জমি মোটিভেশনের মাধ্যমে আবাদের আওতায় লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় একটি মত বিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য প্রদান করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মিজাবে রহমত, ফাহমিদা সুলতানা, সহকারী কমিশনার (ভূমি),জীবন আরা,প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারসহ উপজেলা প্রকৌশলী, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা এবং সুধীবৃন্দ।।
সবুজ পাঠশালা ধারণার ভিত্তিতে মূল বিষয় ব্যাখ্যা করেন, অরুনিমা কাঞ্চি সুপ্রভা শাওন, উপজেলা কৃষি অফিসার,তারাকান্দা,ময়মনসিংহ।।
মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই খাদ্য, আর বাংলদেশের ৯০ ভাগ লোকের প্রধান খাবার ভাত। কোনো দেশের শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় এই খাদ্য নিরাপত্তা দিয়ে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য বলতে আমরা ধানকেই বুঝে থাকি। ধানকে এ দেশের জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরির মাসিক মুখপত্র রাইস টুডে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা বলতে মূলত ধান বা চালের নিরাপত্তাকেই বোঝায়। অন্য পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে না পারলেও দু বা তিন বেলা ভাতের সংস্থান প্রায় সবারই সামর্থ্যরে মধ্যে। এটি বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞানীরা ভাবছেন ভাতে কিভাবে শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করা যায়। বাংলাদেশে মাথাপিছু চালের গ্রহণ হার দৈনিক যে পরিমাণের পুষ্টি আমরা চাল বা ভাত থেকে পাই, তা কোনোভাবেই আমাদের চাহিদার সমান নয়। এ কারণে খাদ্যের চাহিদা মিটলেও পুষ্টির চাহিদাই পূরণে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে ৫ বছরের কমবয়সি শিশুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই কোনো না কোনো মাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছে, এর মধ্যে শতকরা ১৪ ভাগ শিশু ভুগছে মারাত্মক অপুষ্টিতে। এর কারণ পুষ্টি সচেতনতার অভাব অথবা পুষ্টিকর খাবার ক্রয় করার অসামর্থ্যতা।
খাদ্য গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হলো সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যে কোনো খাবার খেলে পেট ভরে যায় মনের চাহিদা মেটে, একথা ঠিক। কিন্তু তাতে দেহের চাহিদা কোনো ভাবেই মিটিয়ে সুস্থ থাকা যায় না। সে জন্য প্রকৃত বা পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার সম্পর্কে আমাদের সবার পরিষ্কার জ্ঞান ও ধারণা থাকা দরকার। আমাদের দেশে এখন আর খাদ্য ঘাটতি নেই। তবে পুষ্টি সমস্যা এখনও আছে। আর পুষ্টিঘাটতির চেয়ে পুষ্টি জ্ঞান সমস্যা আরো ব্যাপক। এদেশের অনেকেই হয়তো পুষ্টি সমস্যায় ভুগছে। আশ্চর্যের কথা হলো কেউ ভুগছে অপুষ্টিতে পুষ্টি সম্মত খাবার না খেয়ে; আবার কেউ ভুগছে অতিপুষ্টিতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার খেয়ে। পুষ্টিহীনতার কারণে অনেকে অহরহ অসুস্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের গর্ভবতী মা, দুগ্ধদানকারী মা ও শিশুরাই এর বেশি শিকার। এদের ঘাটতি পূরণে দানাদার খাদ্যকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অথচ এ ধরনের খাবার ছাড়া শাকসবজি, ফলমূল খাবারের যে বেশি ঘাটতি সেটা আমরা বুঝি না। বিশেষ করে শাকসবজি, ফলমূলে যে পুষ্টির আধার এটা আমরা অনেকেই বিশ্বাস করতে চাই না। পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে সুষম খাদ্য গ্রহণের প্রতি আমরা মোটেই সচেতন না। এ সব কারণে পুষ্টিশিক্ষা জ্ঞান আর প্রচারণার দরকার অনেক বেশি।
