Logo

মৃতুঞ্জয়ী মানবিক পুলিশ সুপার আ: আহাদ (ডিসি ডিবি ডিএমপি)

অনিন্দ্য বাংলা
শনিবার, জানুয়ারি ২, ২০২১
  • শেয়ার করুন

অনিন্দ্যবাংলা ডেস্ক : ১ জুলাই ২০১৬। রমজান মাস। রাত আনুমানিক পৌনে ন’টা। গুলশান হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্ট এন্ড বেকারিতে চলছে গোলাগুলি। এমন সংবাদে আনুমানিক পাঁচ মিনিটের মাথায় গুলশান থানার মোবাইল প্যাট্রোল টিম সেখানে পৌঁছে যায়। রেস্টুরেন্টের ভিতরে দেশি-বিদেশি অতিথিরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি। অস্ত্রধারীরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে অনবরত গুলিবর্ষণ করছে। ভীত সন্ত্রস্ত্র লোকজন দিকবিদিক ছুটছে । পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোঁড়ে ও এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে। কর্তব্যরত পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায় ।

ইফতার সেরে চা হাতে বসে দিনের কাজগুলো সারছিলেন এসপি আহাদ। হঠাৎ গুলশান থানার বেতার যন্ত্রে গোলাগুলির শব্দ শুনে কয়েক মিনিটের মধ্যে তৎকালীন ডিসি, গুলশান জনাব এস এম মোস্তাক আহমেদকে নিয়ে ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। সন্ত্রাসীরা যাতে পালাতে না পারে ডিসি’র নির্দেশে হলি আর্টিসানের চারদিক কর্ডন করেন এসপি আহাদ। অল্প সময়ের মধ্যেই তৎকালীন ডিজি র্যাব বর্তমান আইজিপি এবং পুলিশ কমিশনারসহ অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চলে আসেন ঘটনাস্হলে। আহাদ জীবন বাজি রেখে সাহসিকতার সাথে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও জিম্মিদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিরামহীন গুলি, গ্রেনেডের বিকট শব্দ, ধৌয়ার আধাঁর- এ যেনো এক রণভূমি। সব বাঁধা অতিক্রম করে হোটেলের ভিতরে ঢুকে দ্রত কয়েকজন জিম্মিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন এসপি আহাদ। ততক্ষণে সন্ত্রাসীদের অসংখ্য গুলি ও নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডের স্প্রিন্টারে গোয়েন্দা বিভাগের এসি রবিউল ইসলাম ও বনানী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ সালাহ উদ্দিন খান গুরুত্বর আহত হন।

নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এসপি আহাদ। আহত তিন কর্মকর্তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রবিউল ইসলাম ও মোঃ সালাহ উদ্দিন খানকে মৃত ঘোষণা করেন। ততক্ষণে এসপি আহাদের অবস্থাকে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। শরীরে ১০টি স্প্রিন্টারবিদ্ধসহ ডান পায়ের একটি নার্ভ মারাত্মক ভাবে ইনজুরী হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তার করা হয়। সেখানে হাসপাতাল চিকিৎসা বোর্ড স্প্রিন্টার অপারেশন এবং নার্ভ ইনজুরির উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর নেয়ার পরামর্শ দেন।

সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা শেষে শারিরীক অবস্থার উন্নতি ঘটলেও স্প্রিন্টার অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসকরা নার্ভ ইনজুরির প্রয়োজনীয় ঔষধসহ ফিজিওথেরাপী নেয়ার পরামর্শ দেন এসপি আহাদকে। এখনও দেহ থেকে সকল। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে অনেক দিন। বর্তমানে শরীরে গ্রেনেডের স্প্রিন্টার ও নার্ভ ইনজুরির যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন এসপি আহাদ। কিন্তু এই যন্ত্রণা তাকে বিমর্ষ করে না বরং মানুষের স্বার্থে, দেশের সুনাম ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার জন্য তার জীবন দিতেও তিনি সদা প্রস্তুত রয়েছেন।

মোঃ আব্দুল আহাদ। বাংলাদেশ পুলিশ (বিপি) নং ৭৯০ ৬১১ ২৯২২। ২১ আগস্ট ২০০৬ সালে সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের চাকরিতে যোগদান করেন। বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে দক্ষতা, সুনাম ও সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সেইসাথে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ এর এসি , এডিসি ও ডিসি হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন।

গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগে কাজ করার সময় সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে এ কর্মকর্তা ২০১৪ সালে পিপিএম সেবা) পদকের স্বীকৃতি অর্জন করেন। সাহসিকতা পেশাদারিত্ব ও কৃতিত্বের পরিচয় বহনকারী এ কর্মকর্তার দিক নির্দেশনা ও সার্বিক তত্তাবধানে গুলশান বিভাগের বিভিন্ন সোসাইটি ফরেন কমিউনিটির সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন, বিভিন্ন মামলা তদন্তে প্রকৃত রহস্য উদঘাটনেসহ সার্বিক নিরাপত্তায় ব্যাপক ভুমিকা রাখেন। ফলে আব্দুল আহাদ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হন এ চৌকস কর্মকর্তা।

মোঃ আব্দুল আহাদ। জন্ম দুই জানুয়ারী ১৯৭৯ সাল। নেত্রকোনার আটপাড়া খিলা গ্রামে। দাদা শেখ বড়মদি ছিলেন সংস্কৃতিমনা ও গ্রাম্য মাতব্বর। বাবা ব্যবসায়ী। মা মোসাম্মৎ রাবেয়া খাতুন একজন গৃহিনী। আট ভাই-বোনের মধ্যে আব্দুল আহাদ তৃতীয়,স্ত্রী উম্মে সালমা বি এ এলএলবি একজন কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারীনী, অবহেলিত নারীদের বিভিন্নভাবে সচেতন করার কাজে নিয়োজিত থাকেন সর্বদা। ব্যাক্তি জীবনে তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক।

আব্দুল আহাদ গ্রামের স্কুলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। সেখানে পঞ্চম শ্রেনিতে বৃত্তি নিয়ে আটপাড়া খিলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি প্রথম বিভাগে ষ্টার মার্ক সহ পাশ করে ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। ২০০১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হইতে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৫ সালে ২৬ তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জামালপুর বকশীগঞ্জের কেয়ামতুল্লাহ সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। নেশা তাঁর সরাসরি জন মানুষের সেবা করার। এ নেশায় তিনি আবার ২৫ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে সহকারি পুলিশ সুপার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হোন। পুলিশের ট্রেনিং শেষে প্রবেশনারি এএসপি ফরিদপুর, এএসপি হাইওয়ে পুলিশ, সহকারী কমিশনার ট্রাফিক পশ্চিম, ডিএমপি, এসি রমনা, এডিসি ডিবি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি পেশাগত দায়িত্বপালনের জন্য দেশী বিদেশী অনেক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি পরোপকারী ও সামাজিক উন্নয়ন ও কল্যাণ জনক কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি আটপাড়া সমিতি, নেত্রকোনা জেলা সমিতি, বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ কর্মজীবী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি ২৫ তম বিসিএস অলক্যাডার ফোরামের সাবেক সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বিসিএস অফিসার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কঙ্গো সাউথে অত্যন্ত সফলতা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তার এই সফলতায় তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পদকে ভূষিত হন। পুলিশ বাহিনীতে তার সততা ও পেশাদারিত্বের কারণে রাষ্ট্রপতি পদক পিপিএম(সেবা),২০১৪ এবং গুলশান হলি আর্টিজান জঙ্গী হামলাকারীদের প্রতিরোধে নিজের জীবন বাজি রেখে সাহসিকতা বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রপতি পদক সাহসিকতা,২০১৬ পদকে ভূষিত হন। এছাড়া পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে স্বীকৃতিস্বরূপ একাধিক পুরস্কার লাভ করেন।

তিনি ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে ভারত, নেপাল, ভুটান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সাউদ সুদান, কঙ্গো, সৌদি আরব ও আরব আমীরাত সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।

ছোটবেলা থেকেই আব্দুল আহাদের মনের কোণে সমাজের অনিয়ম, অস্থিরতা, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রবল ইচ্ছা কাজ করতো। সে কারণে স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় পুলিশ বাহিনীর মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় সাহসিকতার সাথে নিজেকে নিযুক্ত করেন।

মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার, এই শ্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশ পুলিশকে আরো গতিশীল, বেগবান ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।