Logo

ফুলের কথা গাছের কথা

অনিন্দ্য বাংলা
বুধবার, মার্চ ২৭, ২০২৪
  • শেয়ার করুন

রবিউল ইসলাম:
বসন্ত রাঙ্গানো #বাসন্তি_ফুল
২০১৪ সালের ১ মার্চের দুপুর। ময়মনসিংহ-টাংগাইল সড়ক ধরে বেশ কয়েকবার চলাফেরা করতে হয়েছিল। কাচিঝুলি এলাকার বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনের উদ্যানের ভিতরে গাছ-গাছালির ফাক ফোকর গলে হলুদ রঙ্গের থোকা থোকা কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে। কৌতুহল মেটাতে এগিয়ে যেতেই চক্ষু চড়কগাছ—!!
একটি পাতাও নেই দশ-বার ফুট উচ্চতার এমন একটি গাছের ডালে-ডালে থোকা-থোকা হলুদ রঙ্গের ফুলে ভরে রয়েছে। এখানকার কয়েকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও মালির সাথে কথা বলেও এর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা গেল না।
মালির সাথে কথা বলে জানা যায় এই ফুল ফোটে প্রত্যেক বসন্তে একবার। ৫-৬ দিন থেকে ঝরে যায়। বীজ হয়না। চারা কিভাবে হয় তার সঠিক তথ্য তিনি আমাকে বলতে পারেন নি। জিজ্ঞেস করে জানা গেল আজ এই ফুল ফোটার তৃতীয় দিন চলছে।
আমি গাছ,ফুল,প্রকৃতি ভালবাসি। আমি জানিনা এই ফুলের আরো কোন নাম রয়েছে কিনা। তবে এই ফুলটিকে দেখে আমার কেবলই বাসন্তি নামে ডাকতে ইচ্ছে করছে।
এরপরে ফুল থাকা অবস্থায় প্রতিদিনই আমি একবার করে গাছের কাছে গিয়েছি এবং এর পরিবর্তন গুলো লক্ষ্য করেছি। গাছটির উপরে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলেছি। ফুল ছাড়াও বছরের প্রতি ঋতুতেই কাছে গিয়ে নতুন কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তা নোট করেছি।
২০১৫ সালের ১ মার্চ আবারো এই গাছে থোকা থোকা ফুল চোখে পড়েছে। এবারো গাছের কাছে গিয়ে বন বিভাগের কর্মকর্তা,কর্মচারীদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে অনেককে এর সম্পর্কে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছি। উদ্দেশ্য নতুন কোন তথ্য পাওয়া।
এই অফিসে বদলি হয়ে আসা অফিস সহকারি ও মালি ইফতেখার হোসেন এবার কিছু নতুন তথ্য দিলেন। জানালেন এটি মূলত বিদেশি ফুল। নাম ট্যাটেবাবু বা এমন কিছু একটা। কিন্তু তিনি শতভাগ নিশ্চিত নন।
আমি আন্দাজ করে কাছাকাছি বিভিন্ন নাম লিখে গুগলে সার্চ করে বেশ কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করে অবশেষে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি যে এর বৈজ্ঞানিক নাম #ট্যাবেবুঁইয়া (#Tabebuia #serratifolia)। ইংরেজি নাম: #Yellow #Lapacho. ট্যাবেবুঁইয়া হচ্ছে #bignoniasi পরিবারের একটি উদ্ভিদ। এটি মুলত ব্রাজিলের একটা গাছ।
পরে একদিন আমি বাংলাদেশের খ্যাতিমান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা দাদার কাছে জানতে চেয়েছি এর বাংলা নাম বাসন্তি রাখা যথার্থ হবে কিনা–?
