ওপেন মেসেজ সম্পাদকীয়

প্রতিহিংসামুক্ত রাজনীতি দিয়েই শুরু হোক ‘নয়া বন্দোবস্ত’

সাইফুর রহমান তপন

প্রকাশ : ১৭-৪-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০৩৩

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে ২০২২ সালের ১২ নভেম্বর সকালে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভোট শেষে বিকেলে ঢাকায় ফেরার পথে ভাড়া করা গাড়ির মালিক-কাম চালক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে। তিনি নির্বাচনের শান্ত পরিবেশ দেখে বিস্মিত। তাঁর নিজের এলাকা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া হলে নাকি কয়েক দফা মারামারি হতো, সুষ্ঠু ভোট দূরের কথা।

কথায় কথায় জানালেন, তিনি বিএনপির ইউনিয়ন কমিটির নেতা। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর এলাকায় ‘টিকতে না পেরে’ ঢাকায় চলে এসেছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য নানা ব্যর্থ উপায় শেষে রেন্ট-এ-কার চালাচ্ছেন। জমি বিক্রি করে গাড়িটা কিনেছেন। আলাপের মাঝখানে হঠাৎ বলে বসলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না; কখনও না কখনও তাকে যেতে হবে। সেদিন যদি বেঁচে থাকি, কিছু লোককে প্রাণে মারব না, তবে এমন শাস্তি দেব, যাতে আমৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে।’

সত্যিই আঁতকে উঠলাম। এত জিঘাংসা কেন? বললেন, ‘দেখবেন, কত জায়গায় আওয়ামী লীগারদের স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে।’

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর ওই ভদ্রলোক এলাকায় ফিরেছেন কিনা, জানি না। ক্ষোভ মিটিয়েছেন কিনা, তাও জানি না। তবে ৫ আগস্টের পর ঢাকাসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে; অনেককে যেভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে; তাতে ওই বিএনপি নেতার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে।

এই সময়ে বহু স্থানে আওয়ামী লীগ সমর্থকদেরও বাড়িঘরে হামলা চলেছে। রেহাই পায়নি এমনকি ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা হয় আওয়ামী লীগ করেন অথবা দলটিকে ভোট দেন।

কোনো দলকে সমর্থন করা বা ভোট দেওয়া কীভাবে অপরাধ হয়, আমি জানি না। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ কেউ বলেছেন, এ হলো ‘জনরোষ’, কিংবা ঘটনার প্রাবল্য অস্বীকার করে বলা হয়েছেু ‘নতুন স্বাধীনতা’ উদযাপন করতে গিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে।

সরকার জনরোষ বললেও, বাস্তবে এসব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে চলমান প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই র‍্যাডিকেল অংশ নিয়ে গঠিত জাসদ ছিল প্রধান বিরোধী দল। তখনও ক্ষমতাসীনদের অভিযোগ ছিল, জাসদ রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। আর জাসদের অভিযোগ, ওই অভিযোগ তুলে তৎকালীন সরকার তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের শাসনামলেও সরকার ও প্রধান বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ তুলেছে।

১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন দুই জোট পাঁচ বাম দলকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনকে উচ্ছেদ করে। এরপর দুই দল মিলে সংসদীয় শাসন পুনঃপ্রবর্তনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে কার্যত নতুন যাত্রা শুরু হলেও ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের বিষময় সম্পর্ক এতটুকু বদলায়নি। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে সরকার গঠন করেছে। প্রতিবারই পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের অভিযোগ নতুন মাত্রা পেয়েছে।

২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি-জামায়াত জোট। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, দলটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধ অনুযায়ী, ‘ওই সময়ে ২৫ হাজারের বেশি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। পঙ্গু হয় হাজার হাজার নেতাকর্মী; ধর্ষণের শিকার হয় শত শত নারী, এমনকি শিশু।’  

অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮২৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৫০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৫ (প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)। দলটির আরও অভিযোগ, ওই সময়ে তাদের কয়েকশ নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। বিরোধীপক্ষ থেকে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অতীতে তেমন শোনা যায়নি।

অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিল, ৫ আগস্টের পরের রাজনীতি হয়তো নতুন রূপ নেবে। দীর্ঘ সাংঘর্ষিক রাজনীতি প্রধান দুই দলের জন্য কম দুর্ভোগ বয়ে আনেনি। এবার হয়তো উভয়েরই কিছুটা হলেও বোধোদয় হবে; অবসান হবে প্রতিহিংসার রাজনীতির। বাস্তবতা কিন্তু তা বলছে না।

এই সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার কথিত দোসরদের বিরুদ্ধে যত হত্যা মামলা হয়েছে, তার প্রায় সবক’টির সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী যুক্ত। অন্তত সংবাদমাধ্যমের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো তা-ই বলে। এ নিয়ে ব্যাপক মামলা বাণিজ্য প্রধানত এ দুই দলের নেতারাই চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ।

এটা ঠিক, বিশেষত নির্বাচন প্রশ্নে বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এক প্রকার বিরোধ আছে। কিন্তু সেটা মূলত কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। মাঠে এখনও উভয় দল মোটামুটি ভাগাভাগি করেই আওয়ামী লীগের পলাতক ও বিপন্ন নেতাকর্মীর সহায়-সম্পদের দখল নিয়েছে। এখনও বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীকে এই দুই দলের লোকেরাই মারধর করছে। মামলা না থাকলেও পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। এমনকি জামিন পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগের লোকেরা ‘মব সন্ত্রাস’ থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী যা-ই মনে করুক; বিশেষত রাজনৈতিকভাবে বিরোধীপক্ষকে মোকাবিলা না করে তাদেরকে দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েই ৫ আগস্ট ডেকে এনেছে। শত চেষ্টা করেও তারা বিএনপি দূরস্থান, জামায়াতকেও দুর্বল করতে পারেনি। ভবিষ্যতে যে উল্টোটা ঘটবে নাু তা বলা যায় না।

আন্দোলনের ধাক্কায় আওয়ামী লীগের কাঠামো ভেঙে পড়েছে ঠিক, কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠন হিসেবে তার শিকড় অনেক গভীরে। চলমান দমনপীড়ন বরং দলটির কোটি কোটি কর্মী-সমর্থককে কাছাকাছি আনবে। দলটিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু হিংসা যেহেতু অধিকতর হিংসার জন্ম দেয়, তখন দলটি আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। জুলাই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড পরিচালনার জন্য তৎকালীন সরকারের সদস্যদের স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে বিচার করা এক কথা। আর এই অভিযোগে ওই দলের নেতাকর্মীর ওপর পাইকারি হারে দমনপীড়ন চালানো সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।

সত্য, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শুধু বিএনপি নয়, জামায়াত, সদ্যগঠিত এনসিপিসহ প্রায় সব দল সক্রিয়। বিএনপি বরং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি সমর্থন না করে এনসিপি ও জামায়াতের কাছ থেকে বদনাম কামাচ্ছে আওয়ামী পুনর্বাসনকারী হিসেবে। কিন্তু বাস্তবে বিএনপিই এখন দেশের প্রধান দল। মাঠ পর্যায়ে তারই আধিপত্য বেশি। মাঠের বাস্তবতাও তার চেয়ে অন্য কারও বেশি বোঝার সুযোগ নেই।

যে যা-ই বলুক, আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে তাতে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। অন্তত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের বার্তা এমনই। অর্থাৎ বিএনপি-আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক দ্বিদলীয় রাজনীতির অবসান ঘটানো সহজ নয়। তাই ঊষর জমিতে ফসল ফলানোর বৃথা চেষ্টা না করে, রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনাই হতে পারে রাজনীতির নয়া বন্দোবস্ত। তা শুরু হতে পারে প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির অবসান ঘটানোর মধ্য দিয়ে। সেখানে বিএনপিকেই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল