অণুশ্রী সদ্যকেনা সেগুন কাঠের দামী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নাইট ক্রীম আলতো করে মুখে ঘঁষছে।২৬ বছরের লাস্যময়ী, রূপসী, তরুনী অণুশ্রী। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে যৌবন যেন ঠিকরে পড়ছে, মুখে ও চোখে অহংকারের রশ্মি ও রূপের তালে তালে তীক্ষ্ণ রেশ ছড়াচ্ছে । মেরুন রঙএর ফিনফিনে পাতলা নাইটিতে মায়াবতী লাগছে, অণুশ্রীকে। নাইটির পাতলা কাপড়ের স্তর ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে, প্রস্ফুটিত যৌবনপদ্ম।যার স্নিগ্ধ হিমেল মৌ মৌ সৌরভ ব্যগ্র করে তুলছে তুষারের যৌবনঅশ্ব। তুষার ব্যালকনীতে বসে একমনে সিগারেট ফুঁকছে, ব্যালকনীতে রাখা বেলীর টব থেকে তীব্র সুগন্ধ তুষারের সিগারেটের স্বাদকে ফিকে করে দিল, ক্যাঁকটাসের টবেও ছোট ছোট কুঁড়ির মাথা তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।তুষার ঘরে ফিরে আসে, এরমাঝেই অণু ঘুমিয়ে পড়েছে। না আজও অণুকে কথাটি বলা হলো না। খুব ,খুব চাপে আছে তুষার, অফিসে বাড়তি কাজের চাপ। পরিবারের চাপ, সমাজের নির্মম পরিহাসের চাপ। সর্বপরি মানসিক চাপ। তুষার লাইট অফ করে ঘুমিয়ে যায়।
ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে ডাটা শাক কাটছে রহিমা, রহিমা গত ৩ বছর ধরে তুষারদের বাসায় ঝি এর কাজ করে। বিয়ের ৫ দিন পর থেকেই এই বাসায় কাজে লাগে রহিমা। বয়স ১৯/২০ বছর হবে, গায়ের রং ফর্সা না হলেও খুব উজ্জ্বল, শরীরের গড়ন মাঝারি। অধিক পরিশ্রম ও হতাশায় রহিমার জীবন প্রদীপ ঢুলুঢুলু করছে। একহাতে সকালের সব কাজ সেরে ফেলে রহিমা। অণুশ্রী আজ নীল রংএর চোসা শাড়ি পড়েছে, গলায়- কানে এন্টিকের গহনা। গুনগুন করতে করতে রেডি হচ্ছে সে।সিঁদুর না পড়লেও হাতে একজোড়া শাখা থাকে, তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে নাস্তা সেরে, অফিসের জন্য বের হয়ে গেলো অণুশ্রী। অণু একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নির্বাহী অফিসার, বেতন ১৬০০০০ টাকা, বছরে দুইটি ইনক্রিমেন্ট, ২ টি বোনাসও আছে ।অফিস থেকেই যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্হা করা আছে। ঝাঁ চকচকে ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি। অফিসের দিনগুলোতে তাই তেমন একটা ঝক্কি পোহাতে হয় না। অণু, তুষারের জন্য অপেক্ষা না করেই চলে যায় অফিসে, আজ একটু তাড়াও আছে। তুষার ইঞ্জিনিয়ার, বুয়েট থেকে বেরিয়েছে। বিয়ের আগে ইচ্ছে ছিল, বিসিএস দিবে। কিন্তু তড়িঘড়ি করে বিয়ে করায় সব পন্ড হয়ে গেল। স্কলারশিপটাও মিস করছে। তুষার এলজিইডিতে আছে এ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।তুষার নাস্তা সেরে রিক্সা নিয়ে অফিসে চলে গেলো।