ওপেন মেসেজ প্রবন্ধ-নিবন্ধ

পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহ

মোঃ চাঁন মিয়া ফকির

প্রকাশ : ২০-১২-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০৬৯

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরত্বপূর্ণ ঘটনা সমূহ সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা অস্পষ্ট। অনেক ঘটনাই যেগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে কালের আবর্তনে সে সময়কার ইতিহাসের ঘটনার গুরুত্ব ও উজ্জ্বল দিকগুলো ম্লান হয়ে জাতীয় জীবন থেকে ঝড়ে পড়েছে।

১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রহসনের যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের পর সর্বময় শাসনভার চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে। তাদের নাগপাশ থেকে শাসন ভার পুনরোদ্ধারের জন্যে তাদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৬৩ সালে। ইতিহাসে এটি ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে খ্যাত।

স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাসিম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কবল থেকে বাংলার শাসন ক্ষমতা উদ্ধার কল্পে ১৭৬৪ সালে সর্বশক্তি নিয়ে তার শেষ চেষ্টাই হলো বক্সারের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা, মোঘল সম্রাট শাহ আলম ও ফকির সন্ন্যাসীদের সহায়তা নিয়ে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দুর্ভাগ্যক্রমে তার সম্মিলিত বাহিনী মেজর মনরোর কাছে পরাজিত হয়। ফলে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা রোহিলা খন্ডে পালিয়ে যান। দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম ইংরেজদের পক্ষে যোগ দেন, মীর কাসিম আত্মগোপন করে ১৭৭৭ সালে দিল্লীর রাস্তায় মৃত্যু বরণ করেন। ফলে শুধু মাত্র ফকির সন্ন্যাসীরাই ইংরেজ শাসন বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যান।

ফকির বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন ফকির মজনুশাহ। তাঁর অন্যতম বিশ্বস্ত সংগ্রামী সহযোদ্ধা ছিলেন করম শাহ। ফকির মজনু শাহের মৃত্যুর পর ফকির বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মুসা শাহ, সোবান শাহ, চেরাগ আলী শাহ, করম শাহ, মাদারবক্স প্রমুখ ফকির। মজনু শাহের অনুসারী ফকির নেতাদের মধ্যে করম শাহ ও সোবান শাহের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল অসাধারণ। 

লর্ড কর্ণওয়ালিস, তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাবাহিনী সাম্যবাদী করম শাহ ও তাঁর অনুসারীদের উপর আক্রমণ জোরদার করে। ফলে করম শাহ প্রথমে ভূটান ও পরে নেপালে আশ্রয় গ্রহন করেন। (এ সম্পর্কে সমকালীন কালেক্টর মি. বজের্স মুরংস্থিত কর্তৃক আদিষ্ঠ হয়ে নেপালের সুবার উকিল দেওসিং উপাধ্যয় ২৪ আক্টোবর ১৭৯৪ খ্রি. দুখানাপত্র লিখেন এর একটি করম শাহকে)। করম শাহের ইংরেজ ও অত্যাচারি জমিদার বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জর্জ মরিসন তার ১১৭ পৃষ্ঠার রিপোর্টে করম শাহকে পাগল নেতা (গধফ জবাড়ষধঃড়ৎ) এবং তার বিদ্রোহকে পাগলপন্থী বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেন।

করম শাহের পিতা ছিলেন শের আলি গাজি যিনি দশকাহনিয়া পরগণার শেষ স্বাধীনচেতা মুসলিম শাসক। শের আলি গাজির নামানুসারে দশকাহনিয়া পরগণার নাম হয়েছে শেরপুর। নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর হিন্দু প্রীতি (জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন হিন্দু) ও নন্দী বংশীয় হিন্দুদের চক্রান্তে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ফলে তিনি গারো পাহাড়ের পাদদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার স্মৃতি বিজরিত স্থান গাজীর ভিটা (হালুয়াঘাট) গাজির খামার, গিদ্দাপাড়া (শেরপুর)। পরে হিন্দু জমিদারদের চক্রান্তে নিহত হন। 

পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহে সকল কৌমজনগোষ্ঠীর লোক যেমন হদি, গারো, হাজং, ডালু, বানাই, সবাই স্বতস্ফুর্ত অংশ গ্রহণ করে। পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহের জনক করমশাহ সুসঙ্গ পরগণার শঙ্কর পুর পরে লেটির কান্দা থেকে আন্দোলন পরিচালনা করেন। তিনি ১৮১৩ সালে ১০৩ বছর বয়সে লেটিরকান্দায় মৃত্যুরবণ করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছফ্যাতি শাহ গারো পাহাড় অঞ্চলে কৌম জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে শম্ভু, ডোগর, কাঞ্চি, গেছুয়া মেওয়া, বুধুগিরি ইত্যাদি মৌজার আবরী গারোদের তিনি শিষ্য করেছিলেন। তিনি পার্বত্য অঞ্চলের সকল আদিবাসীসহ অন্যান্য অধিবাসীদের নিয়ে স্বাধীন বা অর্ধ স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ছফ্যাতি শাহের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই অত্রাঞ্চলবাসীকে জমিদারদের শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করা যাবে। জমিদারগণও তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তা পণ্ড করার জন্য ইংরেজ শাসকদের সাথে যোগাযোগ করে। পাশাপাশি প্রচারণা চালায় ছফ্যাতি শাহ্্ তার নিজস্ব আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এইরূপ হীন অপপ্রচারের ফলে গারো, হাজং প্রভৃতি উপজাতিরা ছফ্যাতি শাহের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। জমিদারদের ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্রের ফল স্বরূপ শিষ্যদের মধ্যে  অসন্তোষ ও ইংরেজ শাসকের গ্রেপ্তারী প্রচেষ্টার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি শঙ্করপুর থেকে মাকে নিয়ে আত্মগোপণ করে ময়মনসিংহ পরগণার যোগীর গুহায় (নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলায় ১২ নং বৈরাটী ইউনিয়নে অবস্থিত) চলে যান। আত্মগোপন করার ফলে ছফ্যাতিশাহ নামটি ছাপা পড়ে তিনি মেঘা পাগল নামে পরিচিত হন। তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা যোগীর গুহা ফকির বাড়িতে বসবাস করছেন। 

ছফ্যাতি শাহ্ আত্মগোপন করলেও স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৮০২ সালে নাসিরাবাদ জেলা কালেক্টর লিঃ গ্রোসের মাধ্যমে গারো পার্বত্য অঞ্চলটি জমিদারদের হাত থেকে মুক্ত করে পৃথক একটি জেলায় পরিণত করে রাজস্ব আদায়ের ভার গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। কালেক্টর লিঃ গ্রোস রাজী হলেও স্থানীয় অত্যাচারী জমিদারদের ষড়যন্ত্র, করম শাহের পুত্র হওয়া ও ইংরেজদের মুসলিম বিদ্বেষের ফলস্বরূপ গভর্ণমেন্ট তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন।

করম শাহের কনিষ্ঠ পুত্র টিপুশাহ  আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। করমশাহ পিতার রাজ্য উদ্ধারে সচেষ্ট ছিলেন পারেননি তবে সংগঠিত করেছিলেন, করমশাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছফ্যাতি শাহও স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হন। জনশক্তি বৃদ্ধি ও জমিদারদের প্রজাপীড়নের বিষয়কে পুঁজি করে টিপু শাহ পিতামহের হারানো রাজ্য পুনরোদ্ধারে সচেষ্ট হন। তিনি পিতার উত্তরসূরী হিসেবে পাগলপন্থী মতবাদ প্রচার শুরু করেন।

শেরপুরের জমিদারদের শরিকী বিবাদ ও কৃষক প্রজাদের উপরে উত্তরোত্তর খাজনা বৃদ্ধি টিপুর প্রজাসেবা হারানো রাজ্য উদ্দারের সুযোগ এনে দিয়েছিল।

শেরপুরের হিন্দু চৌধুরী উপাধী প্রাপ্ত (নন্দী) জমিদারদের মধ্যে শরিকী বিবাদে সংঘর্ষে ক্ষিপ্ত শরিকগণ গারো, হাজং, হদি প্রভৃতি রায়তদের দিয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করতেন। ক্ষিপ্ত পক্ষগণের সংঘর্ষে গোটা এলাকাটিতে হিংসা, জোর জবর দস্তি, রক্তপাত ও হত্যার রাজত্ব কায়েম হয়েছিল।

১৮১৮ - ১৯ সালে মি: হ্যারিটন এর শরিকী বিবাদের মিমাংসার চেষ্টা ব্যর্থ হলে শরিকদের মামলা চালাবার খরচ খাজনা হিসাবে প্রজাদের ঘাড়ে চাপে।

