বাংলাদেশের মানুষের ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রবেশের শুরুর দিকে ওয়েবে বাংলা লেখা বা বাংলায় কোনো ওয়েবসাইট তৈরি করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। তখন বাংলা লেখা ছবি কিংবা পিডিএফ আকারে সংরক্ষণ করা হতো। ই-মেইল করার ক্ষেত্রে বাংলা লেখা প্রায় অসম্ভব ছিল। সেই সময় বাংলা লেখার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় সফটওয়্যার ছিল বিজয়, তবে এটি ইন্টারনেটে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না।
অভ্রর আবির্ভাব
বাংলা কম্পিউটিংয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে অভ্র। মেহদী হাসান খান নামের এক তরুণ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি করেন অভ্র সফটওয়্যার, যা ছিল প্রথম ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা লেখার সফটওয়্যার। এটি বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার পাশাপাশি ওপেন সোর্স হিসেবে প্রকাশ করা হয়। এর ফলে যে কেউ অভ্রর উন্নয়ন ও পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারেন।
অভ্রর জনপ্রিয়তার পেছনে প্রধান দুটি কারণ ছিল— ইউনিকোড ভিত্তিক হওয়ায় ইন্টারনেটে লেখালেখির সুবিধা এবং ফোনেটিক পদ্ধতিতে লেখা। ফলে তরুণ প্রজন্ম দ্রুত অভ্র গ্রহণ করে। বর্তমানে ব্লগ, ফেসবুকসহ সব সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে অভ্র দিয়েই বাংলা লেখা হয়।
অভ্র তৈরির পেছনের গল্প
মেহদী হাসান খান নবম শ্রেণি থেকেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শুরু করেন। ২০০৩ সালে নটর ডেম কলেজে পড়ার সময় তিনি বাংলা লেখার জন্য উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের উপযোগী ইউনিকোডভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমদিকে সফটওয়্যারটি বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সমস্যায় পড়লেও ক্রমাগত উন্নয়নের ফলে এটি একটি শক্তিশালী বাংলা লেখার সফটওয়্যার হয়ে ওঠে। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবসে তিনি ‘অভ্র’ সফটওয়্যারটি উন্মুক্ত করেন।
অভ্রর প্রথম সংস্করণে বিজয় বাংলা কি-বোর্ড লে-আউট অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে অভ্র ইজি, ন্যাশনাল, প্রভাত, মুনীর অপটিমা, ইউনি বিজয় (২০১১ সাল থেকে এটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে) যুক্ত হয়। বর্তমানে অভ্রর সর্বশেষ সংস্করণ ৫.৬.০ বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়। এর স্লোগান— ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত।’
বিজয় বনাম অভ্র দ্বন্দ্ব
বিজয় বাংলা সফটওয়্যার ১৯৮৮ সালে মোস্তাফা জব্বার তৈরি করেন। এটি দীর্ঘদিন বাংলা কম্পিউটিংয়ে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে ছিল। তবে ইউনিকোডভিত্তিক সফটওয়্যার হিসেবে অভ্রর আগমনের ফলে বিজয়ের অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
২০১০ সালে মোস্তাফা জব্বার এক নিবন্ধে অভ্রকে ‘পাইরেটেড সফটওয়্যার’ হিসেবে আখ্যা দেন এবং অভিযোগ করেন যে নির্বাচন কমিশন অভ্র ব্যবহার করায় বিজয় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তিনি অভ্রর বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগও আনেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কপিরাইট অফিস থেকে মেহদী হাসান খানকে নোটিশ পাঠানো হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সমঝোতার মাধ্যমে অভ্র থেকে ইউনিবিজয় লে-আউট সরিয়ে নেওয়া হয়।
বিজয়-রিদমিক বিতর্ক
২০১৫ সালে মোস্তাফা জব্বার বিজয় সফটওয়্যারের অ্যান্ড্রয়েড সংস্করণ উন্মুক্ত করেন এবং অন্যান্য বাংলা কি-বোর্ড অ্যাপের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ আনেন। এর ফলে গুগল প্লে স্টোর থেকে রিদমিক ও ইউনিবিজয় কি-বোর্ড সরিয়ে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে রিদমিক কি-বোর্ড নতুন লে-আউটসহ আবারও প্লে স্টোরে প্রকাশ করা হয়।
অভ্রর সাফল্য ও স্বীকৃতি
অভ্র সফটওয়্যার বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়, যার ফলে ৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) অভ্র টিমকে ‘বিশেষ অবদান পুরস্কার’ প্রদান করে। ২০২৫ সালের একুশে পদকের জন্য মেহদী হাসান খানের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
অভ্র: এক নজরে
মূল উদ্ভাবক: ডা. মেহদী হাসান খান
উন্নয়নকারী: ওমিক্রনল্যাব
প্রথম প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০০৩
সর্বশেষ সংস্করণ: ৫.৬.০ (২০১৯)
প্রোগ্রামিং ভাষা: সি++, ডেলফি
প্ল্যাটফর্ম: উইন্ডোজ, লিনাক্স, ম্যাক, অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস
লাইসেন্স: ওপেন সোর্স, মোজিলা পাবলিক লাইসেন্স
উপসংহার
অভ্র বাংলা কম্পিউটিংয়ের ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। এটি বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত করার পাশাপাশি গণমানুষের ব্যবহারের উপযোগী করেছে। বিজয়ের সাথে দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও অভ্রর জনপ্রিয়তা আজো অটুট। প্রযুক্তি ও ভাষার মুক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভ্র তার পথচলা অব্যাহত রেখেছে।