ইস্কাপনের বিবি দিয়ে ওভার ট্রাম করে বসলো রফিক।
অমনি হইহই করে প্রতিবাদ করে উঠলো রিয়া।
– না না না, তুমি এটা পারো না রফিক। আগের দানেই যে বললে রং (ইস্কাপন) নেই! এখন কোথায় থেকে বের হলো এই বিবি? তাস খেলায় এসব দু নাম্বারি চলবে না রফিক।
বড় ভাই সেলিম এবং মেজ ভাই শাহেদকে সাক্ষী মানে রিয়া।
– ভাইয়া দেখলে তো তোমাদের জামাইয়ের দুই নাম্বারি! খেলার মধ্যে শুধু চুরি-চামারি করে। এর একটা বিহিত করতেই হবে কিন্তু!
কিন্তু ভায়েরা রিয়ার পক্ষ নিয়ে বোন জামাই রফিককে দু’কথা শোনায় না। ফলে খেলার মধ্যে একতরফা ঝগড়া লেগে গেল। রিয়া খুব রেগেমেগে চলে গেল রুম থেকে।
এই লকডাউনের প্রতি সন্ধ্যায় তিন তাস খেলতে দোতালার কমন প্লেসে বসে বড়ছেলে সেলিম, মেঝ ছেলে শাহেদ আর জামাই রফিক। কিন্তু তাস খেলায় প্রতিদিন রিয়া এসে বাগড়া দেয়। রিয়ার আবদার কল ব্রীজ খেলতে হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কলব্রীজ খেলতে হয় রিয়ার সাথে। আজ এই কলব্রীজ খেলতে গিয়েই যত হট্টগোল।
ছেলেমেয়েদের এই খুনসুটি নিচের রুম থেকে স্পষ্ট শুনতে পান মা সুলতানা রহমান। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই হলেও কাজে কর্মে বেশ কর্মঠ তিনি। প্রতিদিন নিত্য নতুন খাবার বানিয়ে ছেলেমেয়েদের খাওয়াচ্ছেন। ওদের খাওয়া দেখে মন ভরে উঠে তার। চোখ দুটোও কিছুটা ভিজে উঠে হয়তো! আবারো তার ছেলে মেয়ের আগমনে এ বাড়ি গমগম করে উঠবে তা যেন কল্পনাতেও ছিল না তাঁর!
ধানমন্ডিতে চার কাঠা জমির উপর এই ডুপ্লেক্স বাড়িটি বেশ বড়। বাড়ির নাম “কাঠগোলাপ”। সুলতানা রহমানের প্রিয় ফুল। স্ত্রীর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে বাড়ির আনাচে কানাচে কাঠগোলাপের গাছ লাগিয়েছিলেন রহমান সাহেব।
সুলতানা বলেছিলেন,
– এত বড় বাড়ি দিয়ে কি করবে তুমি? ছেলে মেয়েরা যে যার মত প্রতিষ্ঠিত হয়ে চাকরি করবে। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। এত বড় বাড়ি কেই-বা দেখভাল করবে?
রহমান সাহেব শোনেন নি স্ত্রীর কথা। প্রতি সন্তানের জন্য এটাচট্ বাথসহ আধুনিক রুম করেছেন। বাড়িটিকে সাজিয়েছেন নিজের মত করে।
আজ সুলতানা রহমান আঁচলে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করে আনমনা হয়ে যান আবার।
একসময় তার তিন ছেলে আর এক মেয়ের কোলাহলে ভরপুর ছিল এ বাড়ি। আর এখন!
শুধু মেজ ছেলে শাহেদ পরিবার নিয়ে এ বাড়িতে থাকে।
ছোট ছেলে সঞ্জু থাকে কানাডায়। সেখানে পিএইচডি করছে। বোনের বিয়েতেও আসতে পর্যন্ত পারলো না।
আর বড় ছেলে সেলিম আমেরিকাতেই স্যেটেলড। প্রায় সাত বছর পর দেশে এলো সে। সেলিম এসেছে ছোট বোন রিয়ার বিয়ে উপলক্ষে। দেশে এসেই আটকা পড়েছে এই করোনা মহামারিতে।
লকডাউনের এক সন্ধ্যায় সুলতানা তার রুমে বসে ছিলেন। দোতালায় বসে ছেলেমেয়েরা তাস খেলছে। খেলার ফাঁকে কি যেন ফিসফিস চলছিলো দোতালায়। সুলতানা রহমান প্রতিদিন নিজের অজান্তেই কান পেতে থাকেন। ছেলেমেয়েদের আড্ডা শুনতে তার বড্ড ভালো লাগে।
কিন্তু আজকের কথাগুলো কেমন যেন ভারী হয়ে ধরা দেয় সুলতানার কানে।
সেলিম বলে,
– আজ হোক কাল হোক সম্পত্তিতো ভাগ করতেই হবে! তো এবার কেন নয়?