আমরাতো জানি নানা উপাদান দিয়ে গঠিত আমাদের শরীর। সুতরাং শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে নিয়মিত এবং পরিমিত উপযুক্ত খাবার আমাদের খেতে হবে। আমাদের জানতে হবে সব মানুষের খাবার একরকম না। পরিশ্রমী মানুষ, দুগ্ধপোষ্য মা, গর্ভবতী নারী, শিশু, বাড়ন্ত বয়স ছেলে মেয়ে, বয়স্ক সবার জন্য আলাদা হিসাব করে খাওয়া দিতে হবে। তবেই পুষ্টিসমৃদ্ধ জীবন যাপন করতে পারবে সবাই। যেমন গর্ভবতী, দুধপ্রদানকারী মা, শিশু, বাড়ন্ত ছেলে মেয়েদের জন্য আমিষ, ভিটামিন আর খনিজ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার বেশি দরকার। আবার যারা পরিশ্রমী তাদের শ্বেতসার ও স্নেহজাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। সহজে হজম হয় এমন খাবার বয়স্কদের জন্য বেশি দরকার। কিন্তু আমিষ ও স্নেহ জাতীয় পদার্থ খাবার বয়স্কদের বেশি দেয়া যাবে না। বরং যতকম দেয়া যায় তত ভালো। সুতরাং সব বয়সীদের খাদ্য নির্বাচনে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। আরেকটি কথা সমপুষ্টি পেতে দামি খাবারের চেয়ে কমদামি খাবার নির্বাচনও যে যুক্তিযুক্ত আমরা কিন্তু তা ভাবি না। এ ব্যাপারে আগ্রহী এবং অভিজ্ঞ হলে আমাদের জাতীয় লাভ বেশি হবে।
পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলেন দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন এবং দেহকে সুস্থ সবল ও নিরোগ রাখার জন্য নানাবিধ শাকসবজি ফলমূল খাওয়া অতি প্রয়োজনীয়। এগুলো ছাড়া সুষম খাবারের কথা চিন্তাও করা যায় না। খাদ্য বিজ্ঞানীদের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন প্রায় ২৫০ গ্রাম শাকসবজি খাওয়ার প্রয়োজন। আর আমরা খেতে পারছি মাত্র ৫০-৬০ গ্রাম। ফল খাওয়া দরকার ১৪০ গ্রাম। আমরা খেতে পারছি মাত্র ৪০-৪৫ গ্রাম। তাহলে প্রাপ্তি আর সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান অনেক। এত ব্যবধানে সুস্থ সবল থাকার কোনো উপায় নেই। আমরা জানি, আমাদের শরীরকে সুস্থ সবল রাখার জন্য ৬টি খাদ্য উপাদান ঠিকমতো খাওয়া। এ ৬টি উপাদান হলো প্রোটিন বা আমিষ, শর্করা বা শ্বেতসার, স্নেহ বা চর্বি, ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ, মিনারেল বা খনিজ এবং পানি। পানি আর শ্বেতসার নিয়ে এখন আর কথা বলার নেই। কেননা এ দুটি পুষ্টি উপাদান আমাদের পর্যাপ্ততা আছে। তবে পানির ক্ষেত্রে পানির অপর নাম জীবন একথা না বিশ্বাস করে নিরাপদ পানির অপর নাম জীবন এটিকে বেদবাক্য মেনে পানি খাওয়া দরকার সচেতনভাবে। মোটামুটিভাবে তেলও আমরা ইদানীং গ্রহণ করছি প্রয়োজনের খুব কাছাকাছি। বেশি জোর দিতে হবে আমিষ, ভিটামিন আর খনিজ উপাদানের ওপর। এগুলোর মূল উৎস শাকসবজি ও ফলমূল।
এবার সংক্ষেপে জেনে নিই শাকসবজি ফলমূলভিত্তিক কোন কোন উপকরণে কোন কোন পুষ্টি উপাদান আছে। আমিষের যোগানের জন্য মাছ, মাংস, ডিম, দুধের সাথে সব ধরনের ডাল, শিম, মটরশুটি, বরবটি খেতে পারি, শ্বেতসার বা শর্করার উৎস হিসেবে ভাত রুটির সাথে আলু, মিষ্টিআলু, শাকআলু, কচু, মূলজাতীয় সবজি, আম, কাঁঠাল, পেঁপে খেতে হবে। স্নেহজাতীয় পুষ্টির জোগানে নারিকেল, তেলজাতীয় ফসল, কাজুবাদাম, চিনাবাদাম, জলপাই, কাঁকরোল, সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী খেতে হবে। ক্যালসিয়ামের জন্য সব ধরনের শাকসবজি, কাচা পাকা কলা, জাম, লৌহের জন্য গুড়, শাকসবজি, তেঁতুল, তরমুজ, কলা এবং আয়রনের জন্য আনারস, বিভিন্ন শাকপাতা, আর বিভিন্ন ধরনের ভিটামিনের জন্য সব ধরনের রঙিন শাকসবজি, সব ধরনের ফল খেতে হবে।
