Logo

সরকারের জমিতে স্থাপনা, ১৩ সেবা নিয়ে গড়ে উঠেছে মাল্টিপারপাস সেন্টার

অনিন্দ্য বাংলা
বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪
  • শেয়ার করুন

তামিম রায়হান: ভরা পূর্ণিমার চাঁদ ভেসে যায় দিগন্ত বিস্তারি জলধারায়। জল যেখানে জীবনের কথা কয়।জীবন বয়ে চলে জলের সাথে পাল্লা দিয়ে।বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের কুল ঘেঁষে সুরমা,কুশিয়ারা, জাদুকাটাসহ ছোট বড় আরো নানা নদ-নদীর উজান থেকে বয়ে আসা পলিমাটিতে গড়ে ওঠা এক সুপ্রাচীণ জনপদ সুনামগঞ্জ। হাওর-বাওর, নদী- নালা,খাল – বিলের সমারোহে বৈচিত্র্যময় এই জেলা। এই জেলার মোট ১২ টি উপজেলার একটি হলো বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা কমপ্লেক্সের অনতিদূরে হাওরের সড়কের পাশেই সরকারি খাস জমিতে গড়ে উঠেছে এই মাল্টিপারপাস সেন্টার। পাশেই হাওর, যাতে সবুজ রূপ দিয়েছে হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান। সবুজের পাশেই খাড়া হয়ে আছে নান্দনিক নির্মাণশৈলীর লাল রংয়ের একেকটা ভবন। সবগুলো ভবনেরই নির্মাণকাজ শেষ।

এক চত্বরেই রয়েছে নারী, শিশু, বেকার ও দর্শনার্থীদের জন্য নানা সেবা। রয়েছে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, শারিরীক ও মানসিক গঠন এবং চিত্তবিনোদনের সুযোগ। ৬০ ডেসিমেল জমির এই চত্বরে আছে কম্পিউটার ক্লাব ও ফ্রিল্যান্সিং সেন্টার, পাবলিক লাইব্রেরি ও ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ডিসপ্লে সেন্টার, শিশু একাডেমি, মিনি শিশু পার্ক, বিউটি পার্লার, জিমনেসিয়াম, সেলুন, রেস্টুরেন্ট, অ্যাম্পিথিয়েটার ও মার্কেট।

সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা বিশ্বম্ভরপুরে এতোসব সুযোগ ও সেবা নিয়ে গড়ে ওঠা এই অনন্য উদ্যোগের পোশাকি নাম ‘উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টার’।

সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা বিশ্বম্ভরপুরে এতোসব সুযোগ ও সেবা নিয়ে গড়ে ওঠা এই অনন্য উদ্যোগটি হলো ‘উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টার’। আর এটি নির্মাণ করছেন বিশ্বম্ভরপুরের উপজেলা সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আদলে এই মাল্টিপারপাস সেন্টারটি পরিচালিত হচ্ছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৫ জনের মাধ্যমে কম্পিউটার ক্লাব ও ফ্রিল্যান্সিং সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। এই সেন্টার পরিচালনার জন্য তাদের ক্ষুদ্র ঋণও দেওয়া হয়েছে।

উপজেলার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের পাঁচজন শিক্ষকের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে পাবলিক লাইব্রেরি ও ল্যাংগুয়েজ ক্লাব। লাইব্রেরির সদস্যপদ গ্রহণ করেও এখানে যে কেউ বই পড়ার সুযোগ পাবেন আর ন্যূনতম ফির মাধ্যমে ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ও বাংলা ভাষা শুদ্ধ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নেয়া যাবে।প্রদর্শনী কেন্দ্রে আছে উপজেলা নারী উদ্যোক্তাদের তৈরি পোষাক ও হস্তশিল্পের প্রদর্শনী। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা পরিচালনা করছেন বিউটি পার্লার। পার্লার পরিচালনার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে তাদের ক্ষুদ্রঋণও দেওয়া হয়েছে। এ দুটির তত্ত্বাবধানে রয়েছেন উপজেলার মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৪ জন তরুণকে দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে আধুনিক সেলুন।

