সকল খবর ময়মনসিংহের খবর

ময়মনসিংহ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতির মহোৎসব; খুঁটির জোড় কোথায় !

অনিন্দ্যবাংলা স্টাফ রিপোর্টার :

প্রকাশ : ৬-৮-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০২৩

ময়মনসিংহ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। দায়িত্বশীল প্রকৌশলীদের ঘুষ বাণিজ্য, বদলি-বাণিজ্য আর টেন্ডার সিন্ডিকেটে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করার নামে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাট হয়ে যাচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। শুধু তাই নয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বেশিরভাগ কাজই মানহীন। 

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বিগত সরকারের মদতদাতা ফ্যাসিস্ট আব্দুল আউয়ালকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী দুর্নীতির চক্র। অভিযোগ রয়েছে, তিনি শুধু ময়মনসিংহ নয়, দেশের অন্তত ১৩টি জেলায় প্রভাব বিস্তার করেছেন। মেকানিক্যাল শাখা ও সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারদের মাধ্যমে তিনি এই বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন, যারা টেন্ডার থেকে শুরু করে বিল উত্তোলনের প্রতিটি ধাপে ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল ছাড়েন না। ফলে প্রকল্পের মালিকানা কাগজে-কলমে থাকে ঠিকাদারদের হাতে, বাস্তবে সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করে সব কিছু। 

উল্লেখ করা হয়, নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে হতদরিদ্রদের জন্য টুইন পিট ল্যাট্রিন তৈরি করা হয়েছে। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ছাড়াই ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সুবিধাভোগীরা ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন কি না, তা দেখার জন্য আইএমইডি একটি প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। তাতেই ধরা পড়েছে সব অনিয়ম ও দুর্নীতি। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাঠপর্যায়ে কাজের নিবিড় পরিবীক্ষণব্যবস্থা দুর্বল থাকায় নকশা অনুযায়ী কাজ হয়নি। জনগণের চাহিদা বিশ্লেষণ না করে শুধু বিশ্বব্যাংক ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার গ্রামীণ পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প” যার বাজেট ছিল প্রায় শত কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রকল্পের কাজের গুণগত মান একেবারেই নিন্মমানের হলেও কাগজে শতভাগ সম্পন্ন দেখানো হয়েছে। একইভাবে ত্রিশাল উপজেলার স্যানিটেশন সুবিধা সম্প্রসারণ প্রকল্পে” প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হলেও মাঠ পর্যায়ে তার অর্ধেক কাজও সঠিকভাবে হয়নি।

ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌরসভায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত পানি সরবরাহের দুই প্রকল্পে অবস্থাও তথৈবচ। ময়মনসিংহের ‘ক’ ক্যাটাগরিভূক্ত ‘গৌরীপুর পৌরসভার শহরে পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধিনে প্রথম ধাপে ব্যয় করা হয় ২কোটি ৭লাখ ১৩হাজার ৫শ ৯০টাকা।, দ্বিতীয় ধাপে ব্যয় হয় ২ কোটি ৮৬লাখ ৭হাজার ৯২০টাকা। পৌরসভার পাম্পচালক পদে দু’কর্মচারীর বেতন দেয়া হয়েছে বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকা।, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই অর্থব্যয়ে শহরবাসীর ভাগ্যে জুটেনি ‘এক ফোঁটা’ পানি।, জল সরবরাহের সকল টাকাই জলে গেছে!

অভিযোগের তালিকায় রয়েছেন ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জামাল হোসেনও। তিনি গত চার বছর ধরে ময়মনসিংহে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এই সময়ে ঘুষ ও টেন্ডার সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগে বারবার আলোচনায় এসেছেন। ঠিকাদারদের দাবি, টেন্ডার দাখিলে চার থেকে সাত শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। কাজ শেষ হওয়ার পর বিল উত্তোলনে দুই শতাংশ এবং জামানত ফেরতের সময় আরও এক শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, শেরপুরে বদলি হওয়ার পর তিনি মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে আবারও ময়মনসিংহে ফিরে আসেন।

এদিকে নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সামিউল হকও একই সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত। জানা যায়, তিনি আগেও কয়েক বছর ময়মনসিংহে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সম্প্রতি মাত্র পনেরো দিনের মধ্যে তিন কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে আবারো ময়মনসিংহে যোগদান করেন। অভিযোগ রয়েছে, বদলির পরও ঘুষ দিয়ে তিনি আবারো ময়মনসিংহে ফিরে আসেন। সম্প্রতি শেরপুর থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে তিনি পুনরায় ময়মনসিংহে যোগদান করেন।

স্থানীয়দের প্রশ্ন, একজন কর্মকর্তা যদি কোটি কোটি টাকা খরচ করে পদে ফিরে আসেন, তবে তিনি সেই অর্থ তোলার জন্য কতটা ভয়ঙ্কর হারে লুটপাট চালাবেন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অফিস কর্মকর্তা জানান, সামিউল সাহেব এর খুঁটির জোর আছে, তার সাথে পেরে উঠা কঠিন। 

স্থানীয় ঠিকাদার আব্দুল কাদের (ছদ্মনাম) অভিযোগ করে বলেন, আমরা কাজ পাই, কিন্তু বিল ছাড়াতে হলে প্রতিটি ধাপে ধাপে ঘুষ দিতে হয়। গ্রামীণ পানি সরবরাহ প্রকল্পে আমি ১ কোটি টাকার কাজ করেছি, অথচ বিল ছাড়াতে আমাকে প্রায় ৬ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ঘুষ না দিলে বিল মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়।”

এমন বাস্তবতায় প্রকল্পের কাজের মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারাকান্দা উপজেলার একাধিক পানির টিউবওয়েল ইতিমধ্যে বিকল হয়ে গেছে, অথচ কাগজে দেখানো হয়েছে সবগুলো সচল। সাধারণ মানুষ বিশুদ্ধ পানির মতো মৌলিক সেবাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, এত অভিযোগ সত্ত্বেও প্রশাসনের নীরবতা। ময়মনসিংহ জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কার্যত কোনো তদন্ত বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকার প্রভাবশালী মহলের সাথে এই কর্মকর্তাদের যোগসূত্র থাকায় কেউ সাহস করে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

স্থানীয় সচেতন মহলের প্রশ্ন; এই প্রকৌশলীদের এমন অব্যাহত দুর্নীতি ও অনিয়মের পরও কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? কারা তাদের এভাবে আড়াল করছে? খুটির জোর কোথায়?

ময়মনসিংহের সচেতন নাগরিক সমাজ বলছে, সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তার সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। তারা অবিলম্বে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর পুরোপুরি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হবে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।