Logo

ভূমি চলে পরের ভরে,কর্মকর্তারা অতিথি পাখির মতো

রিংকন মন্ডল রিংকু
মঙ্গলবার, মার্চ ২৬, ২০২৪
  • শেয়ার করুন

এসি (ল্যান্ড) বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) খুব পরিচিত পদ। শাসনক্ষমতা বা ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ারের কারণে পদটি চাকরি প্রার্থীদের কাছে লোভনীয়। আমজনতার কাছে ক্ষমতার ‘চূড়ায়’ অবস্থান করেন এ কর্মকর্তা। অথচ ভূমি ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কর্মকর্তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের কেউ নন।

এসিল্যান্ডের বেতন-ভাতা হয় ভূমি সংস্কার বোর্ড থেকে। কিন্তু বোর্ডে তার জবাবদিহি নেই। তিনি জবাবদিহি করেন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে।

একজন এসিল্যান্ড জানান, ‘আমার কাছে তো ল্যান্ডের কাজ সেকেন্ডারি হয়ে যায়। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেসি আমাদের কাছে থাকায় তা নিয়ে অনেক সময় দিতে হয়। বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে বা ডিসি অফিসে হরদম যেতে হয়। দেখা গেল ভূমি নিয়ে এক দিনে ১৫টি মামলার শুনানির তারিখ দিয়েছি। ধরা যাক, দিনাজপুরে আমার কর্মস্থল। আমি সেখানে শুনানি নিই। ঢাকা থেকে গিয়ে অনেকে শুনানিতে অংশ নেন। কিন্তু প্রশাসনিক দায়িত্বের কারণে অনেক সময় শুনানি ফেলে রেখে চলে যেতে হয় অন্য কাজে।’

শুধু এসিল্যান্ডই নন, ভূমি ব্যবস্থাপনার সাব-রেজিস্ট্রার, জেলা রেজিস্ট্রারও ভূমি মন্ত্রণালয়ের কেউ নন। দপ্তর দুটি আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের। ভূমি সেবাসংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বা এডিসি (রাজস্ব), রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি), রেকর্ড রুমের ডেপুটি কালেক্টর (আরআরডিসি) পদগুলোও ভূমি মন্ত্রণালয় বা অধীনস্থ কোনো দপ্তরের পদ নয়।

এই কর্মকর্তারা অতিথির মতো এ মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন, যারা প্রায়ই নতুন কিছু সমস্যা সৃষ্টি করে বদলি হয়ে যান। তাদের জায়গা পূরণ হয় নতুন কর্মকর্তা দিয়ে। এভাবে সমস্যার পাহাড় তৈরি হয়েছে। বেড়েছে জনভোগান্তি। প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পুরোপুরি ধার করা জনবলের ওপর নির্ভরশীল। যেটুকু নিজস্ব জনবল আছে, তাদের পদোন্নতি নেই বললেই চলে।

বিভিন্ন স্তরে প্রশাসন ক্যাডারের লোক প্রেষণে নিয়ে তাদের দিয়ে ভূমি প্রশাসন চালানো হয়। তাদের বদলি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বা বিভাগীয় কমিশনার। প্রয়োজনে শাস্তির এখতিয়ার নেই ভূমি মন্ত্রণালয়ের। শাস্তি দেওয়ার জন্য বড়জোর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিতে পারে, যা বেশিরভাগ সময়ই গুরুত্ব পায় না। অথচ খুব সহজেই নিজস্ব মানবসম্পদ ও দপ্তরের ওপর আস্থা রেখে ভূমিসেবা নিশ্চিত করা যায় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

ভূমির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর রয়েছে। ভূমি সংস্কার বোর্ড ও ভূমি আপিল বোর্ড এগুলোর অন্যতম। দুটি সংস্থারই প্রধান হন সরকারের সচিবরা। তারা সচিব হলেও এগুলো প্রশাসনে ডাম্পিং পোস্ট হিসেবে পরিচিত। তাই এসব পদে যেতে সচিবরা আগ্রহী হন না। যোগ দিতে বাধ্য হলেও দ্রুত তারা বদলি হয়ে যান। দুটি সংস্থায়ই জনবল শুধু প্রশাসন ক্যাডারের থেকে প্রেষণে নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়া আছে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তর। এই দপ্তর খুব পুরনো হলেও বর্তমানে এর জনবল ৩০ ভাগেরও কম। কারণ বিধিমালা না থাকায় শূন্য পদ পূরণ করতে পারছে না। এর মহাপরিচালক, পরিচালক ও উপপরিচালক এবং সহকারী পরিচালকসহ অধিকাংশ পদ প্রেষণে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য দিয়ে পূরণ করা হয়। প্রেষণবহির্ভূত অন্যান্য পদে লোক নিয়োগ আটকে আছে নতুন বিধিমালায়।

শুধু জনবলের দিক দিয়েই ভূমি মন্ত্রণালয় পরনির্ভরশীল না। সংস্কার তালিকায়ও তলানিতে। এর বিধিবিধান পুরনো, জটিল, অস্পষ্ট এবং জোড়াতালি দেওয়া। হাল আমলের ডিজিটালের মতো স্বচ্ছ না। সংস্কার তো হয়ইনি বরং কিছু সংস্কারের নামে তালগোল পাকানো হয়েছে। একটি নিয়োগবিধির কারণে ২৬টি নতুন মামলার সৃষ্টি হয়েছে। এসব মামলার ভারে জবুথবু হলেও মামলা নিষ্পত্তিতে এ মন্ত্রণালয়ের অনাগ্রহ বেশ স্পষ্ট। ভূমি মন্ত্রণালয়ে দূরদর্শী নেতৃত্ব না থাকা একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অনেকে। গতিশীল নেতৃত্ব তৈরির পথও রুদ্ধ। যারা সংস্কারকাজ একটু এগিয়ে নেন তাদেরই তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ভূমি ব্যবস্থাপনা সংস্কারের কথা বলে কেউই প্রশাসন ক্যাডারের সিনিয়রদের বিরাগভাজন হতে চান না।

