Logo

লিভার নিয়ে যত কথা !

অনিন্দ্য বাংলা
শনিবার, জুন ২৬, ২০২১
  • শেয়ার করুন

মানব দেহের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হল লিভার বা যকৃত। শরীরকে সুস্থ্য ও সবল রাখতে সাধারনত লিভারকে অনেক কাজ করতে হয় যেমন খাদ্য হজম করতে, গ্লাইকোজেনের সঞ্চয়, প্লাজমা প্রোটিন সংশ্লেষণ, ঔষুধ বা অন্যান্য রাসায়নিক নির্বিষকরণ, পিত্তরস উৎপাদন, রক্ত পরিশোধন ইত্যাদি। উল্লেখিত কাজ ছাড়াও লিভার দেহের আরও কিছু জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। লিভারের নানা রোগে আমরা ভুগে থাকি। অনেকে আবার বুঝতেও পারেন না লিভারের কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা, আর হলেও কোন চিকিৎসকের কাছে যাবেন। সঠিক চিকিৎসা ও চিকিৎসকের শরনাপন্ন হবার অভাবে একটা বিশাল সংখ্যক রোগীই অকালে প্রান হারাচ্ছেন। তাই আসুন এই লেখাটি পড়ার মাধমে জেনে নেই লিভারের নানা রোগ সম্পর্কে ।

ফ্যাটি লিভার

লিভার কোষে অতিরিক্ত চর্বি জমা হলে যা তার গাঠনিক উপাদানের ৫ থেকে ১০ শতাংশ তাকে ফ্যাটি লিভার বলে। যখন কোনো মানুষ তার দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত চর্বি খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করে, তখন এ চর্বি ধীরে ধীরে তার কলা বা টিসুতে জমতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা মদ্যপানের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু যাঁরা মদ্যপানের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদেরও এই রোগ হতে পারে। সাধারণত মধ্যবয়সী মহিলাদের দেখা দেয়। স্থূলতা ফ্যাটি লিভারের একটি প্রধান কারণ। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি (হাইপার লিপিডেমিয়া), বংশগত, ওষুধ এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন, মদ বা অ্যালকোহল, স্টেরয়েড, টেট্রাসাইক্লিন এবং কার্বন টেট্রাক্লোরাইড ইত্যাদি কারণে ফ্যাটি লিভার হতে পারে। যাদের ওজন আদর্শ ওজনের ১০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি, তাদের ফ্যাটি লিভার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। মুটিয়ে গেলে শিশুদেরও এ রোগ হতে পারে। ফ্যাটি লিভার রোগের লক্ষণ রোগীরা সাধারণত ক্লান্তি, অবসাদ, ওপরের পেটের ডান দিকে ব্যথা নিয়ে ডাক্তারদের কাছে আসেন। পরীক্ষা করলে দেখা যায়, রোগীদের এসজিপিটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এদের বিলুরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, লিভারে অ্যানজাইমের মাত্রা স্বাভাবিক অথচ লিভারের আল্ট্রাসনোগ্রামে চর্বির মাত্রা বেশি। ফ্যাটি লিভার হলে করণীয় ও চিকিৎসা পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম, লিভার বায়োপসি পরীক্ষা করলে রোগটি নির্ণয় করা যায়। যদি লিভারের এনজাইমগুলো বেড়ে যায়, তখন বুঝতে হবে, তার ক্ষেত্রে এই ফ্যাটি লিভারের কারণে দীর্ঘমেয়াদি অসুখ হওয়া আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে রোগির জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করতে হবে, ওজন কমাতে হবে এবং কিছু ওষুধ খেতে হবে। আর যদি শুধু ফ্যাটি লিভার থাকে, পাশাপাশি লিভারের অন্যান্য কার্যক্রম যদি ভালো থাকে, যদি খুব বেশি স্থূলকায় না হোন, তাহলে শুধু একটু জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করলে হয়। সুষম খাবার, কায়িক পরিশ্রম, নিয়মিত ব্যায়াম—এগুলো করলে ভালো থাকবেন।