এবার যেন রিয়ার আহ্লাদি গলাটা শোনা যায়।
– আমি ভাগ টাগ বুঝি না ভাইয়া। আমাকে উত্তরার প্লটটা দিলেই চলবে। তোমাদের জামাইয়ের বিজনেস উত্তরা এলাকায়। আমি ওখানেই স্যাটেলড হতে চাই। ঘিঞ্জি ঢাকা আমার মোটেও ভালো লাগে না।
রিয়ার কথায় শাহেদ হা হা হা করে হেসে উড়িয়ে দেয়।
– না না না, সেটা হবে না। উত্তরার প্লটের আয়তন আর লোকেশনের কোন জুড়ি আছে? আর ভবিষ্যতে তো ঢাকা শহর ওদিকেই এক্সপান্ড হবে। এ প্লট কিন্তু আমি হাতছাড়া করবো না কোনভাবেই!
এবার সেলিম মৃদু ধমক দেয়।
– আরে, থামবি তোরা! যতসব ছোট বিষয় নিয়ে শুধু খুনসুটি। আরে শোন শোন, আমার কাছে কিন্তু দারুন একটা আইডিয়া আছে।
সবাই একসাথে বলে, কি আইডিয়া ভাইয়া? বলো, বলো!
– শোন, এসব গ্রাম্য ভাগাভাগির মধ্যে না গিয়ে আমরা আমাদের সব সম্পত্তি সেল করে দিতে পারি। তারপর যে যার যার ভাগের টাকা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করবো। আমিতো আর দেশে ফিরবো না। তাই এদেশে জমি জিরাত দিয়ে কি করবো বল?
বড় ভাই সেলিমের এ কথায় সবাই সায় দেয়। এটাই যেন সবার মনের কথা।
কিছুক্ষণ পর শাহেদের স্ত্রী বলে,
– ভাইয়া আমার একটা কথা আছে।
সেলিম বলে,
– বলো কি কথা।
শাহেদের স্ত্রী বলে,
– আম্মা প্রায় বছর সাতেক ধরে আমাদের সাথেই আছে। কোন দিন কিছু বলি নি। এবার যেহেতু সব কিছু ভাগ হচ্ছে তাহলে আম্মার বিষয়েও কিছুটা শেয়ারিং দরকার।
এ কথায় সবাই যেন নীরব হয়ে যায়। নীরবতা ভাঙে রিয়া। গলা উচু করে বলে,
– আমি পারবো না ভাবী। আমার শ্বশুর বাড়িতে মা থাকলে তোমাদের ইজ্জত থাকবে বলো?
– হুম,
সেলিম ঢোক গিলে বলে, আমিও তো আমেরিকায় স্যাটেলড। সে দেশে গিয়ে আম্মা মোটেও তাল মেলাতে পারবে না। ওখানে বয়স্কদের ম্যেনেজমেন্ট আলাদা। সবাই ওল্ড হোমে থাকে। খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে….
– তাহলে কি করা যায় ভাইয়া, বলে গলা খাকাড়ি দেয় শাহেদ।
– তাহলে আম্মাকে ভালো কোন ওল্ড হোমে রাখা যায় না ভাইয়া? বাংলাদেশেও তো ভালো মানের ওল্ড হোম আছে…
সুলতানা রহমান আর কিছু শুনতে চান না। দু’হাত দিয়ে কান চেপে ধরে থাকেন।
সেদিন রাতেই সুলতানা রহমানের জ্বর এলো। প্রচন্ড জ্বর। দু’দিন পর শুরু হলো গলা ব্যাথা। করোনার সিম্পটম। বাড়িশুদ্ধ লোক করোনা আতঙ্কে অস্থির। বাড়িতে ছেলেমেয়ে-নাতি নাতনির যে পদচারণা ছিল তা যেন হুট করেই কমে গেল।
তবু কিছু ফিসফিস যে সুলতানার কানে আসে না, তা না!
