সকল খবর ময়মনসিংহের খবর

জয়নুল আবেদীন পার্কে উচ্ছেদ অভিযান: ঐতিহ্য সংরক্ষণ না ভাঙচুরের প্রতীক?

অনিন্দ্যবাংলা স্টাফ রিপোর্টার:

প্রকাশ : ৩০-৪-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫২৭৮

ময়মনসিংহ, ৩০ এপ্রিল ২০২৫ -ময়মনসিংহ নগরীর ঐতিহ্যবাহী জয়নুল আবেদীন পার্কে আজ দুপুরে এক বিস্তৃত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসনের যৌথউদ্যোগে। পার্কের ভেতরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন অবৈধ দোকান ও স্থাপনাকে ‘দখলদারিত্বের অবসান’ হিসেবে চিহ্নিত করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের দাবি, এ পদক্ষেপ নগর সৌন্দর্য এবং জনস্বার্থ রক্ষার অংশ, তবে এরই মধ্যে নানা বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে নগরবাসী ও সাংস্কৃতিক মহলে।

দুপুরে অভিযান শুরু হওয়ার পরই পার্কজুড়ে দেখা যায় বুলডোজার ও শ্রমিকদের পদচারণা। ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে চলা এ অভিযানে ‘বিজয়ী পিঠা বাড়ি’সহ একাধিক অস্থায়ী দোকান, খাবারের স্টল এবং অন্যান্য কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়।

জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে এসব অবৈধ স্থাপনার কারণে পার্কের সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছিল, দর্শনার্থীদের চলাচল ব্যাহত হচ্ছিল, এবং নোংরা পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। আগে থেকেই দখলদারদের নোটিশ প্রদান করা হয়েছিল, তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা স্থাপনাগুলো সরিয়ে না নেওয়ায় প্রশাসন উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।

স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় খাদ্য প্রতিষ্ঠান ‘বিজয়ী পিঠা বাড়ি’র উচ্ছেদ ঘিরে সাধারণ মানুষের মাঝেও আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বহু বছর ধরে পার্কে ব্যবসা পরিচালনা করে আসা এক ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা প্রশাসনের কোনো নোটিশ পাইনি। হঠাৎ এসে দোকান গুঁড়িয়ে দিলো। আমাদের জীবিকা এখন অনিশ্চিত।”

ব্যবসায়ীরা বলেন, তাদের ব্যবসাগুলো পার্কের পরিবেশ নষ্ট করছিল না বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল, যেখানে পরিবার ও তরুণরা আসতেন চা-পিঠার আড্ডায়।

সবচেয়ে বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে ‘ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ’-এর বীক্ষণ আসরের মঞ্চ ভেঙে ফেলার ঘটনা। সাহিত্য সংসদের আহবায়ক শামীম আশরাফ বলেন, “এই মঞ্চ ভাঙা মানে ময়মনসিংহের সাহিত্য-সংস্কৃতি, কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি অবজ্ঞা। এ মঞ্চ কোনো বাণিজ্যিক স্থাপনা ছিল না, এটি ছিল মুক্ত চিন্তার প্রতীক।”

বিক্ষুব্ধ কবি ও সাহিত্যিকরা জানান, সাহিত্য সংসদ একটি অরাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, যারা নিয়মিত পার্কের ভেতরে কবিতা পাঠ, বই আলোচনা, নাটক ইত্যাদি আয়োজনে যুক্ত ছিলেন। তারা বিনা নোটিশে মঞ্চ ভাঙার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং এ ধরনের প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘সাংস্কৃতিক নিধন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খোলা স্থান জয়নুল আবেদীন পার্ককে তার মূল সৌন্দর্য ও পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে এই অভিযান অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, “পার্কের ভেতরে কোনোরকম অবৈধ স্থাপনা, রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম আমরা সহ্য করবো না। জনস্বার্থে এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে।”

সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা পার্ককে পরিবার, শিশু ও প্রবীণদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চাই। ইতোমধ্যে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। শিশু পার্ক, ওয়াকওয়ে, ও সবুজায়নের মাধ্যমে এ পার্ককে আধুনিক করে তোলা হবে।”

নগরবাসীর মধ্যে এ অভিযানের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই বলেন, পার্ক পরিষ্কার ও সুগঠিত হলে নাগরিক জীবনে স্বস্তি ফিরবে। অন্যদিকে, অনেকেই মনে করছেন, প্রশাসনের উচিত ছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে সংরক্ষণ করে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর এক সদস্য বলেন, “যেখানে অবৈধতা আছে তা অবশ্যই দূর করতে হবে, তবে সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি সম্মান রেখেই এমন উদ্যোগ নেওয়া উচিত।”

জয়নুল আবেদীন পার্ক, যার নামই বাংলাদেশের অন্যতম চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীনের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে, সেই পার্কের সংস্কার নিয়ে নেওয়া প্রশাসনিক উদ্যোগ যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি বিতর্কের জন্মও দিয়েছে। ভবিষ্যতে এই পার্ক কেমন রূপ পায় তা নির্ভর করবে প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি, জনসম্পৃক্ততা এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উপর। নাগরিকদের প্রত্যাশা, একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ এবং সবার জন্য উন্মুক্ত পার্ক, যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতি একসাথে বাঁচবে।