লিভার অ্যাবসেস

লিভার অ্যাবসেস বা লিভারের ফোঁড়া মানব দেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ একটি রোগ। লিভারে দুধরনের ফোঁড়া হয়, পায়োজেনিক ও অ্যামিবিক। ইকোলাই, স্টাফাইলোকক্কাই, স্ট্রেপ্টোকক্কাই, ক্লেবসিয়েলা ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া পায়োজেনিক লিভার অ্যাবসেসের জন্য দায়ী, আর অ্যামিবিক লিভার অ্যাবসেস হয় অ্যামিবা থেকে। তবে এসব জীবাণু ঠিক কী কারণে লিভারে ফোঁড়া তৈরি করে তা সব সময় জানা যায় না। তবে ডায়াবেটিস, অ্যাপেন্ডিসাইটিস, গ্যাস্ট্রোএন্টাররাইটিস, রক্তের ইনফেকশন, নবজাত শিশুর নাভির ইনফেকশন, অতিরিক্ত মদ্যপান, পেটে আঘাত পাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে লিভারে ফোঁড়া হতে পারে। একজন রোগীর লিভারে একটি বা একাধিক ফোঁড়া থাকতে পারে। লিভার অ্যাবসেস রোগের লক্ষণ লিভারের ফোঁড়ার কোনো বিশেষ লক্ষণ নেই। রোগীদের সাধারণত খাবারে অরুচি, জ্বর ও পেটে ব্যথা থাকে। অনেক সময় কাশি কিংবা ডান কাঁধে ব্যথা থাকতে পারে। বিরল ক্ষেত্রে রোগীর জন্ডিস হতে পারে। লিভার অ্যাবসেস হলে করণীয় ও চিকিৎসা লিভার অ্যাবসেসের জন্য মূল পরীক্ষা হলো পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগের শুরুতে আল্ট্রাসনোগ্রামে অ্যাবসেস ধরা পড়ে না। এ জন্য ৭ থেকে ১০ দিন পর আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপিট করলে ভালো। লিভার অ্যাবসেস সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকেই সেরে যায়। তবে লিভার থেকে পুঁজ বের করে দেয়াটা জরুরি। বিশেষ করে লিভারে যদি বড় বা একাধিক অ্যাবসেস থাকে। এক সময় এর জন্য অপারেশনের প্রয়োজন পড়লেও আজ আর তার দরকার পড়ে না। এখন লোকাল অ্যানেসথেসিয়া করে খুব অল্প খরচে আল্ট্রাসনোগ্রাফি গাইডেনসে লিভার থেকে পুঁজ বের করা সম্ভব। এরপর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে লিভারের ফোঁড়া সেরে যায়।

ভাইরাল হেপাটাইটিস

হেপাটাইটিস হলো লিভারে প্রদাহ, সাধারনত হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাস দ্ধারা স্বল্প মেয়াদী প্রদাহ কে ভাইরাল হেপাটাইটিস বলে। আমরা অনেকেই এই ধরনের রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে তাকে জন্ডিস বলি। দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ‘এ’ এবং ‘ই’ ভাইরাস ছড়ায় এবং স্বল্প মেয়াদী লিভার প্রদাহ করে থাকে। ভাইরাল হেপাটাইটিস এর লক্ষণ একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস বা স্বল্পমেয়াদী লিভার প্রদাহের প্রধান লক্ষণগুলো হলো— জন্ডিস, খাবারে অরুচি, উপরের পেটের ডান দিকে বা মাঝখানে ব্যথা, বমি বমি ভাব ও বমি, দুর্বলতা ও জ্বর। ভাইরাল হেপাটাইটিস হলে করণীয় রোগীকে হলুদ, মরিচ, তরিতরকারি, মাছ-মাংস ইত্যাদি স্বাভাবিক খাবার খেতে দিন। ফল, ডাবের পানি, আখের রস ইত্যাদি খাওয়াবেন না। ঘন ঘন গোসল করাবেন না। ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে যদি রোগের লক্ষণ ভালো না হয়, তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। রোগ ধরা পরার পর কেউ অস্থিরতা, অস্বাভাবিক আচরণ করলে বা অজ্ঞান হলে, এটা মারাত্মক জরুরি অবস্থা। তাকে অনতিবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

ক্রনিক হেপাটাইটিস

লিভারের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহের ফলে যেসব রোগ হয়ে থাকে তাকে ক্রনিক হেপাটাইটিস বলে। হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি ভাইরাস রক্ত কিংবা দূষিত সিরিঞ্জ বা সুচের মাধ্যমে ছড়ায়। তবে হেপাটাইটিস ই-ভাইরাস রক্তের মাধ্যমেও ছড়ায়। বাংলাদেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস। রোগী প্রাথমিক অবস্থায় বুঝতেই পারেন না কখন তিনি বি অথবা সি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসাবিহীন থাকলে এই সংক্রমণ মাসের পর মাস লিভার এর ক্ষতি করে। এমনকি লিভার সিরোসিসে রূপ নেয় এবং পরে লিভার ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে। উল্লেখ্য, হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাস আমাদের দেশে যথাক্রমে ৬০ ও ৩০ শতাংশ লিভার সিরোসিস এবং যথাক্রমে ৬৪ ও ১৭ শতাংশ হেপাটোসেলুলার কারসিনোমা বা লিভার ক্যান্সার এর জন্য দায়ী। ক্রনিক হেপাটাইটিসের লক্ষণসমূহ ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস তথা দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহে ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় লিভারের কোষে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। ফলে কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ পাওয়া যায় না। কারও কারও ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা ও পেটে হালকা ব্যথা অনুভূত হতে পারে। রোগের লক্ষণ দেখে পরীক্ষা ছাড়া বোঝার উপায় নেই কোন ভাইরাস হয়েছে। কিন্তু যাদের ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস থেকে লিভার সিরোসিস হয়ে যায় তাদের ক্ষুধামন্দা, পেটের অসুখ, শরীর শুকিয়ে যাওয়া, জন্ডিস, পেটে পানি আসা ও চেতনালোপ জাতীয় লক্ষণ দেখা দেয়। ক্রনিক হেপাটাইটিস হলে করণীয় ও চিকিৎসা এমতাবস্থায় অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পরিক্ষা করাতে হবে যে এই ভাইরাসের প্রাণ HBV DNA বা HBeAg রক্তে বহমান কিনা? এবং তা ছয় মাসের বেশি সময় ধরে পজেটিভ কিনা? ভাইরাসটা লিভারে সংক্রামিত হয়ে লিভারের ক্ষতি করে লিভার এনজায়েম ALT(SGPT) বাড়িয়ে দিয়েছে কিনা? যদি রোগীর রক্তে HBV DNA বা HBeAg ছয় মাসের বেশি সময় পরেও বিদ্যমান থাকে, রক্তে ALT (SGPT) দুই বা আড়াই গুণেরও বেশি থাকে তখন মানুষটি রোগী বলে বিবেচিত হবেন। কিন্তু ALT (SGPT) পরিমাণ যদি স্বাভাবিক থাকে, HBV DNA ও HBeAg নেগেটিভ থাকে তবে কিন্তু তিনি রোগী নন, HBsAg বহনকারী সুস্থ Carrier, তার চিকিৎসা অনাবশ্যক, তিনি এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাহীন এবং এর প্রতিষেধকও নিতে পারবেন না।

লিভার সিরোসিস

লিভার সিরোসিস একটি মারাত্মক ও অনিরাময়যোগ্য রোগ। তবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে লিভার সিরোসিস থেকে অনেকটা দূরে থাকা যায়। এতে যকৃৎ বা লিভারের কোষকলা এমনভাবে ধ্বংস হয়ে যায় যে তা সম্পূর্ণ বিকৃত ও অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং প্রদাহ এর কারণে লিভারে ফাইব্রোসিস এবং নুডিউল বা গুটি গুটি জিনিস তৈরি হয় ফলে লিভার এর যেসব স্বাভাবিক কাজ আছে, যেমন বিপাক ক্রিয়া, পুষ্টি উপাদান সঞ্চয়, ওষুধ ও নানা রাসায়নিকের শোষণ, রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ তৈরি ইত্যাদি কাজ ব্যাহত হয়। দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা। এ ছাড়া কিছু জন্মগত অসুখের কারণেও এই সমস্যা হয়ে থাকে যেমন, ওইলসন ডিজিজ, হেমোক্রোমেটাসিস ইত্যাদি। ধীরে ধীরে এই রোগ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। তাই সকলের আগে থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন। লিভার সিরোসিসের লক্ষণ প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়তে দেরি হয় তবে সাধারনত রক্তস্বল্পতা, রক্ত জমাট বাঁধার অস্বাভাবিকতা, যকৃতে বেশি পরিমাণে জৈব রসায়ন, বেশি বিলুরুবিন, কম সিরাম অ্যালবুমিন ইত্যাদি সমস্যা ধরা পড়তে পারে। সিরোসিস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম ও যকৃতের বায়োপসি করতে হয়। সাধারণত খাদ্যে অরুচি, ওজন হ্রাস, বমি ভাব বা বমি, বমি বা মলের সঙ্গে রক্তপাত, শরীরে পানি আসা ইত্যাদি হলো মূল উপসর্গ। পরে যকৃতের অকার্যকারিতার সঙ্গে কিডনির অকার্যকারিতা, রক্তবমি, রক্তে আমিষ ও লবণের অসামঞ্জস্য ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয়। লিভার সিরোসিস হলে করণীয় ও চিকিৎসা লিভার সিরোসিস চিকিৎসার মূল বিষয় হচ্ছে প্রতিরোধ। যেসব কারণে লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে, বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি-এর যেহেতু প্রতিশেধক আছে। তাই আমাদের উচিত প্রত্যেকেরই এই প্রতিশেধক নেওয়া। পাশাপাশি কিছু সচেতনতা জরুরি। দূষিত কোনো সূঁচ বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা, কোনো দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালন না করা পাশাপাশি সেলুনে সেভ করাসহ যেকোনো কাটাকাটি বা সেলাইয়ের সময় এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। রোগীদের কাছ থেকে সরাসরি এই ভাইরাস সংক্রমিত হয় না।

লিভার ক্যান্সার

ক্যান্সার মানেই তো আতঙ্ক আর তা যদি হয় লিভারের মত দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে তাহলেতো কথাই নেই। গবেষনায় প্রমানিত, এদেশে ক্যান্সারে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ লিভার ক্যান্সার। বিশ্বব্যাপি লিভার ক্যান্সারের মূল কারণ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস আর এ্যালকোহল। আমাদের দেশে অবশ্য হেপাটাইটিস বি আসল খলনায়ক, কারণ এদেশে প্রায় ৮০ লক্ষ লোক এ ভাইরাসের বাহক বা HBsAg পজেটিভ। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত ৫ থেকে ১০ শতাংশ লোক জীবনের কোন এক পর্যায়ে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ যে কোন বয়সের লোকই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। লিভার ক্যান্সারের ঝুকি পুরুষদের ক্ষেত্রে মহিলাদের চেয়ে ৪ থেকে ৬ গুণ বেশী। সাধারণতঃ ক্যান্সার হওয়ার আগে লিভারে সিরোসিস দেখা দেয়, তবে এর ব্যতিক্রম হওয়াটাও অস্বাভাবিক না। লিভার ক্যান্সারের রোগীরা প্রায়ই পেটের ডান পাশে উপরের দিকে অথবা বুকের ঠিক নীচে মাঝ বরাবর ব্যথা অনুভব করেন যার তীব্রতা রোগী ভেদে বিভিন্ন রকম। সহজেই ক্লান্ত হয়ে পরা, পেট ফাপা, ওজন কমে যাওয়া আর হালকা জ্বর জ্বর ভাব এ রোগের অন্যতম লক্ষণ। লিভার ক্যান্সার রোগীদের প্রায়ই জন্ডিস থাকে না, আর থাকলেও তা খুবই অল্প। রোগীদের খাওয়ায় অরুচি, অতিরিক্ত গ্যাস কিংবা কষা পায়খানার উপসর্গ থাকতে পারে- আবার কখনো দেখা দেয় ডায়রিয়া। পেটে পানি থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা ও করণীয় লিভার ক্যান্সার নির্ণয়ে সহজ উপায় একটি নির্ভরযোগ্য আল্ট্রাসনোগ্রাম। তবে কখনো কখনো সিটি-স্ক্যানেরও দরকার পরে। রক্তের AFP পরীক্ষাটি লিভার ক্যান্সারের একটি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য টিউমার মার্কার। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত যে কোন ব্যক্তিরই উচিত প্রতি ৬ মাসে একবার AFR ও আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করা। তবে লিভার ক্যান্সারের ডায়াগনোসিস কনফার্ম করতে হলে আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডেড FNAC অত্যন্ত জরুরি আর অভিজ্ঞ হাতের সাফল্যের হারও প্রায় শতভাগ। এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। শুরুতে ধরা পরলে আর আকারে ছোট থাকলে অপারেশনের মাধ্যমে এই টিউমার লিভার থেকে কেটে বাদ দেয়া যায়। আর এর জন্য প্রয়োজনীয় কুসা মেশিন ও দক্ষ হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন এদেশেই বিদ্যমান। পাশাপাশি আছে বিনা অপারেশনে টিউমার অ্যাবলেশন বা টিউমারকে পুরিয়ে দেয়া। নামমাত্র খরচে আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডে আমাদের দেশে এখন অহরহই লিভার ক্যান্সারের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন করা হয়। পাশাপাশি আল্ট্রাসনোগ্রাম গাইডে সস্তায় অ্যালকোহল দিয়েও অ্যাবলেশন বা টিউমার পুড়িয়ে ছোট করে দেয়া সম্ভব। আছে আরও কিছু আশা। যেমন এসেছে আগের চেয়ে অনেক বেশী কার্যকর, কিন্তু অনেক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কেমোথেরাপি জেলোডা ও সুরাফিনেব। এই দুটি ওষুধ আমাদের দেশে তৈরিও হচ্ছে। লিভার ক্যান্সারের রোগীদের চিকিৎসা এদেশে নিয়মিত হচ্ছে। আর তাই লিভারের ক্যান্সারে শেষ হয়নি আশা।