বুকের ভেতরটা আকুপাকু করছে, তুষারের। যেভাবেই হোক আজ অণুকে রাজি করাতেই হবে। রহিমা তুষারদের বাড়ি ছাড়াও আরো ৪/৫ বাড়িতে ঝিএর কাজ করে, আগে শুধু তুষারদের বাড়িতেই কাজ করতো রহিমা। কিন্তু যেদিন থেকে রহিমার স্বামী নিরুদ্দেশ হলো সেদিন থেকেই রহিমার কলির সন্ধ্যা শুরু। রহিমার ঘরে বৃদ্ধ শ্বশুর, বদ মেজাজী শ্বাশুড়ি ছাড়াও ২ বছরের একটি শিশু সন্তানও রয়েছে ।রহিমা তার ছেলেটিকে অত্যন্ত ভালোবাসে। বলতে গেলে এই সন্তানটিই তার শিব রাত্রির সলতে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে রহিমা, সন্তানকে জড়িয়ে ধরে। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলে, মানিকের ছোট্ট কোমলদেহটি। রহিমার স্বামী মজনু নিরুদ্দেশ হওয়ার পর অনেকেই রহিমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে রহিমা রাজি হয়নি, এমনকি অনেক সময় তাদের কুপ্রস্তাবের প্রতিবাদে দা নিয়ে তেড়ে এসেছে লোলুপ কুকুরদের দিকে। রেগে গেলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে রহিমা।রহিমা আজ একটু দেরিতে ফিরেছে, এসে দেখে তার ছোট্ট মানিক, মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘুমন্ত ছেলের কপালে, পায়ে আলতো করে চুমু খায় রহিমা। এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠে রহিমার বুক। স্বামী ছেড়ে যাওয়াতে রহিমার তেমন কোন আক্ষেপ নেই। কেউ যদি এ বিষয়ে রহিমাকে কিছু বলে, তবে রহিমা হাসিমুখে উত্তর দেয়” লড়বড়া হাইনের চাইয়্যা, ধবধবা ঢ়াড়ি বালা।” বৃদ্ধ শ্বশুর – শ্বাশুড়িকে খাইয়ে নিজে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
আজও অণু, সব কাজ শেষে আয়নার সামনে বসে মুখে নাইট ক্রীম ঘঁষছে, তুষার নিজেকে কিছুটা সহজ করে। অণুশ্রীকে বলে-
তুষার: বলি কি অণু, তুমি না হয় আরেকটি বার ভেবে
দেখ! এবার না হয় বেবীটা থাকুক।
অণুশ্রী, ভাবলেশহীন ভাবে হাতে পায়ে লোশন ঘঁষতে লাগলো। বিষয়টি যেন, এমন। তোমার কথা শুনতে আমার বইয়ে গেছে।
তুষার: অণু, আমি তোমাকে কিছু বলছি।
অণু: কতবার বলবো, কতবার বলেছি, আমি এসব ঝঞ্ঝাট পোহাতে পারবো না। এতই যদি সন্তান-সন্ততি দিয়ে ঘর ভরে ফেলার ইচ্ছা, তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করলে? কোন অজপাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত মেয়েকে বৌ করে আনলেই পারতে। একদম জ্বালিয়ে ফেলছো, আমায়।
তুষার: অণু, দেখ লক্ষী সোনা রাগ করেনা। তুমি দেখ সমাজে তো আমাদের একটি অবস্হান আছে, আজ বিয়ে করেছি ৫ বছর হলো। গ্রাম থেকে মা রোজ ফোন করে জিঙ্গেস করে নাতি নাতনির মুখ কবে দেখবেন? তাদেরও তো একটি আশা আছে, তুমিই বলো, আমি কি জবাব দিবো?
অণুশ্রী: আমার পেট, আমার সন্তান। আমি রাখবো, না এ্যাবোর্ট করবো, তুমি বা তোমরা সিন্ধান্ত নেবার কে? অনেক রাত হলো চেঁচিয়ো না, তুষার। গলা চড়াতে আমিও জানি। আমাকে ঘুমোতে দাও,কাল সকাল ১১ টায় বোর্ড মিটিং আছে, প্রেজেন্টেশন ঠিকমতো সাবমিট করতে পারলে, মাস দুয়েকের মধ্যেই ছোট একটা প্রমোশন হবে হয়তো।
তুষার: মানলাম গর্ভ তোমার, শরীর তোমার। তোমার দেহে কাকে রাখবে না রাখবে সে সিধান্তও তোমার। কিন্তু অ..ণু, স্পার্ম? স্পার্মটা কার? সেটা তো আমার নাকি? সেটা তো তোমার নয়।
অণু:গুড নাইট তুষার। এতো পকপক করার সময় আমার নেই। তুমি সবসময়ই বাজে বকো। যত্তসব মিডলক্লাশ সিন্টিমেন্ট। তোমাকে জববাদিহি করার কোন কারন নেই, তবুও বলছি, কান খুলে শুনে রাখো। Next year এ আমার প্রমোশন হবে, য়ূরোপ ট্যূরের সুযোগও আছে। আমি বোকা নই।এতো বড় সুযোগ নিশ্চয় হাতছাড়া করবো না। আর আমি এই পৃথিবীতে তোমার আর তোমার মা-বাবার মনোরঞ্জন করতে আসিনি। কে কি বলল, তাতে আমার বইয়ে গেছে। তোমার পরিবারকে তুমি কিভাবে manage করবে। সে দায়িত্ব তোমার, আমার নয়। আমার পারিবারিক, অফিসের চাপ নিশ্চয় তুমি বয়ে বেড়াও না।
আর এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না আমি। একজন স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল, নারীকে বিয়ে না করে সিনেমার সাবানা টাইপ কাউকে বিয়ে করলেই পারতে। আমাকে জ্বালিও না কিন্তু।
তুষারের শরীর রাগে ক্ষোভে কাঁপছে, তুষার কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে,
তুষার: কিন্তু অণু। দাম্পত্য কারো একার দায় নয়, এটাও তুমি জানো? নারীবাদের মিথ্যা বুলি আওড়িও না। একদম। স্বেচ্ছাচারিতা আর নারীবাদ নিশ্চয় এক নয়। নারীবাদী মানে নয়, প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা, স্রষ্টার অপার রহস্যকে উপেক্ষা করা, নিশ্চয় নয়? আর নষ্টামীকে যদি নারীবাদ বল, তবে নারীরাও নিশ্চয় তোমাকে ছেড়ে দিবে না। আমি তো তোমাকে জোর করে গর্ভবতী করেনি। বিয়ের আগে যেসব শর্ত ছিল, তা পূরণ করার চেষ্টা করে চলছি। ভবিষ্যৎ ও করবো। এমনই কথা ছিল, বিয়ের তিন বছর পর আমার বেবী নেয়ার জন্য ট্রাই করবো। তুমিও রাজী ছিলে।আজ ৫ বছর হলো, আর কত?
অণু: একদম চুও করো। যত্তসব পুরুষতান্ত্রিক শেকলধারী। শাসক।একদম চুপ। খুব বকতে শিখেছ, দেখছি।আমি এখন চাচ্ছি না, না মানে না।আমাকে বেঁধে রাখা এতো সোজা কথা নয়।
তুষার: অণু, একটা কথা বলি, নারীবাদী বা পুরুষতান্ত্রিক হওয়ার চেয়েও বড়ো কথা হলো, মানুষ হওয়া। আগে মানুষ, তারপর নারী বা পুরুষ। পরস্পরকে সম্মান করা, শ্রদ্ধাবোধ থাকা, স্নেহ মমত্ববোধ জ্ঞাপন করা। ব্যক্তিগত ও যুক্তিগত স্বাধীনতাকে সম্মান করা জানতে হবে। আমি তোমাকে মূল্যায়ন করি, শ্রদ্ধা করি, ভালোও বাসি। তবে তুমি কেন আমার দিকটা একবারও দেখছো না?