দোতালায় কমন স্পেসে চায়ের আড্ডা বসে। তাস খেলা চলে। রফিক বোধহয় আবার চুরি করে। কিন্তু রিয়ার কাছে ধরা খায় আবার। এই নিয়ে হই হই অবস্থা।
এর ফাঁকেই কথা চলে ওদের। সবাই যার যার মত বাড়ি ছাড়ার প্ল্যান করে।
সেলিম বলে,
– আমার ভায়রা ভায়ের বাড়ি মোহাম্মদপুর। প্রয়োজনে সেখানে চলে যাব। একটা রিকশা ডেকে উঠে গেলেই ল্যাঠা চুকে গেল।
মেয়ে রিয়া জোরালো গলায় জামাইকে বলে, তুমি আমাকে যেখানে পারো নিয়ে যাও রফিক। এখানে আর একদিনও না। তোমাকে জোর করে এ বাড়িতে আনাই আসলে আমার ভুল হয়েছে।
কুঁইকুঁই করে কাঁদতে থাকে রিয়া।
– সবাই যাবার চেয়ে মা কে কোথাও রেখে আসলে কেমন হয়? এই মানে কোন হসপিটালের কথা বলছি আরকি?
শাহেদ ভিতু গলায় বলে যায়।
কিন্তু শাহেদের বউয়ের মেজাজ চড়ে।
– আমি এসবের মধ্যে নেই। আমি কাল আমার ভায়ের বাসায় চলে যাবো। তুমি যাও আর নাই যাও, বাচ্চাদেরকে তো আমি রিস্কে রাখতে পারি না?
দোতালার আড্ডা থেকে কান ফেরায় সুলতানা রহমান। কান্নায় চোখ ভেঙে আসে তার।
কয়েকদিন পর বিকেলে অলস রোদ এসে পড়ে “কাঠগোলাপ” এর কার্নিশে। এসময় একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায় বাসার সামনে। রহমান সাহেবের বন্ধু ডা. মোস্তফা গাড়ি থেকে নামেন। মুখ হাসিহাসি। দোতলার বেলকনিতে দাঁড়ানো সেলিমের সাথে চোখাচোখি হতেই বলে,
– গুড নিউজ আছে। তোমার আম্মার করোনা নেগেটিভ এসেছে। আমরা গতপরশু স্যাম্পল নিয়ে গিয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ পরের ঘটনা। ছেলে-মেয়ে সবাই বসে আছে সুলতানার রুমে। সুলতানাই সব ছেলে মেয়েকে নিচে ডেকে এনেছেন।
সুলতানা ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তোমরা সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা চেয়েছিলে তো! উত্তরার প্লট বিক্রি করতে চেয়েছিলে না? তাই উকিল সাহেবকে নিয়ে এসেছি!
এ কথা শুনে তিন ভাইবোনের চোখ চকচক করে উঠলো।
সন্তানদের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে সুলতানা উকিলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– উকিল সাহেব, আপনি দলিলগুলো বের করেন।
উকিল সাহেব যেন তৈরিই ছিলেন। সুলতানার কথাতে ব্যাগ খুলে দলিলগুলো বের করলেন।
হালকা কেঁশে নিয়ে উকিল সাহেব বললেন,
– আপনাদের মা এই বাড়ি বৃদ্ধাশ্রমের জন্য দান করেছেন।
তিন ভাইবোন সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, কি!!
– জি। আপনাদের মা এই বাড়ি দান করেছেন। আর উত্তরার প্লট বিক্রি করে যে টাকা হবে, তা ব্যংকে রাখা হবে। সে টাকার লভ্যাংশ দিয়েই এই বৃদ্ধাশ্রম চলবে।
সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। দেখে মনে হচ্ছে সুলতানা যেন তুরুপের টেক্কা দিয়ে ট্রাম করে বসেছেন। এখন আর দ্বিতীয় কোন উপায় জানা নেই ওদের!
চোখ মুছে নিয়ে সুলতানা বললেন,
– তোমরা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চেয়েছিলে তো!আমাকে এই বাড়ি ছাড়া করতে চেয়েছিলে না! তোমাদের বাবার স্মৃতির এই বাড়ি ছেড়ে আমি কোথাও থাকতে পারবো না। তাই এ বাড়িটাকেই বৃদ্ধাশ্রম বানিয়ে নিলাম।
আরো যোগ করেন তিনি..
আর এর বাসিন্দা হবে আমার মত সেই সব অসহায় মায়েরা, যাদের সন্তানেরা করোনা সন্দেহে মাকে ত্যাগ করে বাইরে ফেলে আসে। কিংবা যার সন্তানেরা মাকে বোঝা মনে করে।
উকিল সাহেবের দিকে তাকিয়ে সুলতানা বললেন,
– আপনি এখন যেতে পারেন উকিল সাহেব।বাকী ফর্মালিটিগুলোও সেরে ফেলুন।
আর সন্তানদের বললেন, তোমরাও যেতে পারো। আমি একটু একা থাকতে চাচ্ছি।
বিকেলের মধ্যেই ছেলে-মেয়েরা সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। “কাঠগোলাপে” পড়ে থাকলেন সুলতানা, বৃদ্ধাশ্রমের প্রথম সদস্য হয়ে।
মতামত লিখুন :