লিভারের ক্যান্সার বাংলাদেশে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। আর এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য পুরুষদের ক্ষেত্রে, যাদের বেলায় এটি তৃতীয় প্রধান ঘাতক ক্যান্সার। সাধারণত মানুষ ৫৫ থেকে ৬০ বছর বয়সে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। অথচ বাংলাদেশের বেলায় লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার গড় বয়স মাত্র ৩৫-৪৫ বছর। অর্থাৎ এদেশে একজন মানুষ তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতেই এই গুরুব্যাধিতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকেন।

আমাদের দেশে লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস। এদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় চল্লিশ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে ইনফেকটেড হয়েছেন। এদের অনেকেই ভবিষ্যতে লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন। কাজেই এটি খুবই স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত শতকরা প্রায় সত্তর জন রোগী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত।

হেপাটাইটিস বিএর পরে আছে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আর ফ্যাটি লিভার। প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ হেপাটইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত।

আর অন্যদিকে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের ‘ফ্যাটি লিভারের রাজধানী’। জন্মগতভাবে আমাদের এই উপমহাদেশের মানুষের লিভারে চর্বি জমার আশংকা বেশি। এমনকি শিশুরাও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। আর এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেদেশে ফ্যাটি লিভারের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি জীবন করে বিলাসবহুল, জীবিকা করে প্রতিযোগিতামূলক আর খাবারের অভ্যাসে আনে আমুল পরিবর্তন। সব মিলিয়ে আমাদের দেশে ফ্যাটি লিভার তাই ঘরে ঘরে।

লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা অবশ্য অন্যান্য ক্যান্সারের চিকিৎসার তুলনায় একবারেই আলাদা। প্রচলিত কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির এখানে কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। প্রাথমিক অবস্থায় অথবা ছোট লিভার ক্যান্সার অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করা সম্ভব। কিন্ত লিভার ক্যান্সারের বেশিরভাগ রোগী অনেক দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। কথাটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং পুরো ভারতবর্ষের জন্যই প্রযোজ্য। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব রোগীর লিভারে সিরোসিসের মতন মারাত্বক রোগ থাকে। ফলে অপারেশন করা সম্ভব হয় না। লিভারে ক্যান্সারের অবস্থান ও আকৃতিগত কারণেও অনেক সময় অপারেশন দুরুহ হয়ে পড়ে।

এই ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি এবলেশন (আরএফএ) আর ট্রান্স-আরটারিয়াল কেমো-এম্বোলাইজেশন (টেইস) অত্যন্ত কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। সুখের কথা, এ দুটি পদ্ধতিতেই লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা এখন আর বাংলাদেশে স্বপ্ন নয়, বরং সত্যি। এই দুই পদ্ধতিতেই ন্যূনতম কাটা-ছেঁড়ার প্রয়োজন নেই এবং প্রায় কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই এগুলো পুনরায় করা সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় বা ছোট টিউমারে এর যে কোনোটি, বিশেষ করে টেইস, করা গেলে লিভার ক্যান্সার অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। আর বড় টিউমারের ক্ষেত্রে রোগীরা অনেক দিন সুস্থ থাকেন।

আরএফএতে লিভার টিউমারের মধ্যে বৈদ্যুতিক তাপ তৈরি করে ক্যান্সার সেল ধ্বংস করা হয়। জাপানে প্রায় পনেরশটিরও বেশি সেন্টারে নিয়মিত আরএফএ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এখন এই চিকিৎসা করা হচ্ছে। ফলে এদেশের লিভার ক্যান্সারের রোগীরা এখন নিজ দেশে বসেই এই আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।

অন্যদিকে টেইসএ রক্তনালীর মাধ্যমে সরাসরি লিভার ক্যান্সারের টিউমারে কেমোথেরাপি ইনজেকশন দেওয়া হয়। এটি লিভার ক্যান্সার চিকিৎসার সর্বাধুনিক পদ্ধতি যেখানে ক্যাথল্যাবে লিভারের এনজিওগ্রাম করার প্রয়োজন পড়ে। গত বছর ভারতে প্রশিক্ষিত একদল তরুণ লিভার বিশেষজ্ঞ ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের মতো সফলভাবে টেইস সম্পাদন করেন। এরপর থেকে তারা নিয়মিত টেইস করে চলেছেন। তাদের সাফল্যের হার বর্তমানে প্রতিবেশি ভারতের যে কোনো এডভান্সড সেন্টারের সঙ্গে তুলনীয়। শুধু তাই নয়, খরচের দিক থেকেও তারা হার মানিয়েছেন এমনকি ভারতের সরকারি হাসপাতালের খরচও।

