গত ছাব্বিশ দিনে বাসার আশে পাশে যত একটি ঘাসের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু ছিলো সব দেখা হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী ছেলে মেয়েরা আমার পাখি দেখার দুরবিন দিয়ে এখন মোটামুটি এক কিলো দূর পর্যন্ত যা দেখা যায় সে সব দেখায় ব্যস্ত। যেহেতু ঘর থেকে বের হতে পারছে না সেহেতু ঘরে থেকে লং ডিস্টেন্স দেখার কৌশলটি তাদের ষোল আনা কাজে লাগছে। গত ১৭ দিনে বাসার বাইরে পা দেয়া হয়নি । গত এক সপ্তাহ ধরে বাসায় কাঁচা সব্জির বলতে একটা বড় বেগুন। সেটি তিন ভাগ করে তিন দিন আলু দিয়ে রান্না করা হয়েছে। আজ নিস্তার পাওয়া গেলো না। নিরঞ্জনাকে যতই বোঝাই , বাজারে গেলে আমার চেয়ে তোমাদের ঝুকিই বেশি সে ততই তর্জে গর্জে উঠছে।
– আজ যদি বাজার না আসে এই রান্না ঘরে আমি তালা মেরে দিলাম। থাকো তুমি তোমার ঝোল আর ভাজি নিয়ে।
আমার বাসার রান্না ঘরে তালা লাগানোর কোন ব্যবস্থা নেই। আমি মোটামুটি হম্বিতম্বির ডিগ্রী আচ করতে পেরে প্রায় বসে গিয়েছিলাম টিভি দেখতে। টিভি বলতে মোটু পাতলু কার্টুন। আমার বাসায় একটা চ্যানেলই চলে আর তা হলো কার্টুন চ্যানেল। শেষ কবে টিভির চ্যানেল বদলানো হয়েছে তা হিসেব কষে বের করতে হবে। আমার পুত্র কন্যা বাবার চ্যানেল চেঞ্জ করার নেশা আঁচ করে ছয় মাস আগে রিমোটটা ছয় তলার উপর থেকে ফেলে দিয়েছে। তা আর পাওয়া যায় নি। যেহেতু চ্যানেল চেঞ্জ করা লাগে না তাই আর নতুন রিমোট কেনারও প্রয়োজন পড়ে না। এক হিসেবে এটা ভালই হয়েছে। দুনিয়া মোটামুটি আমার কাছে এখন মোটু পাতলুময়। পৃথিবীর সুখ দুঃখ, জরা- বেদনা কোন কিছু দেখতেও হয় না , তাই স্পর্শও করে না। ডাইনিং রুম থেকে হুংকার শুনলাম,
– তোর বাবাকে বল, বাবুর ডায়াপার শেষ হয়ে গেছে । আজ ডায়াপার না আনলে সারারাত সে যেন জেগে থাকে।
এইটা একটু বেশিই হয়ে গেলো। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বললাম,
– দাও লিস্ট দাও। বাজারে যাবো না মানে? অবশ্যই যাবো। বাজারে না গেলে খাবো কি?
– ভালো সবরী কলা নিয়ে আসবা। আর লিস্ট ব্যাগে দিয়ে দিয়েছি।
– সবরী কলা তো দুপুরে পাওয়া যাবে না ময়না পাখি।
– একদম মিথ্যা কথা বলবা না। আমি নিজে দেখেছি , ভ্যানে কলা নিয়ে বিক্রি করছে দুইজন। একজন আছে দাড়িওয়ালা। তার কলা গুলো ভাল। ওখান থেকে কিনবা।
– দাড়িওয়ালা কলা ওয়ালা কি তোমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছে নাকি? বুঝলা কিভাবে তার কলা ভাল।
– আমি দুরবীন দিয়ে দেখেছি। বাজারে গিয়ে ফোন দিও। আমি বলে দেবো কোন কোন দোকান থেকে কি কি সবজি কিনবা।
আমার পাখি দেখার দুরবীন এখন ব্যবহার হচ্ছে কলা দেখার কাজে। আমি আবেগে একেবারে বিগলিত হয়ে গেলাম। আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে বাজারে রওনা দিলাম নিতান্ত অনিচ্ছা স্বত্তেও।
বাজার থেকে ফিরলাম সামাজিক চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে। এসে দেখি শালাবাবু হাজির। কিম্ভুত কিমাকার একটা সাদা মত কি জিনিস পরা। আমি ছানাবড়া চোখে জিজ্ঞেস করলাম,
– এটা কি জিনিস পরেছো?