জামালপুর থেকে শেরপুর হয়ে সুসঙ্গ পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণে প্রজাদের বেগারশ্রম দেওয়া থেকে প্রতিরোধে টিপুর নেতৃত্বে পাগলপন্থীরা সক্রিয় হন। ফলে ফুলপুরের বালুরঘাট মৌজায় রাস্তা নির্মাণে হদিরা অপারগতা প্রকাশ করে।

ইঙ্গ ব্রহ্মযুদ্ধ উপলক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃর্তৃক শেরপুরে জড়ো করা উট ঘোড়া সমেত ১৭ হাজার জন্তু ও ৫ হাজার লোকের খাওয়া এবং আনুষাঙ্গিক খরচের দায়িত্ব বর্তায় নিরীহ রায়তদের ঘাড়ে। এছাড়াও জমিদার বাড়ীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, বিয়ে, কোথাও কোন পার্বন উপলক্ষে খরচা এই সকল কিছুর খরচ রায়তদের বহন করতে হতো। জমিদারের অসাধু কর্মচারীরা অরাজকতার সুযোগে রায়তদের কাছ থেকে একবার খাজনা আদায় করে কাগজপত্র গোপন করে পুনরায় খাজনা দাবী করত। দ্বিতীয় বার খাজনা দিতে অস্বীকার করলে অত্যাচার নির্যাতনের সীমা থাকত না। খাজনা দিতে অপারগতা প্রকাশের জন্যে অভিযুক্ত প্রজাদের ধরে নিয়ে জমিদার বাড়ীর মৃত্যুকুপ গুলিতে নিক্ষেপ করা হতো ও অবাধ্য প্রজাদের কাকুরা ধান (এক প্রকার লম্বা পুংওয়ালা ধান) খাইয়ে হত্যা করা হতো। সুসঙ্গ পরগণায় জমিদারের হাতি ধরার কাজে হাজং সম্প্রদায়ের লোকজনদের প্রায়ই হাতির আক্রমণে প্রাণ দিতে হতো। সবকিছু মিলে সামাজিক পরিস্থিতি ও আইন ব্যবস্থার অসম লড়াইয়ে কৃষকদের উপর চলে জুলুম নামের নিলজ্জ নির্যাতন। 

এই চরম অবস্থার ফল স্বরূপ জমিদার ও সরকারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াল কৃষক প্রজা সহ সমগ্র রায়তরা। তাই ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে হলো পাগলপন্থী বিদ্রোহের চরম সময় যা চলে পঞ্চাশ বছর ধরে। লড়াইটি চলে কোথাও সশস্ত্রভাবে, কোথাও নিরস্ত্র, কখনও আইনি, কখনও বা বে-আইনীভাবে কোথাও ব্যক্তি বা কোথাও সমাষ্টিগতভাবে। বিদ্রোহী শেরপুর অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহে টিপু শাহ মূল উৎস নন। নানা প্রকার করভার ও বেগারিতে জর্জরিত কৃষক প্রজার সহ্যের বাধ ভেঙ্গে গেলেই বিদ্রোহের সুচনা ঘটে এবং বিদ্রোহী কৃষকগণ তাদের পীর ধর্মীয় নেতাকে সামনে পেয়ে তাদের নিজেদের আন্দোলনের প্রধান নেতা নির্বাচন করে। দশকাহনিয়ার শেষ স্বাধীন শাসক শের আলী গাজীর পৌত্র, পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহের জনক করম শাহ্্ পাগলপন্থী ফকিরের কনিষ্ঠ্য পুত্র, আধুনিক উদার হৃদয়ের ব্যর্থ রাষ্ট্র নায়ক ছফ্যাতি শাহ্্ পাগলপন্থী ফকিরের ছোট ভাই টিপু শাহ পাগলপন্থী ফকির অবস্থার প্রেক্ষিতে নেতৃত্ব ঘাড়ে নিতে বাধ্য হন। 

এখানে আরো একটি বিবেচ্য বিষয় যে, শেরপুরের হিন্দুদের জমিদারি প্রাপ্তির বিষয়টি শের আলী গাজী (শের খা গাজী) উত্তরাধিকারীগণের নিকট অসহনীয় ছিল। হিন্দু জমিদারদের চক্রান্তে বা পিতামহের অপরাধের জন্য ভবিষ্যত বংশধরদের প্রাপ্য জমিদারী চলে যাওয়ায় ব্যাপারটা শের আলী গাজীর ওয়ারিশগণ মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি তা ইতিহাসের গতি প্রকৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। কারণ তারা পাগলপন্থী হলেও সংসার বিরাগী নন। তাদের চালচলনে রাজকীয় হাবভাব, অনুচর পরিবেষ্ঠিত হয়ে চলা ফেরা ইত্যাদি দেখে পরিস্কার বুঝা যায় যে, তাদের জমিদারি অর্জনের প্রবল ইচ্ছা রয়েছে। ছফ্যাতি শাহের জমিদারি লাভের চেষ্টা ও কৃষক বিদ্রোহের এক পর্যায়ে টিপু শাহ কর্তৃক শেরপুর অঞ্চলের আধিপত্য গ্রহণের মাঝে তাদের সামন্ত চরিত্রের সবকিছুই প্রতিফলিত হয়।

বিদ্রোহের গোড়া থেকেই টিপু শাহকে আটকে রাখার জন্য জমিদাররা ইংরেজ শাসকদের কাকুতি মিনতি করত। কারণ বিরোধী পক্ষ হিসেবে ক্ষমতার বিপরীত কেন্দ্রকে তারা সহজেই বুঝতে পেরেছিল।

আবার এ ক্ষেত্রে পীর টিপু শাহ পাগলের নিজস্ব ভূমিকা গৌণ, কৃষকগণের ও সর্বসাধারণের বিশ্বাসই তাকে অসাধারণ ব্যক্তি ও নেতায় পরিনত করেছে। লোক মুখে কথিত যে, বার বার টিপুকে ইংরেজ কর্তৃক ছেড়ে দেওয়ায় জমিদার পক্ষ মনে করেছিল জেলা প্রশাসন ঘোষ খেয়েছেন। আবার কৃষকরা মনে করেছিল যে পীর টিপু শাহ্্কে আটকে রাখার ক্ষমতা জেলা শাসকের নেই।

৪ ও ৫ ডিসেম্বর ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু জমিদারগণ ইংরেজ প্রশাসনকে জানায় যে, হদি এবং অন্যান্যরা রাস্তা নির্মাণ করতে অস্বীকার করেছে। তারা টিপু-র নেতৃত্ব মানবে অন্য কারো নয়। তারা টিপু শাহ্কেই তাদের সুলতান মনোনিত করেছেন। শেরপুর ও সুসঙ্গ পরগণায় বিভিন্ন স্থানে কৃষক প্রজাদের আন্দোলন তুঙ্গে উঠে গেছে। বাধ্য হয়ে জমিদারদের অনুরোধে ইংরেজ শাসক ০৮ই জানুয়ারী ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে টিপু শাহ্্ কে বন্দি করে। পাগলপন্থী কৃষক প্রজাদের স্বশস্ত্র অবস্থান ও আন্দোলনের চাপের মুখে জেলা শাসক আবার তাকে জামিনে মুক্তি দেয়।

২৬ জানুয়ারী টিপুর ডান্ডাবেড়ি খুলে দেন এবং তার পাগল অনুসারীদেরও ছেড়ে দেন। টিপু শাহ্্-র শিকল মুক্তি এবং পাগলপন্থিদের মুক্তি সারা অঞ্চল জুড়ে টিপুর অলৌকিক মাহাত্মা ও শক্তি প্রচার করে। কৃষক জনতা উৎসাহিত হয়। টিপু শাহ পাগল এখানে বিদ্রোহী ক্ষমতার প্রতীক ইংরেজ শাসক ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক জনতার বিদ্রোহের প্রেরণার উৎস।

