ওপেন মেসেজ প্রবন্ধ-নিবন্ধ

ময়মনসিংহের সমতল ভূমির আদিবাসী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি জরিপ ও ভূমি ব্যবস্থাপনা: বাস্তবতা, সংকট ও সম্ভাবনা

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু

প্রকাশ : ৩১-৮-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০১২

ভূমি শুধু অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, এটি একটি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের ভিত্তি। বাংলাদেশে সমতল ভূমিতে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভূমি অধিকার প্রশ্নে নানাবিধ সমস্যা, জটিলতা ও বৈষম্যের বাস্তবতা বিরাজ করছে। এই প্রতিবেদনে ময়মনসিংহের আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ভূমি ব্যবস্থাপনার বর্তমান পরিস্থিতি, সংকট এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

১. ময়মনসিংহসহ সমতল ভূমির আদিবাসীদের ভূমি ব্যবস্থাপনা
১.১ ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
ময়মনসিংহ অঞ্চলে গারো, হাজং, কোচ, ডালু, বানাইসহ প্রায় ৪০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। ব্রিটিশ আমলে কিছু এলাকায় জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হলেও, পরবর্তীকালে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড সংশোধনের সময় তাদের জমি “খাসজমি” হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে মালিকানার স্বীকৃতি হারিয়ে ফেলেছেন অনেকেই।

১.২ বর্তমান চ্যালেঞ্জ
ভূমির কাগজপত্র নেই: অধিকাংশ আদিবাসী পরিবার পৈতৃকভাবে বসবাস করলেও দলিল বা খতিয়ান নেই।
নতুন ডিজিটাল জরিপে বাদ পড়ার শঙ্কা: কাগজপত্রের অভাবে ও তথ্য না জানার কারণে ভূমি রেকর্ডে তারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেন না।
ভূমি দখল ও উচ্ছেদ: বেসরকারি কোম্পানি, প্রভাবশালী মহল ও এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভূমি দখল বাড়ছে।
আইনি সুরক্ষার অভাব: আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি আইন বা সংরক্ষিত ভূমি ব্যবস্থাপনা গঠিত হয়নি।

১.৩ বিভিন্ন উদ্যোগ
বেসরকারি সংস্থার কাজ: ‘বগা ফাউন্ডেশন’, ‘অরণ্যক ফাউন্ডেশন’ ও ‘সুরক্ষা’ সহ বিভিন্ন এনজিও ভূমি অধিকার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রস্তাবনা: সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের সুপারিশ রয়েছে।

২. পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও জরিপ ব্যবস্থা
২.১ বিশেষ সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক কাঠামো
পার্বত্য চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস (CHT) শান্তিচুক্তি (১৯৯৭) অনুসারে পৃথক ভূমি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই চুক্তির অন্যতম অনুষঙ্গ হলো:
পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (CHT Land Dispute Resolution Commission)
ঐতিহ্যগত জুম চাষের স্বীকৃতি
‘সার্কেল চিফ’-এর ভূমি প্রশাসন

২.২ ভূমি কমিশন ও তার কার্যকারিতা
কমিশন গঠনের পরও অগ্রগতি ধীর: ১৯৯৯ সালে গঠিত কমিশন বারবার পরিবর্তিত হলেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া: প্রায় ২০ হাজারের বেশি জমি সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিহীন রয়েছে।

২.৩ জরিপ নিয়ে বিরোধ
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ প্রকল্প (২০০৯-২০২৩) অনেক স্থানে আদিবাসীদের আপত্তির মুখে বন্ধ হয়। কারণ, তারা মনে করেন এতে ঐতিহ্যগত ও ব্যবহারভিত্তিক জমির মালিকানা বিলুপ্তির ঝুঁকি আছে।

২.৪ ভূমি দখল, উন্নয়ন প্রকল্প ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসন
সেনা ও উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ: অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়দের সঙ্গে পরামর্শ না করে জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
বাঙালি অভিবাসন: ১৯৭৯ সালের পর থেকে বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের ভূমি অধিগ্রহণ আদিবাসীদের উদ্বিগ্ন করেছে।

৩. আইন, নীতি ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা
৩.১ প্রাসঙ্গিক আইনসমূহ
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩
বাংলাদেশ আদিবাসী নীতি (খসড়া), ২০১৫
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ১৯৯৭
ILO Convention 107 & 169 (বাংলাদেশ 107 অনুসমর্থন করেছে)

৩.২ সুপারিশসমূহ
সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন;
ভূমি জরিপে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা;
পার্বত্য ভূমি কমিশনের পূর্ণস্বাধীনতা ও কার্যকর বাজেট বরাদ্দ;
ভূমির ঐতিহ্যগত ব্যবহারকে আইনি স্বীকৃতি প্রদান
ভূমি সংক্রান্ত তথ্যাদির ডিজিটাল রক্ষণাবেক্ষণ ও স্থানীয় ভাষায় প্রচার;
ভূমি হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার ভিত্তি। ময়মনসিংহের সমতল আদিবাসী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক ও ন্যায্য ভূমি ব্যবস্থাপনা কেবল বিরোধ কমাবে না, বরং সমাজে স্থিতিশীলতা ও শান্তি আনবে।

তথ্যসূত্র:
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ১৯৯৭
(সূত্র: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়)
CHT Land Dispute Resolution Commission Act, 2001

ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩
(সূত্র: আইন ও বিচার বিভাগ, বাংলাদেশ সরকার – bdlaws.gov.bd)
জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার সনদ (UNDRIP), ২০০৭
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম – www.ipfbd.org
Roy, Raja Devasish. (2000). Land Rights of the Indigenous Peoples of the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh.
বাংলাদেশ আদিবাসী নেটওয়ার্ক রিপোর্ট, ২০২৩