সকল খবর ময়মনসিংহের খবর

ময়মনসিংহে স্টিল আর্চ ব্রিজের অনিয়ম, দুর্নীতি ও জনদুঃখের মহাকাব্য!

অনিন্দ্যবাংলা প্রতিবেদন:

প্রকাশ : ২৫-৬-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০৯৭

ময়মনসিংহ শহরের বুকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর কেওয়াটখালি ও রহমতপুর নামে দুটি সেতু নির্মাণের নামে যা চলছে, তা যেন রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভয়াবহ অপচয়, সুপরিকল্পিত অনিয়ম এবং স্থানীয় জনগণের প্রতি নির্মম অবহেলার এক করুণ দলিল। উন্নয়নের মুখোশের আড়ালে জালিয়াতি, দীর্ঘসূত্রিতা আর দুর্নীতির এমন জটিল জাল বিস্তৃত হয়েছে যে, প্রকৃত উন্নয়নের স্বপ্ন ক্রমাগত ম্লান হয়ে আসছে, আর তার স্থান দখল করেছে ক্ষোভ, হতাশা আর দুর্বিষহ দুর্ভোগ।

কেওয়াটখালি স্টিল আর্চ ব্রিজের কথা শোনা যায় ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকেই। প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু হাতে গোনা যাবে এমন কাজের অগ্রগতি প্রায় শূন্যের কোঠায়। মাত্র পাঁচ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে গুঞ্জন, অথচ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে মাত্র ৪ দিন বাকি; এর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের ৩০ জুন। এই স্থবিরতার পেছনে লুকিয়ে আছে নকশা জালিয়াতির গভীর অভিযোগ। চায়না মোড় ও মুটকি ভাঙ্গা এলাকায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নকশা পাল্টে ফেলার কারণে হঠাৎ করেই বাড়তি ৩২ একর জমি অধিগ্রহণের দাবি উঠেছে। এই জটিলতায় প্রকল্পের কাজ প্রায় ২ বছর পিছিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় প্রকল্পের নকশা কি আদৌ প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিকভাবে করা হয়েছিল, নাকি ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কতিপয় ব্যক্তিস্বার্থে ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনাই ছিল দুরভিসন্ধিমূলক?

এই নকশা পরিবর্তনের নামে বাড়তি জমি অধিগ্রহণের গল্পটিই রাষ্ট্রীয় অপচয় ও জনদুর্ভোগের প্রথম ধাপ। রহমতপুর ব্রিজের জন্য মাত্র ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হলেও কেওয়াটখালির জন্য ইতিমধ্যেই ৮১ একর জমি গিলে ফেলার পর এখন বাড়তি ৩২ একর দামি জমি (স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, দোকানপাট, শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক জমিসহ কৃষি জলাশয় গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে কর্তৃপক্ষ। "মনিটরিং সিস্টেম, যাত্রী ছাউনি ও অন্যান্য সুবিধা"র নামে এই বাড়াবাড়ি স্থানীয় মানুষসহ বিশেষজ্ঞদের কাছেও হাস্যকর ও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। রহমতপুর ব্রিজের দৈর্ঘ্য (১৪৭১ মিটার) কেওয়াটখালির (১১০০ মিটার) চেয়ে বেশিই, মূল সেতুর দৈর্ঘ্যও প্রায় সমান (৩৩০ মিটার বনাম ৩২০ মিটার)। তাহলে কেওয়াটখালির জন্য জমির এই অতিরিক্ত দাবির যুক্তি কোথায়? এই অধিগ্রহণের পেছনে ভয়াবহ দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যায়, যার শিকার হচ্ছেন সাধারণ জমির মালিকরা। অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত শত শত পরিবার রাস্তায় বসবাস করছেন, তাদের পুনর্বাসনের নামে কোনও উদ্যোগ নেই। এটা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরাসরি মানবিকতার অবমাননা।

অর্থের অপচয়ের হিসাব আরও ভয়াবহ। রহমতপুর ব্রিজ নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৮৪২ কোটি টাকা। অন্যদিকে, কেওয়াটখালির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩,২৬৩ কোটি টাকা। লেন সংখ্যা বেশি (৪ বনাম ২) হলেও এত বিশাল পার্থক্য (প্রায় ১,৪২১ কোটি টাকা!) কোনও যুক্তি বা স্বচ্ছতা ছাড়াই কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। শুধু তাই নয় কেওয়াটখালী ব্রিজ সম্পন্ন করতে বাড়তি আরো ২,০০০-৫,০০০ কোটি টাকা লাগতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এছাড়াও এর সাথে যুক্ত হয়েছে উভয় সেতুর জন্য সমানভাবে নির্ধারিত ১২০ কোটি টাকার পরামর্শক ফি, যা নিজেই একটি বিতর্কের বিষয়। অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশের বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট ও সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এর কাছে এই ব্রিজ ডিজাইনের দায়িত্ব দিলে তা বর্তমান খরচের ১০ ভাগের ১ ভাগে নেমে আসত। জনগণের করের টাকার এত বেহিসাবি খরচ প্রকৃত অর্থেই রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর চুরির শামিল।