অণু: চেঁচিয়ো না, তুষার। চেঁচিয়ে অপারগতার সাগর তল করতে পারবে না।
তুষার: আমি চোর নই যে, চেঁচাবো। নারীবাদী হয়েছো খুব। তুমি যেমন আয় করো, এমন আয় আরো অনেক নারীরাই প্রতক্ষ্য, পরোক্ষভাবে করে চলছে। তুমি যেমন সংসারের ঘানি টেনে চলছো। রহিমাও কিন্তু সেই কাজটিও করছে। তাই বলে কি রহিমা ” মা ” হয়নি। আর ভুলে যেও না, সভ্যতার শুরুতে নারীরাই প্রথম হালচাষ, গবাদি পশুপালন করতো। এখান হয়তো হালচাষ করে না, তবে পশুপালনসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখনো নারীর অবদান অনস্বীকার্য।
অণু: Bullshit, রহিমা…. How dare you..? রহিমার মতো একটা সামাজিক শৃঙ্খলে আটক, গিনিপিগের সাথে তুমি তুলনা করছো আমার। আমি মিসেস অণুশ্রী। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। তোমার সাথে কথা বলতেও আমার ঘৃণা লাগছে। তুষার ছিঃ ছিঃ।
তুষার: বাহঃ অণু্শ্রী রায়, বাহঃ।
এই হলো তোমাদের Faminesim. খুবই হাস্যকর। তাহলে তোমরা যারা নারীবাদী। তারা নারী বলতে কি বোঝ? So called অত্যাধুনিকা, উচ্চশিক্ষতা, বেপরোয়া, ডিভোর্সি, অবৈধ যৌনাচারে বিশ্বাসী। ক্লাব ওম্যান? স্বামী- পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, বিভিন্ন জায়গায়, সোস্যাল মিডিয়ায় স্বামী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে গাঁজাখোরী গল্প বলে, ইমোশনাল সাপোর্ট নেয়া? Single Mother বলে বলে গলা ফাটিয়ে সামাজের কাছে নিজেকে চির-নির্যাচিতা, সুবিধাবঞ্চিত, সতী সাবিত্রীর তকমা এঁটে নেয়া?
অণু : Shut up. একদম ষাঁড়ের মতো চেঁচাবে না বলে দিচ্ছি। তুমি কি বলতে চাও, নারীরা সবসময়ই পুরুষের দাসী হয়ে থাকবে?
তুষার: তুমি ভুল অণু, তুমি ভুল। নারী কোন কালেই পুরুষের দাসী ছিলো না, এখনো নয়। নারী দেবী, মহিয়সী। তুমি চেঁচিও না অণু।চেঁচালে কি আর করবে? বড়োজোর মিথ্যা ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বা যৌতুকের মামলা দায়ের করে, জেলে পুরবে। রাষ্ট্র ও সমাজ তো তোমাদের সেই মোক্ষম সুযোগ হাতে তুলেই দিয়েছে।
অণু: তুমি বোঝাতে চাচ্ছো? তুমি কি বলতে চাচ্ছো? পুরুষরা সব নির্দোষ। দুধে ধোয়া তুলসীপাতা? এই যে চারিদিকে এতো এতো নারী নির্যাতনের খবর, সব! সব মিথ্যে?
তুষার: একদমই নয়। আমি তা বলতে চাচ্ছি না, বলছিও না। তবে এটাই স্পষ্ট করে বলতে চাচ্ছি। সব খবর বা মামলা সত্যও নয়। পৃথিবীর সব যেমন মিথ্যে নয় তেমনি সত্যও নয়। দেশে ও সমাজে অবলাদের জন্য যেমন সহমর্মিতা রয়েছে, আইন রয়েছে। তেমনি পুরুষ নির্যাতন দমন আইন প্রনয়ণ ও প্রয়োগ করা উচিত।
অণুঃ বাহঃ তুমি তো দেখি মদ না খেয়েও মাতলামো করতে পারো, বেশ লেগেছে তোমার আজগুবি কথাগুলো।
তুষার: আবারো বলছি অণু, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আরেকটিবার ভেবে দেখো। এরচেয়ে বেশি কিছু বলার শক্তি, ক্ষমতা আমার নেই।
অণু: প্যানপ্যান করে, অসহায় মেয়েদের মতো কেঁদো না তো, খুব বাজে লাগে আমার।
তুষার: লোভ ও উচ্চাকাঙ্খার কালো মেঘ যদি কারো জ্ঞানের চোখকে ঢেকে দেয়, তবে সত্যের সুনির্মল আলো আসতে সময় লাগে, তবে সে আলো একদিন না একদিন ফুটে উঠবেই।তবে হয়তো সেদিন খুব দেরি হয়ে যাবে।
অণুশ্রী: আমাকে শাসাচ্ছো, তুমি। এতো সাহস কোথায় পাও? আমি তোমারটা খাই না পড়ি?
