সকল খবর ময়মনসিংহের খবর

গারো পাহাড়ে বাড়ছে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব: এক রাতেই দু’জনের মৃত্যু, আতঙ্কে জনপদ!

অনিন্দ্যবাংলা ডেস্ক:

প্রকাশ : ২২-৫-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০৪১

শেরপুরের গারো পাহাড় সংলগ্ন গ্রামাঞ্চলে আবারও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব। মাত্র এক রাতেই হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন দুই গ্রামবাসী। ঘটনাগুলো ঘটেছে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। নিহতদের পরিবারে নেমে এসেছে গভীর শোক ও অনিশ্চয়তার ছায়া। স্থানীয়রা বলছেন, হাতির তাণ্ডব প্রতিরোধে বন বিভাগের উদ্যোগ বরাবরের মতোই অপ্রতুল।

নিহত একজন কৃষিশ্রমিক এফিলিস মারাক (৫৫)। ধান কাটার কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গজনী তিনসড়কের মোড়ে হাতির পালের সামনে পড়েন তিনি। সঙ্গে থাকা অন্যরা দৌড়ে পালাতে পারলেও তিনি সরে যেতে পারেননি। হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে ও শুঁড়ে আছড়ে মারা যান তিনি।
এফিলিসের মেয়ে প্রিয়া হাদিমা (১৮), যিনি বর্তমানে ময়মনসিংহে একটি বেসরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, বাবার ক্ষতবিক্ষত দেহ শনাক্ত করতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফেরার পর কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, “হে সৃষ্টিকর্তা, বাবার এমন মৃত্যু যেন কোনো সন্তানকে দেখতে না হয়।”

একই রাতে, ঝিনাইগাতীর গান্ধীগাঁও গ্রামে নিহত হন দিনমজুর আজিজুর রহমান আকাশ (৪০)। তিনিও হাতির আক্রমণের শিকার হন দরবেশতলায়। বড় ছেলে সিহাব (১৫) জানায়, সবাই হাতি দেখতে গিয়েছিলেন, কিন্তু হাতির তাড়া খেয়ে তার বাবা পড়ে যান এবং হাতির হামলায় নিহত হন। বাবার মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়ে সিহাব বলে, “মা আর ছোট ভাইদের দেখাশোনার দায়িত্ব এখন আমার। হয়তো আর পড়ালেখা করা হবে না।”

দুই পরিবারের দুর্দশা সীমাহীন। প্রিয়ার মা টিটিনাস হাদিমা বলেন, “স্বামীর আয়েই চলত সংসার। এখন কীভাবে চলবে জানি না।” আকাশের স্ত্রী শিউলি আক্তারও চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, “আল্লাহ, তুমি আমারে এত বড় শাস্তি দিলা ক্যানো?”

এফিলিসের আত্মীয় ও স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, এক সপ্তাহ ধরে হাতির পাল লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। ধানক্ষেত থেকে শুরু করে ফলবাগান—সবই হাতির হামলায় ধ্বংস হচ্ছে। বন বিভাগ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

নিহতের পরিবারগুলোকে সমবেদনা জানাতে ঘটনাস্থলে যান শেরপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা মাহমুদুল হক রুবেল। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর হাতে সামান্য আর্থিক সহায়তা তুলে দেন।

বন বিভাগ বলছে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় কাজ করছে তারা। রাংটিয়া রেঞ্জের রেঞ্জার আব্দুল করিম জানান, নিহতদের পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া ইআরটি (ইলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম) টিমকে কেরোসিন সরবরাহ করা হয়েছে হাতি তাড়াতে। স্থানীয়দের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদী সমাধান ছাড়া এই সংঘাতের অবসান সম্ভব নয়। সদ্য বিদায়ী সহকারী বন সংরক্ষক ও প্রাণী গবেষক মঞ্জুরুল আলম বলেন, “হাতি শান্তিপ্রিয় প্রাণী। তবে আঘাত পেলে প্রতিশোধ নেয়। মানুষই আগে তাদের উসকায়।”
এদিকে, স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা মোহাম্মদ দুলাল মণ্ডল বলেন, “গত ২৫ বছরে বন বিভাগ হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে বাস্তবসম্মত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অথচ ভারতের আসামে দেখা গেছে, সোলার ফ্যান্সিং দিয়ে গ্রাম ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।”

বন্য প্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত গারো পাহাড় এলাকায় হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৪ জন। বিপরীতে মারা গেছে ৩৩টি হাতিও। এ থেকেই স্পষ্ট, এই দ্বন্দ্ব কেবল বাড়ছেই।