উল্লেখ্য, ভারতেও হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতালে টেইস করা হয়ে থাকে। লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় এই আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজির এক নতুন আঙ্গিনায় প্রবেশ করেছে।

বাংলাদেশের লিভার বিশেষজ্ঞরা এখন দেশেই বাংলাদেশের লিভার ক্যান্সার রোগীদের আরএফএ ও টেইসএর মতন অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করছেন যা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। আর তারা তা সম্ভব করেছেন পার্শ্ববর্তী ভারতের তুলনায়ও প্রায় অর্ধেক খরচে। আশা করা যায় এদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতেও এ চিকিৎসা শীঘ্র শুরু করা সম্ভব হবে। আর তাহলে এদশের আরও অনেক বেশি লিভার ক্যান্সারের রোগী আরও অনেক বেশি উপকার পাবে।

আশাজাগানিয়া নেতৃত্বে আজকের বাংলাদেশের নতুন নতুন যে বিস্ময়কর সব অর্জন, এদেশের চিকিৎসক সমাজও তার বাইরে নন। লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় এদেশে আরএফএ আর টেইসএর মতো আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সহজ প্রাপ্তি ও প্রয়োগ তাই-ই প্রমাণ করে।

ক্যান্সারের রোগী কতদিন বাঁচে?

ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ, এমনটা অনেকেই মনে করেন। আসলে সব ধরণের ক্যান্সার মারাত্নক না। তবে বেশিরভাগ ক্যান্সার মারাত্নক। তাই, কারো ক্যান্সার রোগ ধরা পরলে আত্বীয় স্বজন সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। আমি একজন প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। সাইটোপ্যাথলজি ও হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা করে আমি ক্যান্সার রোগ নির্ণয় করে থাকি। রোগী বা রোগীর আত্বীয় স্বজন পরীক্ষার রিপোর্ট নেয়ার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করে থাকে কী রোগ ধরা পড়লো। ক্যান্সার রোগের কথা শুনলে কেউ কেউ অনেকক্ষণ থ মেরে থাকে । তারপর জিজ্ঞেস করে “কোন স্ট্যাজে আছে?” অথবা “কতদিন বাঁচতে পারে?” অথবা “এর চিকিৎসা আছে কি?”

কতদিন বাঁচবে তা নির্ভর করে অনেক কিছুর উপর। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। ডাক্তার রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। চিকিৎসা করে দেখা গেছে অনেক রোগী ক্যান্সার থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। ক্যান্সারের ধরন, ক্যান্সার হবার স্থান, প্যাথলজিক্যাল গ্রেড, ক্লিনিক্যাল স্ট্যাজ, চিকিৎসার ধরন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে বলা যায় রোগীর পরিনতি কি হতে পারে। তবে কত দিন বাঁচবে এমন কথা কোন ডাক্তার বলেন না। তবে আমি গ্রামের আড্ডায় অনেক মুখরোচক গল্প শুনেছি এমন “আমার এক খালাতো ভাইয়ের ক্যান্সার হয়েছিল। ডাক্তার বলে দিয়েছিলো রোগী আর মাত্র ২৮ দিন বাঁচবে, যা খাওয়ার তাই খাওয়ায়ে দিন। কিন্তু রাখে আল্লাহ, মারে কে? রোগী কোন চিকিৎসা ছাড়াই ৫ বছর ধরে বেঁচে আছে।” শুনতে চমকপ্রদ মনে হলেও এমন আলাপ আমি বিশ্বাস করি না। তবে এমন আলাপই অনেকে শুনতে পছন্দ করে।