শিশু একাডেমিতে শিশুদের সঙ্গীত, আবৃত্তি ও নৃত্যের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এটি পরিচালনা করবে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি। ইনডোর পার্কে রয়েছে শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইড। আর উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার তত্ত্বাবধানে একজন তরুণ উদ্যোক্তার মাধ্যমে পরিচালিত হবে জিমনেসিয়াম। মার্কেট ও রেস্টুরেন্ট পরিচালিত হবে অস্থায়ী চুক্তির ভিত্তিতে। মার্কেটে শিক্ষাসামগ্রী ছাড়াও পর্যটকদের জন্য সুনামগঞ্জের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিস পাওয়া যাবে। এছাড়া উন্মুক্ত মিনি অ্যাম্পিথিয়েটারে আয়োজন করা হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।

এই কমপ্লেক্সের নারী উদ্যোক্তাদের ডিসপ্লে সেন্টারের বিক্রয় কর্মী মিনহা আক্তার জানান, এখন ১০ জন উদ্যোক্তার তৈরি পণ্য এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা ও পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হবে।

তিনি বলেন, যেসব পণ্য এখানে রয়েছে সেগুলোর উদ্যোক্তাদের মোবাইল নাম্বার এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। কোন পণ্য গ্রাহকের পছন্দ হলে তিনি উদ্যোক্তার সাথে যোগাযোগ করে চাহিদামত পণ্য সংগ্রহ করতে পারবেন।

বিউটি পার্লারের একজন কর্মী বলেন, “রূপসজ্জার প্রশিক্ষণ নিলেও এতোদিন বেকার ছিলাম। কারণ এখানে কোন পার্লার নেই। এখানে আমার মত আরো কয়েকজন কাজের সুযোগ পেয়েছে।”

সাবেক ইউএনও জাদিদের প্রশংসা করে বিশ্বম্ভরপুরের দিগেন্দ্র বর্মন সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ বিমলাংশু রায় বলেন, “তিনি খুবই করিৎকর্মা ও সৃষ্টিশীল মানুষ। অনেক কাজ করছেন। সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণ এমন হন না। অনেকেই আসেন যান। কিন্তু তিনি অন্যরকম।”

ঘুরতে আসা দর্শনার্থী এহসান মমিন বলেন, এই জায়গায় আসলে মনে হয় ইউরোপের কোন জায়গায় আছি। অনেক ভালো লাগে আসলে। তাই সপ্তাহে দুই থেকে তিন বার আসা পরে এখানে।

 

থিয়েটার কর্মী বায়জিদ জানান নিজেকে একটু সময় দিতে এখনে আসা। জায়গাটা মনোমুগ্ধকর, লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ার পাশাপাশি হাওরের সুন্দর্য দেখতেই মূলত বার বার এখনে আসা হয়।

সমাজসেবী সংঘটন আমরা’র ফাউন্ডেশনের সহ সাধারণ সম্পাদক সালমান ফাহিদ জানান শহরের কাছেই এমন স্থান বার বার তাকে টানে। শহুরে জীবন থেকে মুক্তির আশায় নিজেকে একটু সময় দিতে তিনি প্রতিদিন এখানে আসেন। তিনি আরো বলেন বাংলাদেশের সব উপজেলায় এমন হওয়া উচিৎ।

২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টারের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী।

উপজেলা সুত্রে জানা যায় এই মাল্টিপারপাস সেন্টার নির্মাণে মোট ৮০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। টিআরসহ উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্প থেকে উদ্ধৃত টাকা, সংসদ সদস্যের বরাদ্দ ও স্থানীয়দের অনুদান থেকে এই ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন থেকে আরো জানানো হয়, এখানকার সবগুলো প্রতিষ্ঠানই ন্যূনতম ভাড়ায় স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এই ভাড়ার টাকার একটি অংশ এখানকার নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হবে। আরেকটি অংশ উপজেলা শিক্ষা ট্রাস্টে জমা হবে।

২০২০ সালে বিশ্বম্ভরপুরের ইউএনও হিসেবে যোগ দেন জাদিদ। এরপর থেকেই উপজেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও একে পর্যটক আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি।