সকল খবর দেশের খবর

মানুষের পাশে প্রশাসন: ময়মনসিংহে বদলে যাওয়া অফিস সংস্কৃতি

৮ নভেম্বর ২০২৫ |। অনিন্দ্যবাংলা ।।

প্রকাশ : ৮-১১-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫১৬৩

ময়মনসিংহের সকাল। জেলা প্রশাসকের অফিসের আঙিনায় কর্মব্যস্ত সময়। কেউ নথি জমা দিচ্ছেন, কেউ সেবা নিতে এসেছেন। অফিসের ভেতরে হালকা হাওয়া বইছে; কিন্তু প্রশাসনিক পরিবেশে আছে এক ধরনের সজীবতা। এই পরিবর্তনের নেপথ্যে আছেন জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম; একজন মাঠকেন্দ্রিক কর্মকর্তা, যিনি ‘মানুষের কাছে প্রশাসন পৌঁছে দিতে’ বিশ্বাসী।

২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি দায়িত্ব নেন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ২৪তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই বদলে ফেলেছেন ময়মনসিংহের প্রশাসনের পুরানো রূপ-রং। অফিস কক্ষের বাইরে গিয়ে তিনি মাঠে যাচ্ছেন; উপজেলায়, ইউনিয়নে, স্কুলে, উন্নয়ন প্রকল্পে। যেখানেই সমস্যা, সেখানেই দেখা যায় তাঁকে। এক সহকারী কমিশনার বলেন, “স্যার সবসময় বলেন, মানুষকে সেবা দিতে হবে মুখে নয়, কাজে।”

ময়মনসিংহের সবচেয়ে জটিল বিষয় ছিল ভূমি অধিগ্রহণ। দালালচক্র, জাল কাগজ ও দীর্ঘসূত্রতা; সব মিলিয়ে ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। ময়মনসিংহ জেলার দায়িত্ব নেয়ার পর মুফিদুল আলম প্রথমেই এই খাতে পরিবর্তন আনেন।

ভূমি অধিগ্রহণ অফিসকে তিনি জেলা প্রশাসকের ভবনের নিচতলায় স্থানান্তর করেন; নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা দুটোই বেড়েছে। এখন ফাইল প্রক্রিয়া দ্রুত হয়, দালালদের প্রবেশও কঠিন।

তিনি সরাসরি বলেন, “ভূমি অধিগ্রহণে কোনো প্রকার জালিয়াতি বা অনিয়ম সহ্য করা হবে না।” এই উদ্যোগের পর থেকে সেবাগ্রহীতারা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারছেন।

জেলা প্রশাসক শুধু প্রকল্পের নথি দেখেন না, নিজে মাঠে গিয়ে কাজের অগ্রগতি দেখেন। রাস্তা নির্মাণ, স্কুল সংস্কার, পর্যটন কেন্দ্র উন্নয়ন; সব জায়গায় তাঁর উপস্থিতি নিয়মিত। সম্প্রতি তিনি হালুয়াঘাটের গাবরাখালী গারো পাহাড় পর্যটন এলাকা ঘুরে দেখেছেন। তাঁর পরিকল্পনা, এই অঞ্চলে টেকসই ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তোলা। তিনি বলেন, “উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয়, যখন সেটা সাধারণ মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনে।”

তিনি দুর্যোগের সময় মাঠে থাকেন, আবার শিক্ষা কার্যক্রমে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান। বন্যা বা শীতকালীন দুর্ভোগে তাঁকে দেখা যায় আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে বেড়াতে। তিনি বিশ্বাস করেন, “জনগণের আস্থা অর্জনই প্রশাসনের মূল সাফল্য।” অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বলছেন, তিনি শৃঙ্খলা ও মানবিকতার ভারসাম্য রাখেন।

নিয়মিত অফিসে আসেন, সময় দেন, অভিযোগ শোনেন। সেবাগ্রহীতারা এখন বলেন; “অফিসে গিয়েই কাজ হয়, আগের মতো দৌড়াতে হয় না।” মুফিদুল আলম মনে করেন, উন্নয়ন শুধু অবকাঠামো নয়; মানুষের মানসিক বিকাশও জরুরি। তাই জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজন করছেন ফুটবল, দাবা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা।

সম্প্রতি জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। তিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, “খেলাধুলা তরুণদের ইতিবাচক পথে রাখে। একটি সক্রিয় প্রজন্মই আমাদের শক্তি। সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি ভাঙার বিতর্ক নিয়ে একসময় মিডিয়ায় নানা আলোচনা হয়।

মুফিদুল আলম তখন শান্তভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন- “জমিটি সরকারি শিশু একাডেমির নামে রেকর্ডভুক্ত। বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণ আমাদেরও অগ্রাধিকার।” তাঁর এই স্বচ্ছ ব্যাখ্যা পরিস্থিতিকে শান্ত করে। এটিই তাঁর প্রশাসনিক পরিমিতিবোধ ও আত্মবিশ্বাসের দৃষ্টান্ত।

তাঁর সঙ্গে আছেন দুই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক; আজিম উদ্দিন (রাজস্ব) এবং উম্মে হাবীবা মীরা (উন্নয়ন)। তিনজনই মিলে জেলা প্রশাসনের কার্যক্রমকে গতিশীল রাখছেন। প্রতিদিনের বৈঠক, মাঠপর্যায়ের পরিদর্শন আর অনলাইন মনিটরিং; সব মিলিয়ে প্রশাসন এখন অনেক বেশি কার্যকর।

তাঁর পরবর্তী লক্ষ্য; সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্রশাসন। অর্থাৎ মানুষ যেন অফিসে না এসে অনলাইনে সেবা পায়। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে অনলাইন আবেদন ও অভিযোগ সিস্টেম চালু হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা চাই, প্রশাসন মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাক; অফিসের দেয়ালের ভেতর সীমাবদ্ধ না থাকুক।” জেলাবাসীর বক্তব্য “ডিসি স্যার মাঠে থাকেন, কাজ করেন; এই একটা বাক্যেই তাঁর পরিচয়।”