ক্যান্সার হলে রোগী কেনো মারা যায়? এর উত্তরে বলা যায় ক্যান্সার হলো শরীরের একটি পরগাছার মতো। শরীরের একটি সাভাবিক কোষ কোন কারনে কোনভাবে পরিবর্তন হয়ে ক্যান্সার কোষে রুপান্তর হয়। তারপর এগুলোর একটা থেকে দুইভাগ হয়ে দুইটা, চারটা, ষোলটা, চৌষট্টিটা, এইভাবে অসংখ্য কোষ তৈরি হয়ে টিউমার আকার ধারন করে। যে কারণে স্বাভাবিক কোষ ক্যান্সার কোষে রুপান্তর হয় সেই কারনটি উঠিয়ে নিলেও ক্যান্সার কোষ তার নিজস্ব ক্ষমতা বলে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঔষধ প্রয়োগ করে ক্যান্সার সেল মেরে ফেলা যায়। সাথে স্বাভাবিক কোষেরও মৃত্যু হতে পারে। ক্যান্সার কোষ বিভিন্ন পথে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে বাসা বাঁধতে থাকে। শরীরের পুষ্টিতে ভাগ বসায়। তাই, রোগী রুগ্ন  হতে থাকে। ক্যান্সার স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে রোগী রক্ত শুন্য হয়ে পড়ে। ক্যান্সার কোষ থেকে সাইটোকাইন নিঃসৃত হয়ে রোগীর ক্ষুধামান্দ ও সাভাবিক কোষের ক্ষতি করতে থাকে। রোগী শুকিয়ে যায়। ক্যান্সার স্থানে ঘা হয়ে পঁচে দিয়ে দুর্ঘন্ধ ছড়ায়। মাছি বসে ডিম দিয়ে পোকা ফেলে। লাংস, লিভার ও ব্রেইনে ছড়িয়ে পড়ে মৃত্যু তরান্বিত করে। মুখে ও খাদ্যনালীতে ক্যান্সার হলে  খাদ্য গিলতে না পেরে অনাহারে রোগী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পায়ু পথে ক্যান্সার হলে পায়খানা বন্ধ হয়ে রোগী মারা যায়।

প্যাথলজিক্যালি ক্যান্সার মূলত দু’রকম –  কারসিনোমা ও সারকোমা। চিকিৎসা না করালে সারকোমার রোগীরা তারাতারি মারা যায়। শরীরের বাইরের বা ভেতরের আবরনের কোষে ক্যান্সার হয়ে যদি আবরণেই সীমাবদ্ধ থাকে তবে তাকে কারসিনোমা ইন সিটো বলা হয়। যদি আবরনের সীমানা ভেদ করে নিচের স্তরে প্রবেশ করে তখন তাকে ইনভেসিভ কারসিনোমা বলে। ইনভেসিভ কারসিনোমা লসিকা ও রক্তনালি দিয়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে মেটাস্টাসিস বলা হয়। কার্সিনোমা ইন সিটো অবস্থায় ক্যান্সার ধরা পড়লে আবরণসহ ক্যান্সারের অংশটুকু ফেলে দিলে ক্যান্সার শরীর থেকে চলে যায়। অর্থাৎ কারসিনোমা রোগী মুক্তি  পেয়ে যায় ক্যান্সার থেকে। ইনভেসিভ কারসিনোমা কেটে ফেলে দিলেও সন্দেহ থেকে যায় ক্যান্সার কোষ মেটাস্টেসিস হয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা। ক্যান্সার ছড়াছড়ির উপর নির্ভর করে ক্লিনিসিয়ানগণ চারটি স্টেজে ভাগ করেন ১ থেকে ৪ পর্যন্ত। স্টেজ নাম্বার যতো বেশি হবে রোগীর পরিনতি ততো খারাপ হবে। কিছু কিছু ইনভেসিভ ক্যান্সার আছে সেগুলো মেটাস্টেসিস না হয়ে আশেপাশের টিস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকে। এগুলোকে লোকালি ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বলা হয়।

ক্যান্সার কোষ দেখে চিনতে পারেন প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ। শরীরের বিভিন্ন রকমের কোষ আছে যেগুলোকে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখে চেনা যায়। স্বাভাবিক কোষ ক্যান্সার কোষে রুপান্তর হলে অন্য রকম হয়ে যায় বা চেনা স্বাভাবিক কোষের মতো নয়। সাভাবিক কোষের কাছাকাছিও হতে পারে অথবা অচেনা চেহারারও হতে পারে। যতোই অচেনার দিকে যাবে তার উপর ভিত্তি করে প্যাথলজিস্টগণ গ্রেড নির্ণয় করে থাকেন ১ থেকে ৪ পর্যন্ত। গ্রেড ১ হলো স্বাভাবিক কোষের কাছাকাছি এবং গ্রেড ৪ হলো অচেনা বা সবচেয়ে বেশি ক্যান্সার কোষ থাকা। গ্রেড যতো বেশি হবে রোগীর পরিনতি ততো খারাপ হবে। তত তারাতাড়ি রোগ ছড়িয়ে পড়বে।