পুষ্টিবিদরা বলেন প্রতিদিন যদি একজন মানুষ ৫ রঙের চার্ট অনুসরণ করে প্রতিদিনের খাবার খান তাহলে তার পুষ্টির কোনো অভাব হবে না। বিশ্ব পুষ্টি সমাধানের সাথে আমরাও আমাদের পুষ্টি নিয়ে ভাবছি এটা ঠিক। আমরাও পিছিয়ে নেই সেখান থেকে। পুষ্টির এ সমস্যা সমাধানে নতুন ধারণা সৃষ্টি করেছেন পুষ্টিবিদরা। তারা নাম দিয়েছেন ফাইভ কালারস এ ডে অর্থাৎ দিনে ৫ রঙের খাবার। আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে আমরা নাম দিতে পারি রঙধনু খাবার। ব্যাপারটি হলো যে কোনভাবে প্রতিদিনের খাবারে এ ৫ রঙের খাবার থাকতেই হবে। তবেই কেবল আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে যাবো অনায়াসে। ৫টি রঙ হলো লাল, হলুদ, সাদা, সবুজ এবং কালো। লাল রঙের খাবারের উৎস হলো লালশাক, বিট, টমেটো, ডালিম, তরমুজ, লাল ক্যাপসিকাম, মুশুর ডাল। হলুদ রঙের যোগানদাতা হলো গাজর, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টিকুমড়ার ফুল, পেঁপে, আম, কাঁঠাল, বেল, তাল, আনারস, কলা, কমলা, ডেউয়া, লটকন, বাঙ্গি, মুগ, মাশডাল, হলুদ ক্যাপসিকাম। সাদা রঙের মধ্যে আছে মাশরুম, ফুলকপি, মুলা, আলু, বেগুন, কচু, শালগম, ওলকপি, কুল, লিচু, পেয়ারা, নারকেল, শরিফা, আতা, জামরুল আমলকী, কামরাঙা। সবুজ রঙের খাদ্য আসবে বাঁধাকপি, সবুজ ফুলকপি, শিম, বরবটি, মটরশুটি, ঢেড়স, লাউ, সবুজ ক্যাপসিকাম, পুঁইশাক, পালংশাক, ধনিয়া, পুদিনা, চাল কুমড়া, কলমিশাকসহ অন্যান্য সবুজশাক থেকে। কালো রঙের যোগানদাতা খাদ্য হলো কালোজাম, কালো আঙুর, কালো পাতাকপি, কালো বেগুন। এভাবে পরিকল্পনা করে বেড়ে ওঠা শিশুসহ সবার জন্য খাদ্য তালিকা তৈরি করে প্রাপ্তি জোগান নিশ্চিত করে খাওয়াতে পারলে আমরা আমাদের দৈনিক জীবনে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে যাবো অনায়াসে, কমদামে, কাক্সিক্ষত বলয়ে। এ সহজ, সরল ব্যাপারটি মনে রেখে প্রতিদিনের খাবার খেলে খাবারভিত্তিক পুষ্টির দৈন্যতা আমাদের আর থাকবে না। আর রঙধনু কিংবা ফাইভ কালারস এ ডে ব্যাপারটি দারুণভাবে জনপ্রিয় করার সুযোগ আছে সবার মাঝে। বয়স, শ্রম, চাহিদা, অবস্থা অনুযায়ী খাবার নিশ্চিত করতে পারলে পুষ্টিগত লাভ বেশি হবে। সুতরাং আসুন না আমরা পুষ্টি অভিজ্ঞতা বাস্তবায়ন করি আমাদের পরিবারে বাস্তবায়নের এবং বিস্তৃতির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালাই অন্য সবার পরিবারে, সার্বিকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য। আরেকটি কথা এ রঙধনু চার্ট বা তালিকার কথা বেতারে, টেলিভিশনে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিসে, রাস্তায়, সিনেমায়, যানবাহনে, স্টেশনের, পত্রিকায়, প্রচারণায়, সব জায়গায় নিয়মিত এবং পরিমিত কৌশলে আবশ্যকীয়ভাবে উপস্থাপন করতে হবে এক সাথে। তবেই কার্যকারিতা বা ফলাফল আসবে কাংখিত পরিসীমায়। মনে রাখতে হবে, সুস্থ নাগরিক মানে সুস্থ দেশ। আমাদের করণীয় হলো-
আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির আঙিনায় যেটুকু খালি, পতিত জায়গা আছে তা যথাযথভাবে পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাপনার মাধ্যম প্রয়োজনীয় ফলমূল, শাকসবজির বাগান গড়ে তোলা এবং প্রয়োজন আর চাহিদা অনুযায়ী খাওয়া;
যে কোনোভাবেই হোক প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ তাজা সতেজ বিষমুক্ত শাকসবজি ফলমূল খাওয়া।।
সুস্থ নাগরিক,সুস্থ দেশ।।
কৃষিই সমৃদ্ধি।