Logo

২৩ নাবিকের ভয়ংকর ৩৩ দিন

রিংকন মন্ডল রিংকু
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
  • শেয়ার করুন

• প্রথমেই গানপয়েন্টে নেওয়া হয় জাহাজের মাস্টার-সেকেন্ড অফিসারকে
• পানি সাশ্রয়ে সপ্তাহে দুই দিন গোসল করতেন নাবিকরা
• পানি ছিঁটিয়ে জলদস্যুদের স্পিডবোট সরানোর চেষ্টা করা হয়
• জলদস্যুরা ব্রিজে আসার পর হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন ২৩ নাবিক
• জলদস্যুরা ভেবেছিল জাহাজের সবাই ভারতীয়
• ১৬ মার্চ থেকে রুটিন কাজ শুরু করেন নাবিকরা

১২ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টা। সোমালিয়া উপকূল থেকে বেশ দূর দিয়ে আরব আমিরাতের লক্ষ্যে ছুটছে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজের দীর্ঘযাত্রায় ক্লান্তি ভর করেছিল ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের চোখে। এর মধ্যেই কয়েকবার জাহাজের গতি ও দিক পরিবর্তনের বিষয়টি নজরে আসে তার। দ্রুততার সঙ্গে তিনি যখন পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন, তখনি জাহাজের বিপদ সংকেত সাইরেন বেঁজে ওঠে।

বিপদ আঁচ করতে পেরে যখন নাবিকরা জাহাজের সিটাডেলে (সুরক্ষিত কক্ষ) আশ্রয় নেওয়া চেষ্টা করছিলেন, তখনি মাইকে নির্দেশ আসে সবাইকে ব্রিজে যাওয়ার। ভয়ার্ত নাবিকরা জাহাজের ব্রিজে গিয়ে দেখেন এরই মধ্যেই জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ও সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরীকে গানপয়েন্টে নিয়েছে জলদস্যুরা।

‘জলদস্যুদের আসতে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম দিই এবং সবাই ব্রিজে চলে যায়। তখন ক্যাপ্টেন স্যার আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা সেখানে ছিলেন। এরপর আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি।’— এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খান

নিজেদের জিম্মিদশার শুরুর দিকের ঘটনা এভাবেই জাগো নিউজের কাছে বর্ণনা করেছিলেন এমভি আবদুল্লাহর ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) রাতে তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।

ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান বলেন, ‘দুইজন ছাড়া বাকি সবাইকে সিটাডেলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু দস্যুরা অতি দ্রুততার সঙ্গে জাহাজে উঠে সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে ফেলে। তখন আমরা সিটাডেলে না গিয়ে ব্রিজে চলে যাই। জলদস্যুরা তখন ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে। ঠিক ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, আর বেঁচে ফেরা হবে না, দেখা হবে না মায়ের মুখ।’

নাবিকের জিম্মিদশার ভয়ঙ্কর প্রথম কয়েক ঘণ্টার বিবরণ উঠে এসেছে এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ও প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খানের বর্ণনায়ও।

আতিক উল্লাহ খান বলেন, ‘গ্রিনিচ মান সময় ৭টা ৩০ মিনিট। এসময় একটা হাই স্পিডবোট (দ্রুতগতির স্পিডবোট) আমাদের দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম দিই। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে ছিলেন তখন। আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি। এরপর ওরা (জলদস্যুরা) চলে এলো।’

তিনি বলেন, ‘তারা ক্যাপ্টেন স্যার ও দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে ঘিরে ফেললো। আমাদের ডাকলো। আমরা সবাই এলাম। এসময় কিছুটা গোলাগুলি হয়। সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ব্রিজে বসে ছিল। তবে কারো গায়ে হাত দেয়নি।’

জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বলেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কেবিনে অফিসের কাজ সেরে ব্রিজে গিয়ে বসি। তখন জাহাজের তৃতীয় কর্মকর্তা জানান, জাহাজের ডান পাশে অনেক দূরে একটি ফিশিং বোট দেখা যাচ্ছে। ফিশিং বোটটি দেখেই ব্যবধান বাড়াতে এমভি আবদুল্লাহকে বাঁয়ে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বলি। এর মধ্যেই ওই ফিশিং বোট থেকে একটি স্পিডবোট সাগরে ভাসানো হয়। তখনই নিশ্চিত হই জলদস্যুরা আসছে।

তিনি আরও বলেন, স্পিডবোটটি কাছাকাছি চলে এলে ঢেউ সৃষ্টি করে পানি ছিঁটিয়ে দস্যুদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ডানে-বাঁয়ে জাহাজ ঘুরিয়ে গতি কমানোর চেষ্টা শুরু করা হয় স্পিডবোটটির। কিন্তু ততক্ষণে জলদস্যুদের কয়েকজন জাহাজে উঠে যায়। প্রথমেই তারা জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে মাস্টারকে (আমাকে) খুঁজতে থাকে। প্রাণহানির শঙ্কায় আমি হাত তুলে জলস্যুদের ধরা দিই। এসময় বাকি নাবিকদের সিটাডেলে যাওয়া বন্ধ করে ব্রিজে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়।

১২ এপ্রিল শনিবার বিকেলে মুক্তিপণের অর্থ পায় দস্যুরা। পরে ওইদিন গভীর রাতে দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। যে মুহূর্তটা ছিল নাবিকদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের। তখনই নোঙর তোলা হয় এমভি আবদুল্লাহর। নতুন জীবন নিয়ে ২৩ নাবিক যাত্রা করেন আরব আমিরাতের পথে।