২০১৬ সালের আগের কথা। ভিডিও গেম খেলতে খেলতে একদিন গিয়ে জানতে পারেন গেম খেলার ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোড করলে টাকা ইনকাম করা যায়।
বয়স তাঁর মাত্র ২১ বছর। সিএসই পড়ছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরই মধ্যে ফ্রিল্যান্সিং করে হয়েছেন কোটিপতি। ফাইভার, আপওয়ার্কসহ বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফরমে তাঁর সফল প্রজেক্টের সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
চারজনের টিম পরিচালনার পাশাপাশি মাসে তাঁর আয় ছয় লাখ টাকা। সফল এই ফ্রিল্যান্সারের নাম আবদুল্লাহ আল মেজবাহ। তাঁর সফলতার গল্প শুনেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
২০১৬ সালের আগের কথা। ভিডিও গেম খেলতে খেলতে একদিন গিয়ে জানতে পারেন গেম খেলার ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোড করলে টাকা ইনকাম করা যায়।
অন্য সবার যখন ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রথম আয়ে বছরের পর বছর লেগে যায়। ঘাম ছুটে যায়। মেজবাহ সেখানে ব্যতিক্রম। ২০১৮ সালে ফাইভারে ফাইভ স্টার রেটিংসহ পাঁচ ডলার প্রথমবারে মতো আয় করেন।
আয়ের ফিরিস্তি
ফ্রিল্যান্সিংয়ে মেজবাহর এক মাসে সর্বোচ্চ আয় প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টাকা। গড়ে তাঁর মাসিক আয় প্রায় ছয় লাখ টাকা (অনলাইন অফলাইন দুটি মিলিয়ে)। গত পাঁচ বছরে সব প্ল্যাটফরম মিলিয়ে চার হাজারেরও বেশি প্রজেক্ট সফলভাবে শেষ করেছেন তিনি। আর অনেক আগেই মোট আয় ছাড়িয়েছে দুই কোটি টাকারও বেশি। ৬০টিরও বেশি দেশের বায়ারের কাজ করলেও তাঁর বায়ার বেশি যুক্তরাষ্ট্রে। প্রায় দুই হাজার প্রজেক্ট করেছেন সে দেশের বায়ারদের।
টিম লিডার
মেজবাহ বাসায় বসেই কাজ করে ডলার আয় করেন। এ জন্য তিনি প্রায় আট লাখ টাকার সেটআপ বসিয়েছেন। ২০২১ সালে কাজের চাপ খুব বেড়ে যায় তাঁর। তখন তিনি চারজনের টিম গঠন করেন। এঁদের তিনি দেড় থেকে দুই লাখ টাকা বেতন দেন।
কাজের গল্প
মেজবাহ ডিজিটাল মার্কেটিং দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করলেও এখন তাঁর কাজের বিষয় গ্রাফিক ডিজাইন, এনিমেটেড ভিডিও, এসইও ইত্যাদি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন ই-লার্নিং প্ল্যাটফরম ইনস্ট্রাক্টরির কথা কে না জানে। ইনস্ট্রাক্টরিতে রয়েছে মেজবাহর ব্র্যান্ড এনিমেশনের কোর্স লাইভ। তিনি জানান, এই কোর্সে এ টু জেড ব্র্যান্ড এনিমেশন খুব সহজে শেখানো হয়। আবার শেখার পর কিভাবে আয় করা যাবে সেই পথও দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি।
নিজেকে আপগ্রেড করেছেন
ইউটিউব ও ফেসবুকে কাজ করার ফলে ডিজাইন ও ভিডিও এডিটিং সম্পর্কে ভালোই দক্ষতা ছিল। কিন্তু ইংরেজিতে ছিলেন দুর্বল। সে কারণে সমস্যা হতো কাজ বুঝে নেওয়া, বুঝিয়ে দেওয়ায়। মেজবাহ নিজের এই দুর্বলতা নিয়ে বসে থাকেননি। ছয় মাসে নিজের সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠছেন। মেজবাহ বলছিলেন, ‘তখন কাজ করার পাশাপাশি নিজের দুর্বলতা কাটাতে বেশ পরিশ্রম করি। বুঝতে পারছিলাম, নিজেকে আরেকটু আপডেট করা দরকার, আরেকটু পেশাদার কাজ শেখা দরকার।’
সফলতার সিক্রেট
