Logo

বাঁচলো তিন হাজার গাছ!

রিংকন মন্ডল রিংকু
মঙ্গলবার, এপ্রিল ২, ২০২৪
  • শেয়ার করুন

তামিম রায়হান:কোনো কারণ ছাড়াই সুনামগঞ্জ—সাচনা সড়কের দুইপাশে থাকা তিন হাজার গাছ নিধনের কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিল বন বিভাগ। গাছ কাটতে ইতোমধ্যে গাছের গায়ে লাল রঙের নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয় গাছ। গাছ কাটার এমন খবরে ক্ষুব্ধ হন জেলার সচেতন মানুষ। প্রকৃতি—পরিবেশ রক্ষায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ হয়েছে। গাছ কাটার উদ্যোগ বন্ধ না করলে দিয়েছেন জানিয়েছেন কঠোর আন্দোলনের হুমকিও। এতো বৃক্ষ নিধন আত্মবিধ্বংসী সিদ্ধান্ত বলেছেন গবেষকরা।সুনামগঞ্জ—জামালগঞ্জ ( সাচনা) আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে কদম, কড়ই, মেহগনি, জাম, কাঁঠাল সহ নানা জাতের গাছ। সড়ক ও জনপদের মালিকানাধীন সড়কের দুইপাশে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় বন সৃজন করেছে বন বিভাগ, গাছগুলোর পরিচর্চা করেছে স্থানীয়রা। দুইপাশে থাকা হাজারো গাছের জন্য সবুজ শ্যামল পরিবেশের এ সড়কটি সুনামগঞ্জের সবচেয়ে সুন্দর সড়কের একটি। এসব গাছের ছায়ায় এসে মন শান্ত করেন হাওরের ক্লান্ত কৃষক। নির্মল পরিবেশে চলেন পথচারীরা, আশ্রয় পেয়েছে হাজারো পাখ—পাখালি। কিন্তু কোনো প্রয়োজন ছাড়াই সামাজিক বনায়ন বিধির দোহাই দিয়ে ১৯ কিলোমিটারের এ সড়কের প্রায় তিন হাজার বৃক্ষনিধনের আয়োজন করে বন বিভাগ। গাছ কাটার প্রস্তুতি হিসেবে লাল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করেছে গাছ। এতো বছর ধরে বেড়ে ওঠা গাছ হুট করে কাটার খবরে ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। সড়কে চলাচলকারী শিক্ষার্থী জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিয়াম বললেন, জেলার সবচেয়ে সুন্দর সড়ক এখন এটি। সড়কের সৌন্দর্য হচ্ছে দুইপাশে থাকা গাছগুলো। এগুলো কেটে ফেললে মরুভূমির মতো দেখাবে। এটা কোনো ভাবে যৌক্তিক না।

গৌরারং গ্রামের গোলাম রাব্বানী বলেন, গাছ জীবনরক্ষকারী অক্সিজেনের মূল উৎস। গাছ না থাকলে প্রাণ থাকবে না। শুধু প্রাণই নয়, বর্ষায় সড়কও রক্ষা করে গাছ। তাছাড়া এই সড়কের সবগুলো গাছ এখনো কাটার উপযুক্ত হয়নি। আরও অন্তত ১৫ বছর থাকবে গাছগুলো। এরপর কাটলে এর থেকে আরও বেশি টাকা পাওয়া যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টুকেরবাজার—সাচনা সড়কে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় ২০০৪ সালে রেইন্ট্রি, কড়ই, কদম, আকাশমনি, জাম, জারুলের ১৪ হাজার, মেহগনি ৪ হাজার ও ২ হাজার জাম—কাঁঠাল সহ মোট ২০ হাজার গাছ রোপণ করা হয়েছিল। গাছের পরিচর্চা করার জন্য গ্রামের সুবিধা বঞ্চিত মানুষদেরকে যুক্ত করে চুক্তি করে বন বিভাগ। মেয়াদ শেষে গাছের অর্থের ৫৫ শতাংশ পাবেন স্থানীয় উপকারভোগীরা যারা গাছের পরিচর্চার সাথে যুক্ত। ২০ শতাংশ জায়গার মালিক সওজ, ১০ শতাংশ বন বিভাগ আর ১৫ শতাংশ থাকবে নতুন বন সৃষ্টি করার জন্য। এর মধ্যে পরিচর্চা ও পরিকল্পনার অভাবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে অধিকাংশ গাছ মারা যায়। চুক্তি অনুযায়ী বাকি থাকা গাছগুলো সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেগুলো কাটার উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ। বন বিভাগের ভাষ্যমতে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় স্থানীয় চুক্তিবদ্ধ উপকারভোগীরা গাছ কাটার জন্য তাগিদ দেয়ায় গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তারা। তবে একাধিক চুক্তিবদ্ধ উপকারভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা যে চুক্তি করেছিলেন সেটাই তারা ভুলে গিয়েছিলেন। তাদের যে সমিতি ছিল তার নামটাও মনে নেই। বনকর্মীরা গিয়ে তাদের খুঁজে বের করে গাছ কাটার তাগিদ দিয়েছেন তাই তারা রাজি হয়েছেন। গৌরারং গ্রামের চুক্তিবদ্ধ উপকারভোগী বলেন, সড়কের গাছ অনেক আগে লাগিয়েছিলাম। এসব ভুলেই গিয়েছি। কয়েকমাস আগে বন অফিসের মানুষ এসে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে বলছে, গাছগুলোর মেয়াদ শেষ কাটা লাগবে। তারা তাদের গাছ কাটলে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা এখান থেকে কিছু পাবো এটাই। তবে গাছ কাটলে ক্ষতি হলে গাছ কাটার দরকার নেই। আরেক উপকারভোগী আলীম উদ্দিন বলেন, তারা আসছে গাছের মাপজোক করছে, আমরা শুধু সহযোগিতা করেছি। আমাদের কাগজপত্রগুলোই আর নাই। তারাই আমাদের কাগজ বের করে দিছে। গাছ কাটলে ক্ষতি হবে আমাদের থেকে তারা (বন বিভাগ) বেশি ভালো জানে। যদি গাছ কাটলে ক্ষতি হয় আমরা কাটব না। তবে আমরা যেহেতু কষ্ট করেছি আমাদেরকে সরকার আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করলেই হয়।