পাগলপন্থী বিদ্রোহে সকল শ্রেণির কৃষক অংশ নিয়েছিল। দলিলে স্পষ্ট যে, হাঙ্গামা শুরু হবার এক মাসের মধ্যেই অন্যান্য রায়তরা পাগলদের সঙ্গে হাত মেলায় এবং প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেয়। পাগলপন্থী ঐতিহ্য অনুসারে বিদ্রোহী প্রজারা তার কাছে আসবার পরই তিনি জনসভায় প্রজা বিক্ষোভ প্রসঙ্গে তার নিজস্ব বক্তব্য রাখেন। তারা কুটুরাকান্দা মান্দাকালি ইত্যাদি গ্রামের জনসভা করে টিপু শাহ এতে বক্তব্য রাখেন। শিষ্যদের চাপ, ঘটনার তাগিদ, ধর্ম-প্রচারকের দায়িত্ব এবং জনগণের প্রত্যাশা ও সামগ্রিক ভাবে শেরপুরের ঐতিহাসিক পরিমন্ডলই দরিদ্র নির্যাতিতদের বন্ধু তাপস পাগলপন্থী প্রচারক করম শাহের পুত্র টিপু শাহকে একজন দক্ষ সমাজ বিপ্লবীতে রূপান্তরিত করেছিল। ’ 

তখন সময়টা ছিল ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারী মাস। ৮ জানুয়ারী ১৮২৫ খ্রিঃ তদন্ত কারী দারোগা বালুঘাট গিয়ে দেখেন যে কেনা হত্রি, দিতু হত্রি; ও বিসুম হত্রি তাদের প্রত্যকের নেতৃত্বে আনুমানিক ৮০/৯০ জন করে অন্যান্য লোকজন সহ ৪/৫ শত লোক যাদের মধ্যে হত্রি, ডালু, রাজবংশী ও মুসলমান লোকের জমায়েত রয়েছে। তারা বেগারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় ও তারা তাদের পাগল পীরের আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। তারা একই ধরনের দাবি তাদের পাগল পীরের কাছেও জানায়। সে সম্পর্কে পীরের বক্তব্য জমিদারের প্রতিক্রিয়া কুটুরাকান্দার সভায় কুড় প্রতি চার আনা খাজনা প্রদানের দাবি জানায়।

একই দিনে শেরপুর জমিদারদের ধন সম্পদ রক্ষার জন্য সেপাই পাঠানো হয়। জমিদারদের বারবার অনুরোধে টিপু শাহ্্ পাগলকে ৮ জানুয়ারি প্রেফতার করা হয় ও ৯ জানুয়ারী জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। ফলে কৃষক প্রজা বিদ্রোহ এতই ব্যাপক রূপ নেয় যে, বিদ্রোহীরা পুলিশের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে, জমিদারদের কর্তৃত্ব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরগনায় সরকারী কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়।

বিদ্রোহী পাগলপন্থী প্রজা সাধারণ লেটির কান্দার জনসভায় এক বাক্যে ঘোষনা দিয়েছিল। ‘আপনার (টিপু শার) পূর্ব পুরুষরা শেরপুরের শাসক ছিলেন। বর্তমান সময়ে আমরা আপনাকে আমাদের সুলতান মনোনিত করিলাম।’ ১৩ জানুয়ারী ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ লেটিরকান্দার সভায় টিপু শাহ শেরপুর রাজ্যের কর্তৃত্বভার গ্রহণ করেন। কৃষক বিদ্রোহের নেতা পাগলপন্থীদের স্মৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক টিপু শাহ প্রজাতন্ত্রের আদর্শ নীতিমালা ঘোষণা করেন। ুটিপু শাহ ঘোষণা করেন খোদা তালার নামে প্রজাদের সম্মতিক্রমে আমি শেরপুর পরগণার শাসন ভার গ্রহণ করিলাম। এ রাজ্যে কেহ চৌর্যবৃত্তি, দস্যুবৃত্তি, নরহত্যা, পরদার করিতে পারিবে না। কেহ কুসীদ প্রদান করিতে পারিবে না, কিন্তু আসল টাকা প্রত্যার্পণ করিতে হইবে। ধান্য কর্জ দিয়া কেহ অতিরিক্ত ধান্য গ্রহণ করিতে পারিবে না। উৎকোচ গ্রহণ, পণ নেওয়া, শরাব পান করা, মিথ্যা কথা বলা, ছল করা, জুয়াচুরি করা, কম ওজন দেয়া, গুরুজনকে অভক্তি করা, নিন্দা করা, মন্দ কাজে সাহায্য করা কাহাকেও অন্যায় কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি কার্য্য পরিত্যজ্য। প্রতি কুড় জমির মাত্র চার আনা খাজনা দিতে হবে। সকল জাতিকে প্রীতির চোখে দেখিবে। গরীব দুঃখীকে সাহায্য করিবে। কেহ কাহাকেও তাহার ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে পারিবে না। খোদা তালার প্রতি অচলা ভক্তি রাখিয়া সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকিব।”

