বাংলাদেশের নতুন সিটি কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহ অন্যতম। ২০১৮ সালে সিটি কর্পোরেশনের মর্যাদা পাওয়ার পর এ শহরকে নিয়ে নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা হয়েছে। কিন্তু শহরের জীবনমান নির্ভর করে শুধু সড়ক, ভবন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর নয়- নির্ভর করে খোলা জায়গা, পার্ক এবং সবুজ পরিবেশের উপরও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে বড় সংকট এখন পার্ক ও খোলা জায়গার অভাব।
২০২২ সালের আদমশুমারি বলছে, শহরের স্থায়ী জনসংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। কিন্তু ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ভাসমান মানুষ যোগ করলে এই সংখ্যা দশ লাখেরও বেশি হয়ে যায়। এত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খোলা জায়গা থাকা দরকার। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি হাজার মানুষের জন্য ১০ একর পার্কের জায়গা থাকা উচিত। আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এই মানদণ্ড বাস্তবসম্মত নয়। তবে অন্তত প্রতি হাজার মানুষের জন্য ১.৫ একর জায়গা রাখলেও শহর অনেক বেশি বাসযোগ্য হয়। এই হিসাবে ময়মনসিংহের জন্য দরকার প্রায় ৮৬৫ একর পার্ক। অথচ বর্তমানে শহরে আছে মোটে ৪৪ একরের মতো। অর্থাৎ প্রায় ৮২০ একর জায়গার ঘাটতি।
এখনকার পার্কগুলোর মধ্যে আছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন উদ্যান, বিপিন পার্ক, সার্কিট হাউস মাঠ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন। এগুলো শহরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও সংখ্যায় ও মানে খুবই কম। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- শহরের ভেতরে ছোট ছোট মহল্লাভিত্তিক পার্ক নেই, নেই শিশুদের জন্য নিরাপদ খেলার মাঠ। ফলে বাচ্চারা খেলতে গিয়ে রাস্তায় ঝুঁকির মুখে পড়ে, আর সাধারণ মানুষ হাঁটার মতো সহজ জায়গা খুঁজে পায় না। এতে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তবে সমাধানের সুযোগও আছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বড় আকারের পার্ক ও ওয়াকওয়ে গড়ে তোলা যেতে পারে, যা শহরের সৌন্দর্যও বাড়াবে। প্রতিটি আবাসিক এলাকায় ছোট মহল্লার পার্ক তৈরি করা জরুরি, যেখানে শিশুরা খেলতে পারবে এবং বড়রা আড্ডা ও হাঁটার সুযোগ পাবে। শহরের অব্যবহৃত ছোট জায়গাগুলো “পকেট পার্ক” হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে কম খরচে মানুষের জীবনমান উন্নত হবে।
এই কাজ শুধু সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই দরকার সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ (PPP)। বড় প্রকল্পে বেসরকারি সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের সম্পৃক্ত করা গেলে কাজ দ্রুত এগোবে। একইসঙ্গে নতুন ভবন বা বাণিজ্যিক প্রকল্পে জমির অন্তত ১০-১৫ শতাংশ খোলা জায়গা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর সব পার্ক ও খোলা জায়গা সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইন ও কমিটি গঠন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এগুলো দখল করতে না পারে।
পার্ক কেবল বিনোদনের জায়গা নয়। এটি বাতাস ও পানি পরিষ্কার রাখে, শহরের গরম কমায়, ভূগর্ভস্থ পানিকে ধরে রাখে এবং দুর্যোগের সময় আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে বড় কথা- পার্ক মানুষকে কাছাকাছি আনে, সামাজিক সম্পর্ক দৃঢ় করে এবং শহরকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
আজকের ময়মনসিংহ পার্ক সংকটে ভুগলেও এখনই যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তবে পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব। পরিকল্পিত উদ্যোগ, স্থানীয় মানুষের মতামত ও যৌথ প্রচেষ্টায় ময়মনসিংহকে একটি সবুজ, সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর শহর হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা কি চাইব আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পার্কহীন, কংক্রিটে ঘেরা এক শহরে বড় হোক, নাকি চাইব তারা খেলার মাঠে দৌড়াক, সবুজের মাঝে বেড়ে উঠুক?