স্বচ্ছতা বলতে কিছুই নেই। রহমতপুর ব্রিজের কথা সরকারি কাগজে-কলমে আছে; অনুমোদন হয়েছে ২০২২ সালের মে মাসে, জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছে ত্রিশ একর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই প্রকল্পটির বাস্তব অবস্থা, কাজের অগ্রগতি, ব্যয় কিংবা পরিকল্পনা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিস, ওয়েবসাইট বা ইন্টারনেটে কোনও তথ্যই পাওয়া যায় না। এটি একটি 'ভূতুড়ে প্রকল্প'-এর মতো, যার অস্তিত্ব শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ। জনগণ জানতে চায়, এত টাকা বরাদ্দের পর প্রকল্পটি আদৌ বাস্তবায়নের পথে আছে কিনা, নাকি এটি শুধুই বাজেট খরচের একটি ফাঁকা খাম?

এই দুটি সেতু নির্মাণে জনগণের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। কেওয়াটখালি বা রহমতপুর, কোনোটির জন্যই স্থানীয় জনগণ, সুশীল সমাজ, বিশেষজ্ঞ বা সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কোনও ধরনের গণশোনানী বা মতবিনিময় করা হয়নি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এই সেতুগুলোর প্রভাব, পরিবেশগত ঝুঁকি বা সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। এই একচেটিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং জনঅধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা।

কেওয়াটখালী ব্রিজ প্রকল্পের প্রকৌশলগত সিদ্ধান্তও প্রশ্নবিদ্ধ। কেওয়াটখালি আর্চ স্টিল ব্রিজে  ইচ্ছাকৃতভাবে রেল সংযোগ রাখা হয়নি। এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে নগরীর সমন্বিত ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। আরও ভয়াবহ আশঙ্কা করা হচ্ছে যানজট ও দুর্ঘটনা বৃদ্ধি নিয়ে। কেওয়াটখালি ব্রিজের সংযোগ সড়ক পুরনো শম্ভুগঞ্জ সড়কের সাথে সরাসরি একই জায়গায় মিলিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই চরম যানজটে পিষ্ট শম্ভুগঞ্জ এলাকায় এই সংযোগ ভবিষ্যতে এলাকাটিকে যানবাহনের জন্য দুর্যোগপূর্ণ জোনে পরিণত করবে, যার মূল্য দিতে হবে সাধারণ মানুষকে দৈনন্দিন সময় নষ্ট, মানসিক চাপ এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ার মাধ্যমে। ইতোমধ্যেই ময়মনসিংহ নগরীর বিশ্বের অন্যতম ৯ম ধীরগতির শহর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জালিয়াতিকৃত নকশায় সংযোগ সড়ক বাস্তবায়িত হলে এই শহর বিশ্বের সেরা ধীরগতির শহর হিসেবে গণ্য হতে পারে।

ব্রিজের নির্মাণ কাজের মান নিয়েও উদ্বেগের অন্ত নেই। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পে কোনও স্বাধীন বা কার্যকর পরিদর্শক দল নেই। ফলে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে সেতু নির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই অবহেলা সরাসরি জননিরাপত্তার সাথে জড়িত।

কিছু গণমাধ্যমের ভূমিকাও এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। প্রকল্পের জটিলতা, জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগের গভীরে না গিয়ে, কিছু সাংবাদিক নির্লজ্জভাবে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছেন। এই হলুদ সাংবাদিকতা সত্য উদঘাটনের পথে বড় বাধা এবং জনগণের জানার অধিকারকে ক্ষুণ্ন করছে।

ময়মনসিংহের এই দুটি সেতু প্রকল্প আজ উন্নয়নের প্রতীক নয়; এগুলো পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় অপচয়, সুশাসনের অভাব, জবাবদিহিতার শূন্যতা এবং স্থানীয় জনগণের দীর্ঘমেয়াদী দুর্ভোগের প্রতীকে। কেওয়াটখালিতে জমি অধিগ্রহণ জটিলতা, রহমতপুরের দুর্নীতি উভয় ক্ষেত্রে অযৌক্তিক ব্যয়, কাজের ধীরগতি আর স্বচ্ছতার চরম অভাব; সব মিলিয়ে এখানে একটি সুপরিকল্পিত অনিয়মের ছবি স্পষ্ট। এই অপচয় শুধু অর্থের নয়, শাসনের প্রতি জনগণের আস্থারও। এই দীর্ঘসূত্রিতা শুধু সময়ের নয়, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনারও। জনগণের অর্থে, জনগণের জমিতে, জনগণের জন্য বলে কথিত এই সেতুগুলোর নির্মাণকাজে জনগণের অংশগ্রহণ ও স্বার্থ রক্ষার কোনও স্থান নেই। এই নির্মম বাস্তবতা পরিবর্তনের দাবিতে ময়মনসিংহবাসীর পাশাপাশি সচেতন সর্বস্তরের জনগণের কণ্ঠ এখনই উচ্চকিত হওয়া প্রয়োজন। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত, দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং প্রকৃত জনস্বার্থে দ্রুত কাজ শেষ করাই এখন একমাত্র কাঙ্ক্ষিত পথ। নইলে এই সেতুগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে শুধু দুর্নীতি ও অপচয়ের করুণ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই থেকে যাবে।