Logo

মশা দমনে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের নয়া উদ্যোগ !

অনিন্দ্য বাংলা
মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৩, ২০২১
  • শেয়ার করুন

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু :   কীটনাশক ও কয়েল ব্যাবহারে কোনভাবেই মশাকে বাগে আনা যাচ্ছে না। মশক নিয়ন্ত্রণে নাকাল সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলো। তাই এবার মশক নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন পদ্ধতি নিয়েছেন ডাইনামিক মেয়র ইকরামুল হক টিটু। কর্পোরেশনের ড্রেন, জলাশয়, পুকুরগুলোতে ব্যাঙ, গাপ্পি -খলিসা-দাড়কিনা মাছ ও হাঁস ছাড়ার একটি নয়া উদ্যোগ নিয়েছে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন কতৃপক্ষ ।

মঙ্গলবার দুপুরে নগরীর হরিকিশোর রায় রোড-মাকরজানি ড্রেনে জৈবিক পদ্ধতিতে মশাদমন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দুই হাজার ব্যাঙ অবমুক্ত করেন সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু।

কর্মসূচীর উদ্বোধনকালে মেয়র টিটু  ময়মনসিংহ মহানগরীকে পরিচ্ছন্ন মশামুক্ত নগরী গড়ার প্রত্যয়ে বলেন,  সারা পৃথিবীজুড়ে মশা নিয়ন্ত্রণ একটি কঠিন কাজে পরিণত হয়েছে। উচ্চমাত্রার কীটনাশক প্রয়োগ করেও মশা দমন করা যাচ্ছে না। যে হারে মশা বৃদ্ধি হচ্ছে  সিটি কর্পোরেশনের একক প্রচেষ্টায় তা কখনই  নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই মশা দমনে নাগরিকদের আরো সচেতনতা ও সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।

মেয়র আরো বলেন, পরিবেশ রক্ষায় রাসায়নিক কীটনাশক দিয়ে মশা দমন না করে বিকল্প পদ্ধতিতে মশা দমনের বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি। পরিবেশ বজায় রেখে যেসব পদ্ধতিতে মশা দমন করা যায়; পর্যায়ক্রমে আমরা সবগুলোই ব্যবহার করবো। এ বিষয়ে আমরা পরিকল্পিত কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আজেকর ব্যাঙ অবমুক্তকরণ কর্মসূচি তারই একটি।

এ নিয়ে সিটি কর্পোরেশন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, মশক নিধনে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দু’শো টি স্থান চিহ্ণিত করা হয়েছে, যেখানে মশার উপত্তিস্থল। সেসব স্থানে অবস্থানভেদে ব্যাঙ, গাপ্পি -খলিসা-দাড়কিনা মাছ ও হাঁস ছাড়া হবে।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী মোঃ আনোয়ার হোসেন, প্যানেল মেয়র-১ আসিফ হোসেন ডন, প্যানেল মেয়র-৩ শামীমা আক্তার, সচিব রাজীব কুমার সরকার, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ এইচ.কে. দেবনাথ, নগর পরিকল্পনাবীদ মানস বিশ্বাস, খাদ্য ও সেনিটেশন কর্মকর্তা দীপক মজুমদার, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোঃ আরিফুর রহমান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মহব্বত আলীসহ সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তা-কর্মচারিরা।

উল্লেখ্য যে, মশক দমনে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক-কীটনাশক ব্যবহারের বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিকভাবে মশা দমনের কথা ভাবছেন অনেকে। আধুনিক কীটতত্বত্তবিদরা মনে করেন, মশা দমনে প্রধানত ৪টি কার্যকর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথমটি হলো কীটনাশক ও ফ্রগারের মাধ্যমে, ২য়টি হলো জৈবিক পদ্ধতি ব্যবস্থাপনা, ৩য়টি হলো মশাতাড়ানো গাছ চাষ,  ৪টি হলো মশা দিয়ে মশা নিধন, জেনিটিক মডিফাইড মশা (জিএম মশা) ব্যবহার।

