নারী কর্মকর্তাদের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের বিষয়টি বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর অংশ। যদিও নারীরা বর্তমানে বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন, কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ ও জনমতের বিষয় সামনে এসেছে, যা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিশেষ করে ওসি, ইউএনও, জেলা পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক, ডিআইজি রেঞ্জ ও বিভাগীয় কমিশনারের মতো জনসম্পৃক্ত পদগুলোতে কাজের চাপে নারীরা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন, তা নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা দরকার।
যোগাযোগ ও নাগরিক সেবা
# জনমতের ভিত্তিতে জানা যায়, সংকট বা বিপদের সময়ে সাধারণ জনগণ নারী কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে সংকোচবোধ করেন।
# সন্ধ্যার পর বা রাতে জরুরি প্রয়োজনে অনেক নারী কর্মকর্তা ফোন ধরেন না বলে অভিযোগ রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে পারে।
কর্মঘণ্টা ও শারীরিক পরিশ্রম
# পুলিশ প্রশাসন, ম্যাজিস্ট্রেসি, জেলা প্রশাসনের মতো পদের দায়িত্বে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়।
# অনেক ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের জন্য রাতজাগা, মাঠপর্যায়ে দীর্ঘসময় কাজ করা, ও অভিযানে অংশ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
সাধারণ মানুষের মানসিকতা ও সামাজিক বাস্তবতা
# বাংলাদেশে এখনো নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে অনেকের মধ্যে দ্বিধা ও সংকোচ রয়েছে, যা প্রশাসনের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
# বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় পুরুষ নাগরিকরা নারী কর্মকর্তাদের সামনে তাদের সমস্যাগুলো উন্মুক্তভাবে বলতে চান না।
প্রস্তাবিত নীতিমালা ও সংস্কার প্রস্তাব
✅ ১. প্রশাসনিক পদায়নে দক্ষতা ও মানসিকতার মূল্যায়ন
# নারীদের জন্য ওসি, ইউএনও, জেলা প্রশাসক, এসপি, ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনারের মতো পদের ক্ষেত্রে প্রার্থীর দক্ষতা, মানসিক দৃঢ়তা ও কাজের চাপ সহ্য করার সামর্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
# শুধুমাত্র নারী কোটা বা লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে নয়, বরং ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও মানসিক প্রস্তুতির ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে।
✅ ২. বিকল্প দায়িত্ব ও সমন্বিত পদায়ন পদ্ধতি
# গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নির্ধারণে বিশেষ বিবেচনার সুযোগ রাখা উচিত।
# মাঠপর্যায়ের উচ্চ চাপযুক্ত দায়িত্বে নারীদের সরাসরি পদায়নের পরিবর্তে, প্রশাসনিক পরিকল্পনা, নীতি নির্ধারণ, উন্নয়ন প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বা অন্যান্য বিভাগীয় দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
✅ ৩. জরুরি সেবায় নারীদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও বিকল্প সমাধান
# জরুরি প্রয়োজনে নারী কর্মকর্তাদের নাগরিকদের সাথে ২৪/৭ যোগাযোগ নিশ্চিত করতে আলাদা হেল্পলাইন বা বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
#রাতে দায়িত্ব পালনের জন্য নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
# নারী কর্মকর্তা রাতে দায়িত্ব পালন করতে অপারগ হলে, বিকল্প হিসেবে পুরুষ সহকারী কর্মকর্তা বা উপ-প্রশাসকদের দায়িত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
✅ ৪. প্রশাসনিক কাজের সময় ও কর্মপরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা
# প্রশাসনিক কাজের সময় পুনর্নির্ধারণ করা যেতে পারে, যাতে নারীরা কাজের চাপ সামলাতে পারেন এবং জরুরি প্রয়োজনে জনগণের সাথে সংযোগ রাখতে পারেন।
#নারীদের ক্ষেত্রে ‘রোটেশনাল শিফট’ চালু করা যেতে পারে, যাতে তারা ব্যালান্স বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
✅ ৫. প্রশাসনে যৌক্তিক লিঙ্গভিত্তিক ভারসাম্য নিশ্চিত করা
# প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে নারী ও পুরুষ কর্মকর্তাদের যৌক্তিক ভারসাম্য রেখে দায়িত্ব বণ্টন করা দরকার।
# যেখানে জনসেবা বা জনসম্পৃক্ততা বেশি প্রয়োজন, সেখানে পুরুষ কর্মকর্তাদের বেশি রাখার বিষয়ে পরিকল্পনা করা যেতে পারে।
✅ ৬. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন নীতিমালা প্রণয়ন
# জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচিত নারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন একটি নির্দেশিকা তৈরি করা, যাতে নারীদের সক্ষমতা, চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
# নারী কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও করণীয় নির্ধারণ করা যেতে পারে, যাতে তারা রাতের সেবা প্রদানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে দক্ষ হন।
নারী ক্ষমতায়ন এবং প্রশাসনের আধুনিকীকরণ উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তবতার আলোকে, জনসেবার মান উন্নত করতে নারী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে নারীদের সহযোগিতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে, তারা আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। তাই, প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টনের নীতিমালার সংস্কার জরুরি এবং এটি সময়ের দাবিও বটে