তুষার: মোটেও না। আমাকে তোমার কাছে আমাকে খুলে বলার চেষ্টা করছি। তুমি আজকাল অনেক কিছুই দেখতে পাওয়া না।
অণুশ্রী: তুমি এতো ছোটলোক। আমাকে দাসী ভেবেছো?
তুষার: মোটেও না। নারী দেবী, মহারাণী। নারীকে পুরুষ কোনকালেই শাসন করতে পারেনি। নারীকে ভালোবাসা যায়, বন্দি করা যায়। নির্যাতন করা যায়। কিন্তু শাসন, শাসন করা যায় না। সৃষ্টির শুরু থেকেই নারী পৃথিবী সে তো কোন ছাড়, পুরুষের মস্তিষ্ককে শাসন করে আসছে। প্রকৃত নারীই প্রকৃতি, আর প্রকৃতি মানে পৃথিবী, পৃথিবী মানে সৃষ্টিরহস্য, আর সৃষ্টি মানেই মা।
অণুশ্রী : তোমার রেডিওটি দয়াকরে এবার একটি বন্ধ করবে। আমি ঘুমাবো।
অনুশ্রী লাইট অফ করে দিয়ে,তুষারের দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। তুষার একবুক যন্ত্রণা নিয়ে জেগে থাকে।
আজ আর রহিমা কাজে আসেনি। তুষার নাস্তা না করেই অফিসে চলে যায়। অনুশ্রীও কোন কথা না বলে, অফিসের গাড়ির জন্য বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। অফিসে বসে আছে তুষার, এমন সময় মোবাইলটি ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠেল! তুষার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরে, ফোনের ওপাশে রহিমার গলা।।
রহিমা: (খুব ভয়ার্ত কান্না জড়ানো স্বরে) ভাইজান আমি রহিমা ভাইজান। আমনে কই, এট্টু বিপদে পইড়্যা গ্যাছি।
তুষার: হ্যাঁ, রহিমা বলো, কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন?
রহিমা: আ….মি আমি হাসপাতালে ভাইজান। আফনে যুদি ইট্টু আইতান।
তুষার: কোন হাসপাতালে? কোথায় আছো? কত নাম্বার ওয়ার্ডে? কি হলো?
রহিমা: ফোনের ওপাশ থেকে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়, তুষারকে।
তুষার: হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে।
হাসপাতালে খুব ভীর।। জনাকীর্ণ বারান্দা গুলো পর্যন্ত রোগীর শয্যায় পরিনত হয়েছে। ১৫ নং ওয়ার্ডের ওটি’ র সামনে বসে আছে রহিমা। রহিমার পড়নের শাড়ী রক্তে ভেজা।চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে গেছে, দেখে মনে হচ্ছে ১০০ ভোলতা হুল ফুটিয়ে দিয়েছে। তুষারকে দেখেই রহিমা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। তুষার কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়ে।
তুষার: রহিমা ব্যাপার কি? কি হয়েছে?এখানে কেন, তুমি?