লেটিরকান্দায় বিশাল জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, ভূমির মালিক খোদা ভূমির উপর কাহারও একাধিপত্য থাকিতে পারে না। সকল মনুষ্যই খোদা তালার সৃষ্ট। ভূমির উপর প্রত্যেকেরই অধিকার আছে। টিপু শাহ পাগলপন্থী ফকিরের ধর্মমতের মূলমন্ত্র ুসকল মনুষ্যই ঈশ্বর সৃষ্ট, সুতরাং কেহ কাহারও অধীন নহে” হাজার হাজার নির্যাতিত প্রজা এই সাম্য মতের আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে ও জমিদারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সবাই জনসাধারণ, সবাই লড়াকু সৈনিক, বড় বড় দলে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা জমিদারদের খাজনা দিতে মানা করছে এবং টিপু শাহ-র পাগলের নামে ও মা সাহেবের নামে সুলতানি, শিরনি ও খাজনা আদায় করছে। পরগনায় পুলিশ নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। বিদ্রোহীদের সামনে কেউ যেতে সাহস করছে না। অবস্থা দৃষ্টে দেখা যাচ্ছে যে, জনসাধারণই সার্বভৌম।

যে যে গ্রামে জমিদার তার কর্তৃত্ব কায়েম করার চেষ্টা করেছিল সেই সেই গ্রামেই পাগলরা পাইক ও পেয়াদাদের মোকাবিলা করেছিল। জমিদারি পাইকদের বিরুদ্ধে কৃষক ফৌজ গড়ে উঠে ছিল। 

ইংরেজ প্রশাসন বিদ্রোহ দমনের জন্য ভীতু ও অযোগ্য দারোগা সিপাহীদের বদলে সাহসী ও যোগ্যদের বদলি করল। দারোগা ফারুক হোসেন সিপাহীদের নিয়ে বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি দোহালিয়ার মজকুরি পেয়াদাদের কড়ই বাড়ির পাহাড়ি এলাকা তেকে মুক্ত করল। 

বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচর দুলাল চরের আহ্বানে ফারুক দারোগা তার দলবল নিয়ে পাগল সর্দার দুকু জোয়ারদারকে গ্রেফতার করার জন্য বন্দরকাটা গ্রামে আসে। ফলে উভয় দলের সংঘর্ষে দারোগা ও সিপাহীরা পরাস্থ হয়ে পলায়ন করে। এই যুদ্ধে দুকু জোয়ারদারের সহযোগী সর্দারারা ছিল কেশব হাজং, রাম হরি ডালু, জনসিং বানাই, নন্দরাম বানাই, বিষ্টু বানাই ও আনধারু বানাই। 

বন্দরকাটার যুদ্ধের পর ড্যামপিয়ার সাহেব সিপাহি সমেত চাঁদকোন্ডায় হাজির হলেন। সেখানে ১৫০০ বিদ্রোহী এগিয়ে আসলে নাসিরাবাদ থেকে সেনা চলে আসায় ড্যামপিয়ার সাহেব প্রাণে বেঁচে যান। 

পাগলপন্থীদের মুল এলাকা শেরপুর, ঘোষগাঁও ও নাটেরকোনা থানা। ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাংশে পশ্চিম থেকে পূর্বে বিস্তৃত কড়ই বাড়ি সংলগ্ন পাহাড়ের নিম্ন ভূমিতে পাগলপন্থী ভক্তরা বাস করত। এই বিস্তৃর্ণ এলাকার কৌম জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সংঘর্ষে সাহসিকতার সাথে অংশ নেয়। যেমন বকসা বইদ এর সংঘর্ষে জীবন বকসী ও গোপী হত্রি, মদন কালা ও চৈতন কালার সংঘর্ষে বুড়া সরকার, দোহালিয়ার আক্রমণে বেচা রাজ বংশী, নিধু মন্ডল, তেলাকি পাথর ও শঙ্কর হত্রি প্রমুখ সরদাররা।

জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হয় ঘেরাপচার সানু পাগল, যথার্থপুরের মকরম পাগল, রাঙ্গামাটিয়ার জানুখাাঁ প্রমুখ টিপুর সাহসী শিষ্যরা।

