Logo

জীবনের দাম দশ টাকা!

অনিন্দ্য বাংলা
মঙ্গলবার, এপ্রিল ২, ২০২৪
  • শেয়ার করুন

তাওহীদ তুহিন: পানির অপর নাম জীবন। এই স্বচ্ছ ও বর্ণহীন পদার্থটি ছাড়া প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজের জন্যও আমাদের পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন। কিন্তু সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে মানুষের প্রয়োজন নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি। আমাদের ব্যস্ত জীবনে, বিশেষ করে শহুরে জীবনে আমরা বোতলজাত পানি বা জার পানির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। দেশে বছরে অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ কোটি লিটার বোতলজাত পানি বিক্রি হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। দুই শর বেশি কম্পানিকে খাবার পানি বাজারজাত করার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এর মধ্যে অন্তত ৪৫টি কম্পানি দেশজুড়ে বোতলজাত পানি সরবরাহ করছে। এসব কম্পানির ৩৫টি রাজধানীকেন্দ্রিক। এই কম্পানিগুলো সাধারণত আধালিটার, এক লিটার, দুই লিটার ও পাঁচ লিটারের বোতল বাজারজাত করে। অন্য অন্তত দেড় শ কম্পানি বড় জারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহ করে। রাজধানীর বাজারে দেখা গেছে, অন্তত আটটি গ্রুপ তাদের পানি বাজারজাত করছে। এর মধ্যে কোকোলার ‘কিনলে’, পেপসিকোর ‘অ্যাকুয়াফিনা’, পারটেক্সের ‘মাম’, মেঘনা গ্রপের ‘ফ্রেশ’, আকিজ গ্রুপের ‘রিভেরা’ ও ‘স্পা’, প্রাণ গ্রুপের ‘প্রাণ ড্রিংকিং ওয়াটার ও সিটি গ্রুপের ‘জীবন’। এর বাইরে বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মৈত্রী শিল্প প্লান্টে উৎপাদন হচ্ছে ‘মুক্তা’ পানি। এই পানির বেশির ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়। আর ঢাকা ওয়াসা উৎপাদন করে ‘শান্তি’ পানি। তবে খুচরা বাজারে এ দুটি পানি দেখা যায়নি। আমরা যারা প্রতিনিয়ত এসব বোতলজাত খাবার পানি খেয়ে যাচ্ছি, কখনো কি ভেবেছি এই পানি কতটা নিরাপদ? এসব বোতলজাত খাবার পানি পান করে আমরা আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছি না তো? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ও সাধারণ জনগণকে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি ব্যবহারে সচেতন করতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। বিএআরসিএ গবেষণার জন্য দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলা শহর থেকে বোতল ও জারের পানির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। জার পানির ক্ষেত্রে ঢাকার ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, চকবাজার, সদরঘাট, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, আমিনপুর, আশুলিয়া ও সাভার এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। এ ছাড়া ৩৫টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানির নমুনা ও বিদেশি ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানির মান নির্ণয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তারা এ গবেষণা করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব বোতলজাত ও জারের পানিতে আছে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া যেমন ই-কলি (Escherichia coli)। এই ব্যাকটেরিয়া থেকে হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, বমিভাব, পেটব্যথা, জ্বর-ঠান্ডা। এ ছাড়া এটি আস্তে আস্তে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, ১০০ মিলি জার পানির নমুনায় ১ থেকে ১৬০০ এমপিএনের বেশি ই-কলি পাওয়া গেছে, যেখানে বিএসটিআইয়ের মান অনুযায়ী শূন্য ই-কলি থাকা উচিত। গবেষণায় বিএআরসি ব্র্যান্ড বোতল ও জার পানির বিভিন্ন উপাদানগুলোর পরিমাণগত ও গুণগত মান বিশ্লেষণ করে তার ফল প্রকাশ করেছে। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, খাবার পানিতে বিভিন্ন সাধারণ উপাদান যেমন টিডিএস (খনিজ উপাদান, লবণ, মেটাল, আয়ন ইত্যাদি), ক্লোরাইড, কলিফরম, ফ্যেকাল কলিফরম, পিএইচ, নাইট্রাইট, নাইট্রেট, লিড, ক্রোমিয়াম, আয়রন ইত্যাদি কী পরিমাণে থাকা উচিত এবং ব্র্যান্ড বোতলজাত পানি ও জার পানিতে তা কী পরিমাণে আছে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ব্র্যান্ড বোতলজাত পানি বিডিএস মান অনুসরণ করতে চেষ্টা করলেও তা যথাযথ নয়। বোতলের গায়ে কলিফরম বা ফ্যেকাল কলিফরমের কোনো উল্লেখ থাকে না। অন্যদিকে জার পানি কোনো গুণগত মানই বজায় রাখে না। সিটি গ্রুপের পানির ব্র্যান্ডের নাম ‘জীবন’। ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বোতলজাত পানির দাম এখনো বাড়েনি। তবে সবকিছুর উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বিদ্যুতের খরচ প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। এর সঙ্গে গাড়ি ভাড়া, পেট্রল, পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়ার কারণে বোতলের কস্টিংও বেড়ে গেছে। জীবন ২৫০ মিলি পানির বোতলের দাম ১০ টাকা, আধা লিটার পানি ২০ টাকা। মূলত প্রয়াত শিল্পপতি এম এ হাসেমের হাত ধরেই এ দেশে বোতলজাত পানির ব্যবসা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর প্রতিষ্ঠানের ‘মাম’ বোতলের পানি এখনো বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়। ১৯৯০ সালে বোতলজাত পানির বাণিজ্য শুরু হয়। ওই সময় বোতলজাত পানি পান ছিল আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ। সুপেয় পানি সহজলভ্য থাকায় বোতলজাত পানির প্রতি মানুষের ততটা আগ্রহও ছিল না। তিন দশকের ব্যবধানে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে ময়লা, আর্সেনিক দূষণ, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, ভূ-উপরিস্থ পানিদূষণ ইত্যাদি কারণে সুপেয় পানির অভাব দেখা দিলে ‘বিশুদ্ধ’ বোতলজাত পানির প্রতি মানুষের আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এই আগ্রহ বর্তমানে এতটাই বেড়েছে যে ঘর থেকে বের হলে সুস্থতার কথা বিবেচনায় সবার আগে সবাই নিরাপদ হিসেবে বোতলজাত পানি বেছে নেয়।