ওপেন মেসেজ উপ-সম্পাদকীয়

আওয়ামী লীগের ১৭১ সূর্যসন্তান; পথভ্রষ্টতার ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে পরিবর্তনের পথ অনুসন্ধান

শেখ মেহেদী হাসান নাদিম

প্রকাশ : ২৮-৬-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫২২১

"আমাদের ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি আর হয় না!”; গত ১০ মাসের নিষ্ফল দৌড়াদৌড়ির পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন সাবেক ডিআইজি এম আকবর আলী। শিক্ষা জীবনের ঊষালগ্ন থেকে কর্মজীবনের অন্তিম প্রহর পর্যন্ত সততা আর নিষ্ঠার এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পর, যখন আকবর সাহেবের মতো একজন সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা এমন হতাশা ব্যক্ত করেন, তখন তা কেবল একটি ব্যক্তিগত আক্ষেপ থাকে না, বরং গোটা ব্যবস্থার ওপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়। দিবা-রাত্রির কঠোর অধ্যবসায় আর বিসিএস-এর মতো কঠিন পরীক্ষায় সাফল্যের পরও যদি মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়ার ‘অপরাধে’ জেলখানায় যেতে হয়, বছরের পর বছর কারাবরণ করতে হয়, এবং তারপরও যদি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পদোন্নতি অধরাই থেকে যায়, তবে সে হতাশা কেবল ব্যক্তিসীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না।

এ যেন এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে ন্যায় ও সততার জয়গান গাওয়ার চেষ্টা, যার শেষ পরিণতি এক গভীর বেদনাবোধ আর 'ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি আর হয় না'র মতো মর্মস্পর্শী উচ্চারণ। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও, দুর্নীতিমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখার পরও, ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার পরও যদি এমন সৎ মানুষেরা বঞ্চনার শিকার হন, তবে তা নিঃসন্দেহে হৃদয় বিদীর্ণ করে। এই মন্তব্য কেবল আকবরের ব্যক্তিগত নয়, বরং হাজারো সৎ কর্মকর্তার চাপা দীর্ঘশ্বাস— এক নির্বাক প্রশ্ন, যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিরন্তর ভাবিয়ে তোলে।

কেন এমন পরিস্থিতি? ঐতিহাসিক বৈষম্যের শেকড়- "কেন? কিভাবে? এমন ধরনের প্রশ্নগুলো আসে!" তাই, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বৈষম্যের শেকড় থেকে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। পুলিশ পদোন্নতি সংক্রান্ত বিদ্যমান বিধিমালা ও আইনি কাঠামোতে জ্যেষ্ঠতা ও মেধার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও, বাস্তবে রাজনৈতিক প্রভাব এবং অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার কারণে তা বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে।

১৯৯৭ সালের পুলিশ পদোন্নতি কেলেঙ্কারি” এই ঘটনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৭১ জন কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে ৭৫০ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা প্রদান করা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার "নির্বাহী আদেশ" দ্বারা পরিচালিত এই ঘটনাটিতে, সুবিধাভোগীদের "আওয়ামী লীগের সূর্যসন্তান" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। যা ছিল, রাজনৈতিক প্রভাবে সরকারি চাকরির পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় একটি গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার জন্মলগ্ন।

বাংলাদেশ পুলিশে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও জ্যেষ্ঠতা সংক্রান্ত সমস্যাগুলো কেবল প্রশাসনিক জটিলতা নয়, বরং সুশাসন, মেধাভিত্তিক প্রশাসন এবং ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতির প্রতি একটি গভীর চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই বৈষম্য পুলিশ বাহিনীর মনোবল, পেশাদারিত্ব এবং সামগ্রিকভাবে জনপ্রশাসনের প্রতি জনআস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। এমনকি, বর্তমান ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) বাহারুল আলমের মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলেও নিয়মিত পদোন্নতি পাননি, যা পুরো ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

দ্বৈত নীতি এবং বর্তমান পরিস্থিতি- সাম্প্রতিক সময়ে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত জাকির খান কমিটি অন্যান্য ক্যাডারের, বিশেষত প্রশাসন ক্যাডারের, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের জন্য ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ কার্যকর করেছে। ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, গ্রেড-১ এবং সচিব পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি এবং আর্থিক সুবিধা প্রদানের কথা রয়েছে। তবে, মূল সমস্যা হলো পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতি একই ধরনের বিবেচনা বা দ্রুত পদক্ষেপের অভাব। এই দ্বৈত নীতি আন্তঃক্যাডার বৈষম্য এবং পদোন্নতি প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের একটি পুনরাবৃত্তিমূলক প্রবণতাকে তুলে ধরে।