রোগ ধরা পড়ার পর চিকিৎসা দিলে এক রকম পরিনতি না দিলে আরেক রকম পরিনতি। যদি সম্ভব হয় ক্যান্সার অংশটুকু আশেপাশের কিছু ভালো অংশসহ অপারেশন করে ফেলে দেয়া হয়। এটাকে বলা হয় সার্জারি। রগে ইনজেকশন দিয়ে ও মুখে ঔষধ সেবন করে ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলা হয়। এটাকে বলা হয় কেমোথেরাপি। অনেকসময় সার্জারি করার আগে ক্যান্সার কোষগুলোকে আধমরা করার জন্য কেমোথেরাপি দিয়ে নেয়া হয়। সার্জারি করার উপযোগী না হলে সরাসরি কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। কোন কোন জাতের ক্যান্সার আছে রেডিওথেরাপি দিলে তারাতাড়ি ক্যান্সার কোষ মারা যায় এগুলোকে রেডিওসেন্সিটিভ ক্যান্সার বলা। এগুলো রেডিওথেরাপি দিয়ে নির্মূল করা যায়। কাজেই, যখন যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিতে হবে তখন সে পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারলে রোগী সেরে উঠবে, না পারলে পরিণতি খারাপের দিকে যাবে। সার্জনের দক্ষতার কমবেশি আছে। যার সার্জনের দক্ষতা ভালো তার পরিণতিও ভালো, না হলে খারাপ। শুধু সার্জনই না, প্যাথলজিস্ট তেমন দক্ষ না হলে ডায়াগনোসিস ও গ্রেড সঠিক হবে না। পরিণতিও ভালো হবে না। যিনি কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দেবেন তার দক্ষতার উপরও রোগীর পরিণতি নির্ভর করবে।

ঔষধের ধরনের উপরও চিকিৎসার ফলাফল নির্ভর করে। কেমোথেরাপির ঔষধ বিভিন্ন রকমের আছে। এদের কার্যকারিতাও কমবেশি হয়। ভালো ঔষধ খেলে তারাতাড়ি ভালো হবার সম্ভাবনা থাকে।

আমার কাছে ক্যান্সার ধরা পরার পর চিকিৎসাকালিন ফলোআপ দেয়ার সময় আমার কাছে অনেক রোগী এসে তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। আপনাদের জ্ঞাতার্থে তার থেকে দু’চারটি রোগীর কথা উল্লেখ করছি আপনাদের ধারণাটা আরও পরিস্কার হবার জন্য। আমার এক চিকিৎসক শিক্ষকের স্ত্রীর স্তনে ক্যান্সার হয়েছিল প্রায় ২৫ বছর আগে। আমি দু’বছর আগে স্যার থেকে জানতে পেলাম ম্যাডাম সম্পুর্ন ক্যান্সারমুক্ত সুস্থ্য আছেন। আমার এক আত্মীয়া জরায়ু মুখের ক্যান্সার ধরা পড়ে প্রায় ১৮ বছর আগে আমার কাছেই। গাইনিকোলজিস্ট ম্যাডাম পরীক্ষা করে বলেন সারা তল্ পেটে ক্যান্সার ছড়িয়ে লেগে লেগে আছে। অপারেশনযোগ্য না। তাকে রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি দিয়ে ভালো করা হয়। এখনো দিব্বি ভালো আছেন। আরেক আত্মীয়ের গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে প্রায় ১৫ বছর আগে। রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। সম্পূর্ণ ক্যান্সারমুক্ত জীবন যাপন করে গত বছর হার্ট এটাকে মারা গেছেন। একই সময় একই জায়গায় তার বেয়াই এর ক্যান্সার ধরা পড়ে। দেশী-বিদেশি বিভিন্ন ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা করেও অল্পদিনেই মারা যান তিনি। প্রায় চার বছর স্তন ক্যান্সার চিকিৎসা করছিলেন এক রোগী। তার স্বামীর ধারণা হয়েছিলো যে রোগী বাঁচানো আর সম্ভব না। রোগীর স্বামী ক্যান্সার চিকিৎসককে বললেন “ডাক্তার সাব, আমার স্ত্রী আর কতদিন বাঁচবে?” ডাক্তার উত্তর দিলেন “আপনার স্ত্রীর শরীরে ক্যান্সারের কোষ নাই বলেই আমি মনে করি। তিনি অন্য একজন সাভাবিক মানুষের মতই বেঁচে থাকবেন। ” শুনে লোকটি বললেন “কন কি ডাক্তার সাব, আমার আরেকটা বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আরেক মেয়ের সাথে। এখন উপায়?” এমন অনেক ঘটনা জানা আছে আমার। তবে আমি দেখেছি যারা চিকিৎসার প্রতি আস্থা হারিয়ে একবার এলোপ্যাথি, একবার হোমিওপ্যাথি, একবার কবিরাজি, একবার ফকিরি চিকিৎসা করান তারাই তারাতাড়ি মারা যান। সবার ক্ষেত্রেই সব ঔষধ কাজ করে না। রোগী মারা যাবার এটাও একটি কারন। এখনও কি প্রশ্ন করবেন “ক্যান্সার হলে রোগী কতদিন বাঁচে?”