রহিমা: ( রহিমা কাঁদতে কাঁদতে যা বললো তার সারমর্ম এমন) ছেলেকে দুধ খাইয়ে ঘরে রেখে যখন রহিমা তুষারদের বাসায় আসার জন্য ঘর থেকে বের হয়, টলমল টলমল করতে করতে ২ বছরের মানিকও রহিমার পিছু পিছু বের হয়। রহিমা দেখেনি যে মানিক পিছনে পিছনে আসছে। হঠাৎ একটা অটোরিক্সা রহিমার সামনে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যা। হঠাৎ হইচই শুনে রহিমা পিছনে ফেরে দেখে লোকজনের জটলা, এগিয়ে যায় রহিমা ভীর ঠেলে।
রহিমা: সামনে গিয়া দেহি আমার মানিকের কচি শশার লাগান, শইলডা রক্তে জবজবা হইয়্যা ভিইজ্যা রাস্তাত পইড়্যা রইছে। (বলেই রহিমা কান্নায় ভেঙে পড়ে)
(দুইজন লোককে সঙ্গে নিয়ে রহিমা কোলে করে নিয়ে আসে মানিককে হাসপাতালে।)
রহিমা: ও…. ভাইজান, ও ডাক্তার… আমার মানিকরে আমার বুকে ফিরাইয়্যা দেন, মানিক ছাড়া যে আমার কিছু নাই, কেউ নাই। ও আল্লাহ আমার মানিককে ফিরাইয়্যা দাও।( হাসপাতালের ওয়ার্ড ভেদ করে রহিমার আহাজারি আকাশ বাতাস ভারি করে তুলেছে, তুষার জানে না সেই আহাজারি সৃষ্টিকর্তার কর্ণমূলে পৌঁছবে কিনা!)
তুষার রহিমাকে শান্ত হতে বলে, ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য ভিতরে ডক্টরস রুমে যায়। ডাক্তার জানায় মানিকের বাম হাতটি ভেঙ্গে গেছে। ডান পায়ের উরুতে কেটে গিয়েছে। মাথার পিছনে আঘায় পেয়ে কেটে গিয়েছে, ১২টি স্টীচ দিতে হয়েছে। এখন অবজারভেশনে আছে রোগী। অবস্হার উন্নতি হলে ৪/৫ দিন পর ছুটি দিয়ে দিবে। রহিমাকে অনেক জোরাজুরি করেও কিছু খাওয়াতে পারেনি তুষার। কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত, শ্রান্ত রহিমা নিথর হয়ে, বারান্দায় বসে আছে। ঘড়িতে রাত ১০ টা বাজে , তুষারকে এখন যেতে হবে।
রহিমার করুণ মুখের ছবি তুষারের মনে মায়ার জাল বুনে চলেছে। রহিমা স্বামী পরিত্যাক্তা, লোকের বাড়ির ঝি, হত দরিদ্র এসব কিছু ঝাপিয়ে যে পরিচয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তা হলো ” মা”. রহিমা মানিকের মা।
তুষারের মন বিষন্নতার কালো ছায়ায় ঢেকে গেল।
তুষার রহিমার হাতে হাজার দুয়েক টাকা দিয়ে, রাতে বাসায় ফিরে আসে।
তুষারের বুকের ভেতর একটা শীতল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার দমকা বাতাস তার আচরনে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটেনি। তুষার যেন জীবনঝড়ে বিপর্যস্থ সৈনিক।
আজ অণুশ্রী একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তুষার দেরি করে বাড়ি ফেরলেও একবারটিও ফোনে যোগাযোগ করেনি অনু। যদিও এসব বিষয়ে তুষার তেমন মাথা ঘামায় না।