জনপ্রশাসন সচিবের পক্ষ থেকে বারবার "এক সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে যাবে" এমন আশ্বাস গত দশ মাস ধরে বাস্তবায়িত হয়নি। এটি কেবল আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতাই নয়, বরং প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে বিদ্যমান জটিল ও অদম্য বাধা বা প্রকৃত প্রতিশ্রুতির অভাবকেও ইঙ্গিত করে। জাকির খান কমিটি 'বঞ্চিত' কর্মকর্তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য গঠিত হলেও, এর প্রাথমিক সুপারিশগুলো মূলত প্রশাসন ক্যাডারকে সুবিধা দিয়েছে, যা পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রথম ধাপের প্রতিকার থেকে বাদ দিয়েছে। এর ফলে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা মনে করছেন যে, পেশাগত দক্ষতা বা নিয়ম মেনে চলার চেয়ে রাজনৈতিক সংযোগই কর্মজীবনে উন্নতির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সমাধানের পথ: একটি বহুমুখী কৌশল
এই গভীর সংকটের সমাধানে একটি বহুমুখী কৌশল অবলম্বন করা অপরিহার্য।

১. প্রশাসনিক ও আইনি প্রতিকার জোরদারকরণ:
●ক্ষতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সরকারের অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা উচিত। এতে তাদের বঞ্চনার বিস্তারিত চিত্র এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির তথ্য নথিভুক্ত থাকবে, যা ভবিষ্যতে আইনি লড়াইয়ে সহায়ক হবে।

আইনি লড়াই: প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল এবং হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়েরের মাধ্যমে আইনি প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে। "জ্যেষ্ঠতা একটি অর্পিত অধিকার" এবং কনিষ্ঠদের পদোন্নতি দেওয়া সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সুযোগের সমতার নীতির লঙ্ঘন এই প্রতিষ্ঠিত আইনি নজিরগুলোর ওপর ভিত্তি করে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

২. গণমাধ্যম ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন: গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ অত্যন্ত জরুরি। প্রতিবেদনে সৎ কর্মকর্তাদের দুর্দশা, তাদের দীর্ঘদিনের নিবেদিত সেবা এবং অবিচারের মানসিক ও পেশাগত প্রভাব তুলে ধরতে হবে। ১৯৯৭ সালের ব্যাচ পদোন্নতি বিতর্কের মতো ঐতিহাসিক নজিরগুলোর সাথে বর্তমান অভিযোগগুলোকে যুক্ত করে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক অবিচারের চিত্র তুলে ধরতে হবে।

বিশেষজ্ঞ মতামত: স্বাধীন আইনি বিশেষজ্ঞ, জনপ্রশাসন বিশ্লেষক এবং সম্মানিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মন্তব্য গ্রহণ করে সমস্যার পদ্ধতিগত প্রভাব সম্পর্কে একটি বৃহত্তর, উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা প্রয়োজন। গণমাধ্যমের ব্যাপক কভারেজ জনমত গঠনে এবং কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করতে পারে।

৩. পদ্ধতিগত সংস্কার ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান:
স্বচ্ছ পদোন্নতি নীতি: পুলিশসহ সকল সরকারি ক্যাডারের জন্য একটি স্পষ্ট, উদ্দেশ্যমূলক এবং স্বচ্ছ পদোন্নতি নীতি তৈরি ও বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। এটি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে এবং মেধা ও জ্যেষ্ঠতার প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলো কঠোরভাবে মেনে চলবে।
স্বাধীন পর্যালোচনা ব্যবস্থা: পদোন্নতি সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যালোচনা করার জন্য একটি স্থায়ী, স্বাধীন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা বা বিদ্যমান সংস্থাগুলোর (যেমন, বিপিএসসি, এসএসবি) নিরপেক্ষতা ও কর্তৃত্বকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পর্যালোচনা: সকল সরকারি সেবার উচ্চপদস্থ পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য কঠোর নির্দেশিকা প্রণয়ন করা উচিত। এই নির্দেশিকাগুলো নিশ্চিত করবে যে এই ধরনের নিয়োগ নিয়মিত কর্মজীবনের অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে না বা পদোন্নতির সিঁড়িতে বাধা সৃষ্টি করবে না।
আইনের শাসন শক্তিশালীকরণ: প্রশাসনে আইন, বিধিমালা এবং সাংবিধানিক নীতিগুলো মেনে চলার একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি গড়ে তোলা অপরিহার্য। নির্বাহী আদেশ যাতে স্বেচ্ছাচারীভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিষেবা বিধিগুলো অতিক্রম না করে তা নিশ্চিত করা এবং যেকোনো বিচ্যুতির জন্য জবাবদিহিতা ব্যবস্থা স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান কেবল ব্যক্তিগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই নয়, বরং একটি শক্তিশালী, পেশাদার এবং জনআস্থামূলক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত এই সমস্যার মূল কারণ, অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্বচ্ছতার অভাবকে চিহ্নিত করে দ্রুত ও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একটি ব্যাপক এবং সমতাপূর্ণ সমাধানের এখনই সময়, যা নিশ্চিত করবে যে উৎসর্গীকরণ এবং সৎ সেবা ধারাবাহিকভাবে স্বীকৃত হয়!