মশক নিয়ন্ত্রণে প্রথমেই পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের আশপাশের পরিবেশ বা জলাশয় পরিষ্কার ও দূষণমূক্ত রাখতে হবে। জলাবদ্ধতা দূর করে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। যেমন আবদ্ধ ড্রেন, ছাদ, ঘরের কোনা, ডাব, নারকেলের মালা, খেলনা, ট্রায়ার যেখানে এক সপ্তাহ ধরে পানি জমে থাকে এমন সব জিনিশপত্র ধ্বংস করতে হবে। নিজ নিজ বাসা-বাড়ী, আঙিনা নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। মশা যেখানে ডিম পড়ে, বিস্তার লাভ করে সেসব জায়গা ঝোপ-ঝাড় কেটে ফেলতে হবে। সেই সাথে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিল-ঝিল-ডোবা-নর্দমা পরিষ্কার করতে হবে। কারণ এসব স্থানেই মশা বেশি জন্মায়।

 জৈবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ : জৈবিক পদ্ধতিতে মশানিধন । এই পদ্ধতিতে মশা ও লার্ভাভূক প্রাণীর মাধ্যমে মশানিধন করা হয়। ব্যাঙ, গাপ্পি মাছ, খলিসা মাছ, দাড়কিনা মাছ, হাঁস, চামচিকা এসব প্রাণী মশার লার্ভা ও মশা খেয়ে থাকে। লার্ভা ধ্বংস হলে মশাও ধ্বংস। লার্ভাভুক প্রাণীর মাধ্যমে মশা নিধন পদ্ধতি মশকনিধনে যেমন কার্যকর পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

গাপ্পি ফিস, খলিশা মাছ, দাড়কিনা মাছ, ব্যাং, ড্রাগন ফ্লাই, হাঁস, চামচিকা এগুলোকে প্রকৃতিতে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণে পার্শ্ব বর্তী সফল দেশগুলোর (ভারত, ভিয়েতনাম) দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, সারা বছর ধরে বেশ কিছু জৈবিক (মশাভুক মাছ, ব্যাঙ) ও রাসায়নিক দমন পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছেন তারা।

ব্যাঙ-

ব্যাঙ মশা, মাছিসহ ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ খেয়ে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। একটি ব্যাঙ একদিনে প্রায় হাজার খানেক লার্ভা খেতে সক্ষম বলে অনেকে মনে করেন।

খলিসা, গাপ্পি ও দাড়কিনা মাছ-

বিদেশি মসকুইটো ফিশ বা গাপ্পির তুলনায় মশক লার্ভা ভক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশি জাতের খলিসা মাছ, দাড়কিনা মাছের দক্ষতা প্রায় দ্বিগুণ। খলিসা শুধু মশার লার্ভা ভক্ষণেই ভালো নয়, এটির ড্রেনের পানিতে অভিযোজন ও টিকে থাকার হারও ভালো। এসব মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন খুবই সহজ। তাই মশাপ্রবণ এলাকাগুলোর জলাশয় ও ড্রেনগুলোতে খলিশা মাছ চাষ করা যেতে পারে। 

মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য গাপ্পি মাছ অনেকটা কার্যকর বলে বিদেশী গবেষণায় ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে । আমাদের দেশে গাপ্পি মাছ নেই। দেশীয় দাড়কিনা মাছ অনেকটা গাপ্পি মাছের মত। এই মাছগুলো মশার লার্ভা খায়। তাই দাড়কিনা মাছ চাষের কথা অনেকেই বলছেন। কিন্তু সমস্যা একটাই মাছ সংরক্ষণ।  মাছগুলো যাতে হারিয়ে না যায় এজন্য সিটি করপোরেশনগুলো প্রতি বছর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মাছ উৎপাদন ও বড় করে শহরের বদ্ধ জলাগুলোতে প্রতি বছর দাড়কিনা মাছ ছেড়ে দিতে পারে। এতে এসব জলায় মশা ডিম ছাড়লে উৎপন্ন লার্ভা খেয়ে দেশি মাছগুলো মশা দমনে অনেকাংশে অবদান রাখবে। 