অণুকে আজ বড়ো ক্লান্ত ও দূর্বল লাগছে। তুষার নিজেই খাবার গরম করে খেয়ে নেয়। তুষার ঘুমোতে যাবে এমন সময় অণুর হ্যান্ড ব্যাগের দিকে চোখ যায়। তাঁদের হানিমুনের স্মৃতি বহন করে আছে কালো চামড়ার দামী হ্যান্ড ব্যাগটি। তুষারই পছন্দ করে মালয়েশিয়ান এক শপিংমল থেকে জোর করেই কিনে দেয় অণুকে। কালো রঙের হ্যান্ড ব্যাগটি মেঝেতে পড়ে আছে, ব্যাগের জিপার খোলা, কিছু কাগজের টুকরার মাথা দেখা যাচ্ছে। তুষার ব্যাগটি হাতে নেয়, কাগজগুলো বের করে দেখে, এগুলো ক্লিনিকের রিপোর্ট। তবে! তবে কি অনু? না আর ভাবতে পারছে না.. তুষার। হ্যাঁ ঠিক ভেবেছে তুষার , অনু Abortion করিয়েছে।হতাশা, লজ্জা, ঘৃণায় বোবা কান্নায় ভেঙে পড়ে তুষার। আর অনু কি শান্ত ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে। যে অণুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে তুষার, যার গর্ভে ছিলো তুষারের সন্তান, অণু, তুষারের প্রথম মানব-ভ্রূণ। গর্ভ যদি অণুর হয়ে থাকে, ভ্রুণ তো অণুর নয়? জোর করে কোন মাকে Abortion করালে কিংবাআল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারন যদি আইনত ও ধর্মীয় অপরাধ হয়। তবে মাতৃ গর্ভে, পিতৃ-ভ্রুণ বা স্পার্ম নষ্ট কেন অপরাধ নয়? কেন অণু এ মহাপাপের শাস্তি পাবে না? তুষারের চোখে ঘৃণা ও দুখের জল গড়াগড়ি যাচ্ছে।এ কোন অণু? এই অণুকে তো তুষার চিনতে পারছে না। কিছুক্ষণ আগেই দেখে এলো তুষার… এক মায়ের আহাজারি… নিজের সন্তানের জন্য। আর তুষারের ঘরেও এক মা ঘুমুচ্ছে, যে মা কয়েক ঘন্টা আগেই তার গর্ভের ভ্রুণকে ফেলে এসেছে আস্তাকুঁড়ে। মা যদি শুধু মা ‘ই হয়! তবে কেমন করে হাজার হাজার ভ্রুণ আস্তাকুঁড়ে পড়ে রয়? রহিমাও তো কর্মজীবী, অণুও কর্মজীবী, তুষারের মা, উনিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন, বিধবা কর্মজীবী নারী। তবে অণু কেন মা হতে চায় না, মাতৃত্ব কি সত্যিই কোনকালে নারীর পথের প্রতিবন্ধকতা ছিলো? এই মোহের, অজ্ঞানতার শেকল ভাঙবে কবে?
সকালে, অনেক সকালে রেন্ডম বেলের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙে, তুষারের।
আধোঘুমে টলতে টলতে দরজা খুলে তুষার।
দরজা খুলতেই তুষারের কালসিটে পড়া দুটি’চোখ কপালে উঠে। তুষারের মা আর পিসি এসেছে। সাথে তাদের পুরোনো চাকর রামুকাকা।
তুষার কিছু বুঝে উঠার আগেই, তুষারের মা তুষারকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে যায়।
তুষারের মা যমুনা রাণী। ৫২ ওর কাছাকাছি বয়সী। পৌঢ় খাওয়া চেহারা। জীবনের চোরাগলি সম্পর্কে অজ্ঞান এক মধ্যবয়সী মহিলা।
যমুনা রাণী তুষারের ঘরে ঢুকে, আলতো করে চুমু খায় অণুর কপালে। অণুর হৈহল্লা শুনে ঘুম ভেঙে যায়।
যমুনা দেবী: মা গো, তুমি আমার মা। তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী ছিলে এতোদিন। এখন হলে আমার অন্নপূর্ণা। মাগো আমার যে কি ভালো লাগছে। গতকাল রাতই আসতে চেয়েছিলাম। শুধু এই রামুর জন্যেই আসতে দেরি হলো। এইবার কিন্তু আমি আর যাবো না। একেবারে আমার নাতিকে হাঁটা শিখেয়ে তারপর বাড়ি-ঘরে ফিরবো।
শ্বাশুড়ির মুখে এমন কথাশুনে অণুর কান যেন আগুণে ঝলসে গেল।
বিস্ফোরিত চোখে অণু তুষারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে
মতামত লিখুন :