১৯ জানুয়ারী বিদ্রোহীরা ৭ - ৮ শত সশস্ত্র লোকজন শেরপুর জমিদার বাড়ী আক্রমণ করে  জমিদার বাড়ী লুট করে এবং আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। জমিদারগণ ভয়ে ভীত হয়ে স্বপরিবারে শেরপুরের মৃগী নদীর অপর তীরে কালীগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেট ড্যামপিয়ার সাহেবের কাছারিতে আশ্রয় নেন।

খন্ড খন্ড যুদ্ধের মাঝ দিয়ে শেরপুর পরগণার পাগলপন্থীদের স্বাধীন রাজ্যের শাসন কার্য চলতে থাকে। টিপু শাহের এই স্বাধীন রাজত্ব ১৮২৫ থেকে ১৮২৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল। সে সময়ের মধ্যে বিদ্রোহী পাগলপন্থীদের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর যে কয়েকটি খন্ড যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল সব কয়টিতেই বিদ্রোহীরা জয়ী হয়েছিল। ইংরেজ শাসক ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে জামালপুরে সেনা নিবাস স্থাপন করে। ড্যাম্পিয়ার সাহেব কুটচালের মাধ্যমে টিপু শাহ্্ কে পরাস্থ করার পরিকল্পনা করেন। তিনি টিপু বিদ্রোহীদের কর্মকান্ডের সংবাদ আহরনের জন্য সংবাদ পিছু ২০/- টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। সেই যে বিশ্বাস ঘাতক মির্জাফরী বীজ তাদের সহায়তায় ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে ড্যাম্পিয়ার এর সহযোগী রাধাচরণ দারোগা ১০ জন বরকন্দাজসহ গড় জরিপায় প্রবেশ করে কৌশলে টিপু শাহ পাগলপন্থী ফকিরকে বন্দি করে। অতপর ময়মনসিংহ সেশন জজের বিচারে টিপু শাহের যাবৎ জীবন কারাদন্ড হয়। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে, ১২৫৯ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য মাসে এই মহান স্বাধীনতাকামী মানুষটি কারাগারে মৃত্যু বরণ করেন। পূর্বধলার লেটিরকান্দায় পারিবারিক গোরস্থানে টিপু শাহ কে সমাহিত করা হয়। 

সীমিত গন্ডিতে, সীমিত ভূ-ভাগে, সীমিত শক্তিতে জমিদার ও ইংরেজদের মহাপ্রতাপ ও মহাশক্তির সামনে এ পাগলপন্থী আদর্শে অনুপ্রাণিত লোকগুলোর জাগ্রত অধিকারবোধের সমন্বয় ও সংগ্রামী কর্মকান্ডের একতা ও গতি যে কি রকম দুর্বার হয়ে উঠেছিল তা ভাবতে অবাক লাগে। সংগ্রামের চুড়ান্ত পরিণতির কথা জেনেও নির্ভীক চেতনায় পরবর্তী মুক্তি সংগ্রামের জন্য তারা যে পথটি দেখিয়ে গেল সে পথ বেয়েই তো আমাদের সামাজিক স্বাধীনতা ও মুক্তির ধারা এগিয়ে চলেছে। বিপ্লবের উত্তাল দিনগুলোতে সংঘর্ষে শহীদ হওয়ার যে নজির তারা রেখে গেছেন সেটা আমাদের জাতীর মুক্তি সংগ্রামের জন্য এক ঐতিহ্যবাহী মহান প্রেরণা।

আমাদের উনিশ শতকের ইতিহাসে স্বশাসন প্রতিষ্ঠার নজির সৃষ্টিকারী পুরুষ পাগল নেতা টিপু শাহ পাগলপন্থী ফকির ইংরেজদের কারাগারে জীবনের শেষ ২৫ বছর ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করে তিনি আমাদের জাতীয় সম্মানির অধিকারী হয়েছেন। তার পিতা পাগলপন্থী ধারার প্রবর্তক করমশাহ, বড় ভাই আধুনিক রুচিসম্মত শিক্ষানুরাগী ব্যর্থ রাষ্ট নায়ক ছফ্যাতি শাহ। তারা শুধু পীর দরবেশ নন, গণনায়কও ছিলেন। লেটিরকান্দা পাগলবাড়িতে করম শাহ, টিপু শাহ ও ছফ্যাতি শাহ পাগলপন্থী ফকিরের মাজার বিদ্যমান। প্রতি বছর মাঘ মাসে সপ্তাহব্যাপী তাদের পবিত্র মাজারে ওরশ উপলক্ষে সকল আশেকান ও মুরিদানগণ জমায়েত হয় এবং মিলাদ মাহফিল ও হালকায়ে জিকিরে  অংশ  গ্রহণ করে দোয়া মাহফিল পরিচালনা করে থাকেন। স্বাধীনতাকামী, মানবদরদি, দেশপ্রেমিক বীর পুরুষদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।  