একসাথে এতো গাছ কাটার সিদ্ধান্ত আত্মবিধ্বংসী। পুরো এলাকার ইকো সিস্টেম নষ্ট করার পায়তারা বলছেন প্রকৃতি গবেষক অ্যাড. কল্লোল তালুকদার। তিনি বলেন, এক সাথে এতো গাছ কাটলে এই গাছকে ঘিরে যে ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে সেটা ধ্বংস হয়ে যাবে। গাছপালার উপর নির্ভরশীল বাস্তুতন্ত্র, পাখিদের আবাসস্থল নষ্ট হবে। পুরো পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে। এটা একটা হঠকারী আত্মবিধ্বংসী সিদ্ধান্ত। সরকার চাইলে উপকার ভোগীদের অন্যভাবে সহযোগিতা করে গাছগুলো রক্ষা করতে পারে। দরকার হলে সামাজিক বনায়ন বিধির সংশোধন করে হলেও এই গাছগুলো রক্ষা করতে হবে।

এক সাথে সবগুলো গাছ কেটে ফেললে সড়কের ক্ষতির কথা জানান সড়ক ও জনপদের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম প্রামানিক। তিনি বলেন, বন্যার পরে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের অভ্যন্তরে থাকা কয়েকটি গাছ কাটার জন্য আমরা চিঠি দিয়েছিলাম। এতো গাছ কাটার ব্যাপারে কিছু জানি না। এই গাছগুলো বর্ষায় সড়ককে রক্ষা করে, গাছ কেটে ফেললে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জেলা উন্নয়ন সভায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো।

একসাথে এক সড়কের তিন হাজার গাছ নিধনের খবরে ক্ষুব্ধ সুনামগঞ্জবাসী। কর্তন বন্ধে পালন করেছেন মানববন্ধন কর্মসূচি। প্রতিবাদের মুখে গাছ কর্তনের টেন্ডার আহবান স্থগিত করেছে বন বিভাগ।

সুনামগঞ্জ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা মাহমুদুল হক খাঁন বলেন, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি হচ্ছে সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের উপকারের জন্য। তাদেরকে নিয়ে বন সৃজন করা হয়, যার অধিকাংশ লভ্যাংশ তারাই পাবেন। বিধি অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হলে গাছগুলো কর্তন করে চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন অংশীজনের সাথে অর্থ বণ্টন করা হয়। এই সড়কের গাছগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ায় কতগুলো গাছ সেই সংখ্যা ও কতটাকার গাছ বেঁচে আছে সেটা নির্ধারণের জন্য মার্কিং করা হয়েছে। এটা দেখেই মানুষের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় আমরা বাকি কার্যক্রম স্থগিত করেছি। আমাদের বন বিভাগের উর্ধ্বতন কতৃর্পক্ষ ও জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।