– দুলাভাই এটা আমার ডিজাইনে বানানো পারসোনাল ইকুইপমেন্ট প্রটেক্টর (পিইপি)।
– মানে কি? পিইপি নাকি পিপিই?
– ভাইয়া, এটা আমার পারসোনাল ইকুইপমেন্ট গুলোরে বাড়ির হাত থেকে প্রটেকশন দেবে। এর বিশেষ বিশেষ অংশে তুলো আর ফোম ভরা আছে। মোটামুটি থার্ড ডিগ্রী পর্যন্ত লাঠির বাড়ি ঠেকায়ে দিতে পারে। পরিক্ষা করে দেখছি। কাজ করে।
আজ আমার হতভম্ভ দিবস। একটু আগে র্যালি করে আসলাম বাজার ঘুরে ঘুরে । এখন আলোচনা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। শালাবাবুর সঙ্গে একটা মধ্য বয়স্ক মহিলা। বুঝলাম আমার বউ এর নতুন কাজের লোক । কাজের লোকের এই দুর্মূল্যের বাজারে খালাকে দেখে আমার বউ এর আকর্ণ বিস্তৃত হাসি আর থামতেই চাচ্ছে না।
– খালা কি রান্না বান্না করতে পারবেন?
– জ্বি পারবো।– খালার লজ্জা তখনো কাটেনি।
আমার পিইপি পরা শ্যালক তাল মেলালো,
– ভাইয়া, খালা হোটেলে কাজ করতো। করোনায় হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে বলে বাসা বাড়ির কাজ খুজছিলো। ভাল রান্না করে।
– আমার রান্না ভাল। আমি থাকলে আপনার খাবার কিছুই নষ্ট হবে না। মনে করেন আজ গরুর মাংস খাইয়া যে হাড্ডি গুলা ফালায়া দিবেন সেগুলা দিয়ে আমি হালিম রান্না করে দিতে পারি। আসতে আসতে শুনলাম, আপনি প্রায় পচা মাছ কেনেন। আমি পচা মাছ এমন ভাবে রানতে পারি আপনি জীবনেও ধরতে পারবেন না।
বলে কি এই খালা!!!!
– খালা আমাদের জন্য আপনাকে হালিম আর ফিস চপ করা লাগবে না । শুধু বাচ্চাদের জন্য একটু সুজি আর ডিম পোচ করতে পারলেই হবে।
– কোন চিন্তা করবেন না বাবা, আমি ছেলে পুলে রাখতে পারি।
আমার ধারণা হলো, খালা যেহেতু এক কাপড়ে এসেছেন দুটো শাড়ি আর এক মাসের বেতন পেলে লকডাউন খালাকে আটকে রাখতে পারবে না। হালিম আর ফিস চপ বানানোর নেশা খালার এই জীবনে যাবে বলে মনে হয় না। যাক যে কদিন থাকে তাই লাভ। খালাকে একটা তোলা শাড়ি বের করে দেয়া হলো।
তিন দিন পর সন্ধ্যা বেলায় ইফতারি শেষে নিরঞ্জনা চা নিয়ে এলো। চা খেতে খেতে বললো-
– খালা তো মনে হয় থাকবে না।
– কেন?
– খালা যে হোটেলে কাজ করতো সেই হোটেল নাকি খুলছে। ইফতারি বিক্রি করবে। খালার হাতে হালিম ছাড়া নাকি হোটেল চলবে না।
– চলে যেতে চাইলে আটকে তো আর রাখা যাবে না। এ মাসের বেতন দিয়ে দিও।
খালা চলে যাওয়ার পরদিন বিরাট এক প্লাস্টিকের বাটি ভর্তি হালিম নিয়ে আসলো একটা ছেলে। খালা পুত্রস্নেহে আমার জন্য অপচয়রোধী হালিম পাঠিয়েছেন। আমি আনন্দে বিগলিত হয়ে গেলাম আবার।
লেখকঃ খালিদ হোসেন
সিনিয়র সহকারী সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
মতামত লিখুন :