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্য সূত্র:

* ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ, শ্রীকেদারনাথ মজুমদার।

* ইমান ও নিশান (বাংলার কৃষক চৈতন্যের এক অধ্যায়), গৌতম ভদ্র।

* ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন, দরজি আব্দুল ওয়াহাব।

* নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস, আলী আহাম্মদ খাঁন আইয়োব।

* বৃহত্তর ময়মনসিংহের ইতিহাস- মো. রফিকুল হক আখন্দ।

* ধর্ম ও পূর্ব ভারতে কৃষক আন্দোলন (প্রবন্ধ) বিনয় চৌধুরী (চতুরঙ্গ ৪৯ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ১৯৮৮)

* বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খাঁন।

* জামালপুরের গণ-ইতিবৃত্ত - গোলাম মোহাম্মদ।

* প্রান্তিক নৃ-গোষ্ঠীর বিদ্রোহ - আলী আহাম্মদ খাঁন আইয়োব।

* ময়মনসিংহের চরিতাভিধান - দরজি আব্দুল ওয়াহাব।

* শামছউদ্দিন ফকির (কুশাই ফকির)।

টিকা-

গিদ্দাপাড়া: গিদ্দাপাড়া শেরপুর সদর উপজেলার গাজীর খামার ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এখানে শের আলী গাজীর সমাধি রয়েছে। 

গাজীর ভিটা : - গাজীর ভিটা ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার গাজির ভিটা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এখানেই শের আলি গাজি আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। 

শালকোণা :- শালকোণা বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার ধুবাউড়া উপজেলায় বাঘবেড় ইউনিয়নের গারো পাহাড়ের পদদেশে অবস্থিত একটি গ্রাম। এখানে করম শাহ মাকে নিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। 

লেটির কান্দা : লেটির কান্দা বর্তমান নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলায় ঘাগড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম।  এটি কংস নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। এখান থেকেই পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল। এখানে থেকেই করম শাহ টিপু শাহ কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁদের বাড়িটি পাগলবাড়ী হিসেবে পরিচিত। এখানেই ফকির বিদ্রোহে মজনু শাহের সহযোদ্ধা ও পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহের জনক করম শাহ, তার চারজন স্ত্রী, জেষ্ঠ্য পুত্র ছফ্যাতিশাহ, কনিষ্ঠ পুত্র টিপু শাহের সমাধি রয়েছে।   

যোগীর গুহা : যোগীর গুহা বর্তমান নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলার ১২নং বৈরাটী ইউনিয়নে অবস্থিত একটি গ্রাম। এটি সুরিয়া নদীর উত্তর তীরে ও নদী সংলগ্ন বাউশাইল বিলের উত্তর ও পশ্চিম পাশে অবস্থিত। সুরিয়া নদীটি মোঘল আমলে গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ছিল। এই পথে স্বাধীন শাসক ওসমান খান তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে বোকাইনগর থেকে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন। ুছফ্যাতি শাহ তাঁর বসবাসরত মনোরম গ্রামটি পীরোত্তর ভূমি (পীরপাল ননবাদশাহি লাখেরাজ) হিসেবে পান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লক্ষ্য ছিল অধিক মুনাফা অর্জন তাই বিভিন্ন চুতায় লাখেরাজ সম্পত্তির বাজেয়াপ্তি করণ চলে। পীরোত্তর গ্রাম যোগীর গুহা এর পীর লাখেরাজ ভূমির সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ছফ্যাতি শাহের পৌত্র মজম ফকির। তবে এখনও পীরমাতার (ছফ্যাতি শাহের মা) সমাধি সংলগ্ন কিছু ভূমি পীরপাল হিসেবে আছে। (প্রবন্ধ - যোগীর গুহা, প্রতিদিনের কাগজ, সোমবার ০৩ মে, ২০২১ খ্রী. ও সাপ্তাহিক চরকা - রবিবার ১৬ এপ্রিল - ২০২৩ খ্রী:)।