এখন ভূমি মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন পরীক্ষিত রাজনীতিক নারায়ণ চন্দ্র চন্দ আর ভূমি সচিব মো. খলিলুর রহমান। এই নেতৃত্বও চাচ্ছেন ভূমি ব্যবস্থাপনাকে যুগোপযোগী ও চাঙ্গা করতে। জনবল না থাকলে কারা কাজ করবে? এ কারণে শুরুতেই তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন শূন্যপদ পূরণে। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের আওতাধীন জোনাল সেটেলমেন্ট ও উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিসের জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ১৫ ক্যাটাগরিতে ৩ হাজার ১৭ জনকে নিয়োগ দেবে। এসব পদের মধ্যে সার্ভেয়ারের পদ রয়েছে ২৮২টি।

ভূমি সচিব মো. খলিলুর রহমান গত সোমবার নিজ দপ্তরে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘জনবল নিয়োগ করতে হবে এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে অনেক মামলা-মোকদ্দমা আছে। সেগুলো নিষ্পত্তির চেষ্টা করছি। সবপক্ষকে বোঝাতে চাইছি মামলায় নয়, মিলে-মিশে কাজ করলে সবকিছুই সমাধান সম্ভব। তারা আস্থা রাখছেন। দেখা যাক কতটুকু করা যায়।’

দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনো ভূমিহীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিহীনদের খাসজমি দিচ্ছেন। খাসজমিতে ঘর করে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করছেন। কিন্তু এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের কারণে এ দেশে এখনো ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আসেনি। প্রশাসনের মতো দক্ষ ও চৌকস ক্যাডার সদস্যদের ওপর ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকলেও ঘুষ, দুর্নীতি, একজনের জমি অন্যের নামে লিখে দেওয়া, খাসজমি বন্দোবস্ত বা ইজারায় অনিয়ম, ভূমি অধিগ্রহণে জনগণের ভোগান্তি ও হয়রানির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এসডিজি এবং গুড গভর্নেন্স প্যারামিটার সুশাসনের মানদন্ড অনুযায়ী ভূমি সেবায় অনেক দূর যেতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সুশাসন দারুণভাবে জড়িত। ভূমি কর্মচারীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাস্তি দেওয়া সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি অনুষঙ্গ। কিন্তু বিভাগীয় মামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসিল্যান্ডের নিচের দিকের নন-ক্যাডার কর্মচারীদের শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অভিযোগ রয়েছে। অথচ ভূমির কাজ পুরোপুরি চেইনবদ্ধ অর্থাৎ নিচ থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকের দপ্তর এবং মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। কাজের ভুলের কারণে নিম্নস্তরের কর্মচারীদের শাস্তি ভূমি ব্যবস্থাপনার বড় দুর্বলতা। ভূমিতে সুশাসনের জন্য যা অন্তরায় বলে মনে করা হয়।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। একটি বিধিমালা করে কর্মচারীদের প্রাপ্য পদোন্নতির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। ন্যায্যতা ক্ষুন্ন করে এমন বিধি তৈরির পরামর্শ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কীভাবে দিয়েছে তা নিয়েও বিস্তর সমালোচনা রয়েছে। এর ফলে দুই ডজনের বেশি মামলা হয়েছে এবং প্রতিটি মামলায় তাদের পদোন্নতির পক্ষে রায় হয়েছে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালার তফসিলে রয়েছে ‘জেলা রাজস্ব শাখা’। অথচ জেলায় এ শাখার অস্তিত্ব নেই। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত রাজস্ব শাখাকেই মূলত এখানে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু এই দপ্তর ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো দপ্তর নয়। তফসিলে উল্লিখিত আরও কিছু পদ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কাঠামোভুক্ত। এভাবেই বিধিগত অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। উপজেলা ভূমি অফিস নামে একটি বিধি আছে। সেখানে উপজেলা ভূমি অফিস নামে একটি অফিস আছে। যে অফিসের প্রধান পদ উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা। কানুনগোরা দীর্ঘদিন এই বিধির অধীনে পদোন্নতি নিয়ে উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা পদে আসীন হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। এটি বাস্তবায়ন না করে বা উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা পদে প্রেষণেও কাউকে নিয়োগ না করে সহকারী কমিশনারকে পদায়ন করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক ভূমি সচিব  বলেন, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা কোথায়? ভূমি ব্যবস্থাপনা গৌণ হয়ে গেছে। টাকা কামানোই মুখ্য। ভূমি নিয়ে নানা অনিয়মের খবর কাগজে বের হয়। এসব অনিয়ম থেকে আসা অর্থ কোথায় যায়? ভূমি অব্যবস্থাপনা মানেই অর্থ আদায়ের দারুণ উৎস?’

সার্ভেয়ার্স ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সামীউল ইসলাম বলেন, ‘চাকরি জীবনে ১০ বছর পার হলেই আমাদের পদোন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু একই পদে ৩০ বছর চাকরি করে আমরা অবসরে যাচ্ছি। আর আইনের সরল বিশ্বাসের ধারাটি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য। কর্মকর্তার জন্য প্রযোজ্য আর অধীনস্থ কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য নয় বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু নিচের দিকের কর্মীরা এর কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না বরং একতরফা মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’