সফল ব্যক্তিদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু সিক্রেট থাকে। মেজবাহর ক্ষেত্রেও আছে তেমন। মেজবাহ বলেন, ‘সব সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে প্রাধান্য দিই। প্রথমত, গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করি, তারপর অন্য কাজগুলো করি। টিম মেম্বারদের ভালোভাবে কাজ বুঝিয়ে দিই। তারা কাজগুলো করে পাঠায়। তারপর ক্লায়েন্টের সঙ্গে এগুলো নিয়ে কথা বলে চূড়ান্ত রূপ দিই। ফ্রিল্যান্সিংকে ব্যবসায় রূপান্তর করেছি। এমন করলে সবার অনেক সুবিধা হবে। এতে আয় আরো বেশি হবে। একই সঙ্গে আরো পাঁচ থেকে ১০ জন বা অনেকেই কাজ শিখতে পারবে। কাজ করতে পারবে।’
অফলাইন বিজনেস
ফ্রিল্যান্সিংয়ের টাকা ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেছেন মেজবাহ। দেশের নামকরা গ্রুপ অব কম্পানি স্টারলাইন গ্রুপের সঙ্গে তাঁর রয়েছে ব্যাবসায়িক চুক্তি। তিনি স্টারলাইন গ্রুপের বিজনেস পার্টনার। এখান থেকে মাসে তাঁর আয় দু-তিন লাখ টাকা। বিনিয়োগ করেছেন প্রায় কোটি টাকা, যার সবই তাঁর ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ের অর্থ। ভবিষ্যতে আরো বিনিয়োগ বাড়াবেন বলে তিনি জানান।
সেরা ফ্রিল্যান্সার
পুরস্কারের জন্য মেজবাহ কাজ করেন না। কিন্তু ভালো কাজ করলে পুরস্কার তো জুটবেই। মেজবাহর বেলায়ও তেমন হয়েছে। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে টপ মোস্ট আর্নার, লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে ফাইভার কর্তৃক টপ কোয়ালিটি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নির্বাচিতও হন তিনি। এ ছাড়া ফাইভারের একজন টপ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সব সময় তাদের অফিশিয়াল প্রগ্রামে দাওয়াত পান। বর্তমানে হার-পাওয়ার প্রজেক্ট, আইসিটি ডিভিশন, বাংলাদেশ সরকারের বড় একটি প্রজেক্টে মেন্টর হিসেবে নিযুক্ত তিনি, যেখানে শত শত নারীকে আইটি সার্ভিস শিখিয়ে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে।
নতুনদের জন্য
নতুন যাঁরা ফ্রিল্যান্সিং শিখছেন তাঁদের জন্য মেজবাহর দুটি টিপস হলো তাঁরা যেন নিজেকে একটি স্কিলে সীমাবদ্ধ না রাখেন, নতুন নতুন স্কিলে নিজেকে সব সময় আপডেট করতে থাকেন। আর শুধু ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসের আশায় বসে না থেকে তাঁরা যেন আউট অব মার্কেটপ্লেসে ক্লায়েন্ট খুঁজতে থাকেন। কারণ ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে যে কাজটার মূল্য এক হাজার ডলার সেটা আউট অব মার্কেটপ্লেসে এক হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ডলারও হতে পারে। মেজবাহর মতে, বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস অনেক হাই হয়ে গেছে, যার কারণে নতুনরা ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে চেষ্টা করতে পারে, তবে তাঁদের জন্য ভালো হবে আউট মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে কাজ শুরু করা।
আগামী দিনের ভাবনা
টিমকে অনেক বড় করার ইচ্ছা আছে মেজবাহর। সে জন্য ২০২৪ সালে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন তিনি। এক হাজারেরও বেশি মানুষকে ফ্রিল্যান্সিং ও ডিজিটাল মার্কেটিং শেখাবেন। শুধু শেখানোই নয়, শিখে যেন আয়ের পথ খুঁজে পায় তা নিশ্চিত করবেন বলে মেজবাহ জানান।
সূত্র ও সাক্ষাৎকার: কালের কন্ঠের সৌজন্যে
মতামত লিখুন :