Logo

বিপর্যয়ের আশঙ্কায়, হাওরে শুরু হয়েছে আগাম ধান কাটা

অনিন্দ্য বাংলা
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৬, ২০২০
  • শেয়ার করুন

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি :  হাওর অঞ্চলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধান কাটা না হলে, বৃষ্টি ও আগাম বন্যায় তলিয়ে যেতে সমস্ত ফসল তাই অনেক স্থানে আগাম ধান কাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু হাওরে যেসব শ্রমিক ধান কাটার কাজ করেন তারা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর অনেকেই এখন নিজ নিজ গ্রামে চলে গেছেন। এখন তারা কীভাবে সেখান থেকে আসবেন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কীভাবে কাজ করবেন?

তাছাড়া করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে লকডাউনের ফলে শুরু হয়েছে যানবাহন সংকট। তাছাড়া সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্যও  রয়েছে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশাবলী । ৯ এপ্রিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি নোটিশে ধান কাটার শ্রমিকদের ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাওর এলাকায় আগমন ও চলাচল নির্বিঘ্ন করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ’ করা হয়েছে। নোটিসে বলা হয়, “হাওর এলাকায় ধান কর্তন ও চলা-চলকালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি হ্রাসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ নিজের , কৃষকের ও শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের নির্দেশনাসমূহ যথাযথভাবে পালন করবেন,”।

আগাম বৃষ্টি ও বন্যার আশঙ্কায় সুনামগঞ্জে হাওরের বোরো ধান দ্রুত কেটে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ, স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ভারত আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী ১৭-২০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মেঘালয় ও বরাক অববাহিকায় ১৫০ থেকে ২৫০ মিলিমিটার এবং ত্রিপুরা অববাহিকায় ১০০ থেকে ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার হাওর অঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং কোনো কোনো স্থানে নদীর পানি সমতল বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ কারণে সুনামগঞ্জের হাওরের বোরো ধান অতিদ্রুত কাটার যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন।

আরও বলা হয়, ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ বাস্তবায়নের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প নির্ধারণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিসহ (পিআইসি) সবাইকে নিজ অধিক্ষেত্রে অবস্থানপূর্বক বাঁধের নিবিড় মনিটরিং জোরদার নিশ্চিত করার জন্য বলা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার পয়েন্ট রয়েছে, সেসব স্থানে সংশ্লিষ্ট পিআইসিদের উপস্থিতি ও সার্বক্ষণিক মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। বাঁধের কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিলে বা ভেঙে গেলে তাৎক্ষণিক মেরামত করতে হবে। প্রয়োজনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানাতে হবে।

মঙ্গলবার দুপুরে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা দেখার হাওরে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। তারা কৃষক ও শ্রমিককে হাওরে নেমে পাকা ধান কাটতে আহ্বান জানিয়ে ধানকাটায় নামলে শ্রমিকদের ত্রাণ দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন।

এদিকে করোনার ভয়াল থাবার কারণে জনজীবন স্থবির হওয়া, বিভিন্ন জেলায় লকডাউন ও সব গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বাইরের শ্রমিকদের বিশেষভাবে নিয়ে আসতে নির্দেশনা দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। হাওরের ধান কাটতে আসা শ্রমিকদের লকডাউনের আওতার বাইরে রেখে তাদেরকে হাওরে আসতে প্রচারণাও চালনো হয়েছে। উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকদের হাওরে নিয়ে আসতে সেসব এলাকার প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ১ হাজার ৮৭০ জন শ্রমিক সুনামগঞ্জের হাওরে ধান কাটতে প্রবেশ করেছে বলে জানা গেছে। এ বছর বাইরের জেলা থেকে অন্তত ৮ হাজার শ্রমিক আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছর ২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ হেক্টর বোরো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্জিত হয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর। বিআর ২৮, ২৯ সহ হ্ইাব্রীড, উফশীসহ কিছু স্থানীয় জাতের ধানও আবাদ হয়েছে। হাওরের ফসল রক্ষায় সরকার এবছর পানি উন্নয়ন বোর্ড এর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি করে ১৩২ কোটি টাকায় ৬৪০ কি.মি ফসল রক্ষা বাধ নির্মাণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একাধিকবার বক্তব্যে হাওরের ফসল যাতে ক্ষতির মুখে না পড়ে সেজন্য প্রশাসনকে দ্রুত ধান কেটে তোলার নির্দেশনা দিয়েছেন। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে দ্রুত ধান কাটার জন্য জেলায় কম্বাইন হার্ভেস্টর ও রিপার মিলিয়ে ৪৬৬টি যন্ত্র রয়েছে। তবে এ গুলো হাওরের নিচু অংশের জমির ধান কাটতে অক্ষম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন বলেন, ‘হাওরের ধান কাটতে শ্রমিক ও কৃষককে প্রতিদিনই উৎসাহিত করছি। মাইকিং করা হচ্ছে। ত্রাণের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। তাছাড়া এরই মধ্যে বাইরের জেলা থেকে অন্তত ২ হাজার শ্রমিক জেলায় প্রবেশ করেছে।’

মঙ্গলবার দুপুরে দেখার হাওরের কান্দায় ধানকাটারত কৃষক ও শ্রমিকদের সঙ্গে শরিক হন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন নাহার রুমা প্রমুখ।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ‘করোনাভাইরাস আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ছন্দপতন ঘটিয়েছে। জীবন পরিচালনা আরো কঠিন হয়েছে। আমাদের খাদ্য উদ্ধুত্ত জেলার হাওরে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু শ্রমিক সংকট কৃষকদের চিন্তায়ঢ ফেলে দিয়েছে। এই অবস্থায় কৃষকদের সাহস ও শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে হাওরে নেমে সংহতি প্রকাশ করেছি। হাওরের ধান তোলতে পারলে আমাদের কোন অভাব থাকবেনা।’

কৃষি মন্ত্রী ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এসব এলাকার জেলা প্রশাসক এবং কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, তারা ব্যবস্থা করবে। “তারা (শ্রমিকরা) কয়েকজনে মিলে যদি একটা গাড়ী ভাড়া করে তাহলে তাদের পরিবহন নির্বিঘ্ন করা হবে” বলেন মি. রাজ্জাক। করোনাভাইরাসের দিকটা বিবেচনা করে তিনি বলেন “সেসব এলাকার সিভিল সার্জন, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা তারা শ্রমিকদের পর্যবেক্ষণ করবেন। তাদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার যেসব লাগে সেসব কিছু দেবে”।