মশা বিরোধী গাছ-

এটা সবচেয়ে কার্যকর একটি মাধ্যম। আমাদের প্রকৃতিতে এমন অনেক গাছ আছে মশা যেগুলোর ধারে কাছেও যায় না। এসব গাছের ফুল, ফল নির্ষাস যেমন মশা তাড়ায় তেমনি এগুলো থেকে তৈরী হয় মশক নিধন ঔষধ। যেমন, নিম গাছ , মেরিগোল্ড বা গেন্ধাফুল গাছ, তুলসী গাছ, পুদিনা গাছ, লেভেন্ডার গাছ, রোজমেরী গাছ, লেবু গাছ, ইউক্যালিপটাস গাছ, রসুন গাছ। মশা দমনে মশকবিরোধী গাছ লাগানো সবচেয়ে কার্যকর ও সাশ্রয়ী। এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে তেমনি মশার উৎপাদনও কমে আসবে। চাইলে নিজ উদ্যোগে সবাই বাসা-বাড়ী, অফিস আদালত সহ  বারান্দা, ব্যালকনি, বাগান বা ছাদে এসব গাছ রোপন করতে পারেন।

নগরীতে নিজ দায়িত্বে তাদের আবাসস্থল, বাসাবাড়ীতে এসব গাছ রোপন করতে পারেন। পাশাপাশি সিটিকর্পোরেশ নিজেদের ব্যবস্থাপনায় এসব গাছ চাষ ও রোপন করতে পারেন।  এসব গাছ একাধারে যেমন সাশ্রয়ী, তেমনি মশা তাড়াতেও খুব কার্যকর।

বিকল্প মশা বা জিএম মশা :  

মশা নিধনে বিজ্ঞানীদের সফল আরেকটি পদ্ধতি হলো জেনেটিক্যালি মোডিফাইড বন্ধু মশা বা জিএম মশা। এই পদ্ধতিতে জিএম ইঞ্জিনিয়ারিং করে মশার কোষে জেনেটিক পরিবর্তন আনা হয়। যার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকতে পারে না। প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়া এই জিএম মশার সাথে নারী এডিস মশার প্রজননে যে সব মশার জন্ম হয় সে গুলো দ্রুতই মরে যায়। এতে কমে যায় এডিস মশা।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরীতে ১৬ বছরের গবেষণায় এ ধরনের মশা উৎপাদনে সফল হন বৃটেনের অক্সিটেক কোম্পানির বিজ্ঞানীরা। ব্রাজিলে এই পদ্ধতির সফলতা ছিলো ৯০ শতাংশ। এটা ব্যবহারে মাথাপিছু খরচ হয় প্রায় ৮৪৫ টাকা।

উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া : এডিস মশা নিধনে বিজ্ঞানীদের সফল পরীক্ষা এখনো বাস্তবায়ন হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া ও চীনসহ আশেপাশের দেশগুলোতে কাজে এসেছে অভিনব এই কৌশল। ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মশার গায়ে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার কিংবা মশা দিয়ে মশা মারার খরচও নাগালের মধ্যে।

এডিস মশা কামড় দিলেই হচ্ছে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু। আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া এডিস মশা এখন ছড়িয়ে পড়ছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায়। সেই সাথে মশার ঔষধের বিরুদ্ধে বেড়েছে এর প্রতিরোধ ক্ষমতা। মারাত্মক হয়ে ওঠা এই মশা নিধনের জন্য মাঠে নেমেছে বিজ্ঞানীরা।

প্রায় পনেরো বছরের গবেষণায় ওয়ার্ল্ড মাস্কিটও প্রোগ্রামের বিজ্ঞানীরা বের করেন উবাকিয়া নামের একটি পদ্ধতি। যেখানে ব্যবহার করা হয় উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন এই ব্যাকটেরিয়া থাকলে ডেঙ্গু ভাইরাস বাড়তে পারে না। উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া শরীরে থাকা মশার সাথে অন্য মশার প্রজননে যে মশা জন্ম নেয় তার দেহে থাকে একই ব্যাকটেরিয়া। এতে প্রতিরোধ হয় ডেঙ্গু সংক্রমণ।

সপ্তাহে একবার করে ১০ সপ্তাহ ধরে পরিবেশে এসব মশা ছাড়ায় কয়েক মাসে। এতে উবাকিয়া পদ্ধতি শতভাগ সাফল্য পায়। ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এই পরীক্ষার পর ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়াসহ ১২টি দেশেও মিলেছে সফলতা। অস্ট্রেলিয়ায় এই পদ্ধতিতে ডেঙ্গু দমনে অনেক খরচ হয়। জনপ্রতি প্রায় ১১০০ টাকা। তবে গণবসতি হওয়ায় ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ায় তা কমে দাঁড়ায় ২৫৩ টাকা।