উনি আমাকে জানিয়েছেন– “বাসন্তি নামে প্রতিষ্ঠিত একক দাবিদার কোন ফুল আমাদের দেশে নাই। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসন্তকালে ফোটে,দেখতে হলুদ এমন অসংখ্য ফুলকে মানুষ বাসন্তি নামে ডাকে। আপনি যদি এমন নাম বাসন্তি দিতে চান তবে দিতে পারেন–” দ্বিজেন দাদার সাহস পেয়ে এর নাম বাসন্তিই রেখে দিলাম।
ব্যক্তিগতভাবে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে এদের ফুল ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ফোটে। ফুলের কুড়ি আসার ঠিক আগেরদিন সব পুরনো পাতা ঝরে যায়। একদিনের মধ্যেই কুড়ি গুলো পূর্নাঙ্গ ভাবে ফুটন্ত ফুলে পরিনত হয়। গাছের দিকে তাকালে চোখে পড়বে শুধুই ফুল আর ফুল। বছরের অন্যান্য সময়ে গাছে সবুজ পাতায় আচ্ছন্ন থাকে। এর পাতা খসখসে।
২০১৭ সালের ২ মার্চ। এই বছর আবার বাসন্তির ফুল চোখে পড়েছে। মালির কাছে গিয়ে জানলাম আজ ফুল ফোটার তৃতীয় দিন। প্রথম ও দ্বিতীয় দিন আমি ঢাকাতে বইমেলায় থাকায় দেখতে পারিনি। গতকাল সকালেই চোখে পড়েছে। অথচ ঢাকায় যাবার আগের দিন ২৭ ফেব্রুয়ারিও কোন ফুল ছিল না। দুর থেকে কিছু পাতা দেখেছি।
বুঝতে পারছিলাম ফুল ফোটার সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু তা এত দ্রুত হয়ে যাবে বুঝতে পারলে আমি ঢাকাতেই যেতাম না। গত তিন বছর ধরে এই গাছটি নিয়ে আমার আগ্রহ,কৌতুহলের শেষ নেই।
গত বছর (২০১৬ সালে) ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বৃষ্টি হবার ফলে এই গাছের ফুল ফোটা এক মাসের বেশি পিছিয়ে যায়। তাই এর ফুল ফোটে এপ্রিলের ৫-৬ তারিখে। বৃষ্টির প্রভাবে ফুলের পরিমানও বেশ কম ছিল। এই গাছের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ও কিছু পরিবর্তন ঘটে। সাধারনত আমি যা দেখে এসেছি যে ফুলদানের সময় এই গাছে একটি পাতাও থাকেনা। কিন্তু বৃষ্টির কারনে গত বছর ফুলের সময়েও কিছু নতুন কুশি ছিল। কয়েকটি পুরনো পাতাও ছিল।
ফুল ফোটার সময়কে পর্যবেক্ষনে রেখে দেখেছি প্রথম দুই বছর ও এই বছরে ফেব্রুয়ারির ঠিক ২৭ তারিখেই ফুলের কলি এসেছিল। শুধু গত বছরে ফেব্রুয়ারির মাঝা-মাঝি সময়ে বৃষ্টি হয়েছিল বলে এর প্রভাবে ফুল ফুটতে দেরি হয়েছিল।
কলি আসার পরের দিনে অল্প পরিমানে (২৫-৩০%) ফুল ফোটে। দ্বিতীয় দিনে ৭০-৮০%, তৃতীয় দিনে এসে ৯৫%–৯৮% ফুল ফোটে। তৃতীয় ও চতুর্থ দিনে মোটামুটি ভরপুর সুন্দর লাগে। পঞ্চম দিনে এসে কিছু ফুল ঝরতে শুরু করে। ষষ্ঠ দিনে এসে বেলা তিনটা থেকে শুরু করে রাতের মধ্যে ৯৭-৯৮% ফুল ঝরে যায়।
আলাদা ভাবে একেকটি ফুল দেখতে ফানেলের মত। ফুলের গোড়া একসাথে একই ঝোপায় গুচ্ছাকারে সাজানো থাকে। একেকটি ঝোপায় ২০-৩০টি ফুল একই বোটায় সংযুক্ত থাকে। দুর থেকে অনেকের কাছে কাগজের তৈরি খেলনা ফুলের মত মনে হতে পারে। ফুলে কোন গন্ধ নেই।
ফুল ঝরে যাবার পরের ১২-২৪ ঘন্টার মধ্যে এর নতুন পাতা বের হয়ে দেড় থেকে দুই বা আড়াই ইঞ্চি লম্বা হয়ে যায় এবং পুরোপুরি সবুজে ছেয়ে যায়।
তখন বিশ্বাস করাই কঠিন হয় যে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেও এই গাছটি ফুলে ভরপুর ছিল।
বাংলাদেশে ঢাকার মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন এ ইফতেখার ২০০৮-০৯ সালের দিকে একটি গাছ দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। তবে এখন আর আছে কিনা নিশ্চিত নন। এছাড়া সাভারে সাভার ডেন্ড্রোরিয়ামে এই গাছ আছে বলে কয়েক বছর আগে শোনা গেছে।
গত বছর সাভারের এক বন্ধুকে অনুরোধ করেছিলাম খোজ নিয়ে জানাতে। সে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এই রকম কোন গাছ থাকার তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের আর কোথাও এই গাছটির অস্তিত্ব আছে কিনা সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি।
ছবিতে দেখা গাছটি রয়েছে ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ের বাগানে (শিল্পকলা একাডেমির বিপরীতে, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কে)।
এই গাছটির বেড়,কাঠ,কান্ড,গাছের ছাল পর্যবেক্ষণ করে আনুমানিক বয়স ১০-১৩ বছর হতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে। উচ্চতা আনুমানিক ১০-১৫ ফুট হতে পারে। ১৪ সালে প্রথম যখন দেখি তখন শুনেছিলাম ৩/৪ বছর আগে থেকেই নাকি ফুল হচ্ছিল।
সেই হিসেবে চারা লাগানোর ৭-৮ বছর পর থেকে ফুল হবার কথা।
এখানকার প্রবীণ একজন কর্মচারীর কাছে আরো কয়েক বছর পরে জানতে পারি ২০০২ সালের দিকে এখানকার একজন কর্মকর্তা বিদেশ সফর থেকে ফেরার সময় এই চারাটি নিয়ে এসে এখানে রোপন করেন। আমার পুর্বে করা ধারণা আর নতুন পাওয়া তথ্য অনেকটা মিলে গিয়েছে। নিশ্চিত হতে আমার ৪-৫ বছর লেগেছে।
এই গাছটি অবহেলা, অযত্নেই পড়ে রয়েছে। এর জন্য বাড়তি কোন পরিচর্যাও কেউ নেয় না। এটি যে অত্যন্ত বিরল একটি গাছ সেই ব্যাপারেও এখানকার কারোরই তেমন কোন ধারনা নেই। এই গাছটি সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ জ্ঞান অর্জন ও এর দিকে বাড়তি মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি। এখানকার বেশ কয়েকজনকে এই গাছটি যেন কোন ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছি।
আজ শুক্রবার ৩ মার্চ ২০১৭ ফুল ফোটার চতুর্থ দিন। আমার ধারনা আজ বিকেলের পর থেকে এর সৌন্দর্য কিছুটা ম্লান হতে শুরু করবে। ফলে কেউ যদি দেখতে যেতে চান তবে দেখে আসতে পারেন। তবে ভুলেও গাছে ঝাঁকুনি দিবেন না। ফুল,পাতা বা ডাল ছিড়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন না।
কারন এর ফুলের বোটা অত্যন্ত নাজুক। হালকা ঝাঁকুনিতেই ফুল ঝরে এর সৌন্দর্যহানী ঘটবে। গাছে উঠার চেষ্টাও করবেন না। কারন গাছটি অত্যন্ত ছোট। কোন ভর নিতে পারবেনা। উঠতে গেলে গাছ ও এর ডালপালা ভেঙ্গে যাবার আশংকা থাকবে।
আমার কাছে এই ফুলের গাছ এবং এর সৌন্দর্য খুবই পছন্দ হয়েছে। কোন একটি রাস্তা,নদী,পুকুরের ধারে, পার্কে, বা অফিসের সামনে যদি সারি করে ২০-৫০ টি বাসন্তি ফুলের গাছ রোপন করা যায় তবে ফুল ফোটার পর অনেক সুন্দর লাগবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
আমার খুব ইচ্ছে এর চারা করার। ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন সড়কের সড়ক বিভাজকের মাঝে যদি সারি করে এমন ৫০-১০০ গাছের চারা রোপণ করা যায় তবে ফুল ফুটলে মনোমুগ্ধকর একটা দৃশ্য হবে।
এছাড়া যে কোন শহরে, রাস্তার ধারে, বাগানে, বাসন্তি বাগান বা লেন করা গেলেও সৌন্দর্যপ্রেমি বা ফুলপ্রেমি পর্যটকদের জন্য ব্যাপক আকর্শনীয় হয়ে উঠবে।
আমি উদ্যোগ নিয়েছি এই গাছের চারা তৈরি করার। কিন্তু কিভাবে এর চারা হয় তার কোন তথ্য কেউ বলতে পারছেনা। গত ৩-৪ বছরেও এই গাছে কোন বীজ আবিস্কার করতে পারিনি। গত এক বছরে কয়েকবার ডালে কলম লাগিয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু কলম তৈরির চেষ্টা সফল হয়নি। কলমে শিকড় আসেনি। এবার অন্যান্য চেষ্টা করা হবে। আমি অবশ্য গাছটির কোন ক্ষতি না করে সব রকম চেস্টাই করবো। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়–