অনিন্দ্য আড্ডা গল্প

বাউলগানে দেহ-প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা

ড. ভাস্কর সেন গুপ্ত

প্রকাশ : ১০-৭-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫১৩৬

বাংলার লোকসাহিত্যের এক অনন্য ধারার নাম বাউলগান। এ গান কেবলমাত্র সুর ও কথার মাধুর্যে আবিষ্ট করে না, বরং এক গভীর আধ্যাত্মিক ভাবনা ও মানবতাবাদী দর্শনের দিকে আমাদের টেনে নিয়ে যায়। বাউলগানে প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা- এই দুইটি বিষয় একাকার হয়ে আছে। এখানে প্রেম কেবল লৌকিক বা শরীরী প্রেম নয়; বরং তা রূপান্তরিত হয় এক মহৎ আধ্যাত্মিক অন্বেষায় বাউল শব্দটি এসেছে  ‘সংস্কৃত "বাতুল" বা "ব্যাকুল" থেকে , যার অর্থ—উন্মাদ, ভাববিলাসী, বা ঈশ্বর-বিহ্বল ব্যক্তি। এনিয়ে অনেকেই অনেক ধরনের মতামত প্রকাশ করেছেন।

সেই বিষয়ে বিস্তর বর্ণনায় না যাই। বাউল মানে এই উন্মাদনা নিছক পাগলামি নয়; এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক উন্মাদনা, যা আসে আত্মোপলব্ধি, সাঁই-সাধনা ও মানবপ্রেমের গভীর অনুরাগ থেকে। বাউল হলো সেই সাধক, যে কোনো জাত-ধর্ম-সংপ্রদায়ের সীমানা অতিক্রম করে নিজ দেহেই ঈশ্বরের সন্ধান করে। বাউলদের মতে, "জগতে মানুষই পরম ব্রহ্মের রূপ", আর সেই মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই ঘটে ঈশ্বরের উপলব্ধি। বাউল গান সেই সাধকের আত্মিক অভিজ্ঞতা, ভাবনা ও প্রেমভাবের সংগীতরূপ। এটি কেবলমাত্র গান নয়- এটি এক আধ্যাত্মিক দর্শন, এক অভ্যন্তরীণ দেহতত্ত্বমূলক অন্বেষা, আর এক অনুপম মানবতাবাদী চেতনা। বাউল গানে ঈশ্বর বা সাঁইকে খোঁজা হয় নিজ দেহ, মন ও প্রেম-এর মাধ্যমে, বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নয়। তারা বলে:

“ঘরে বাইরে যত খুঁজিস ভাই,
অন্তরে রইলো সে সাঁই।”

এই গান একাধারে সংগীত, দার্শনিক উচ্চারণ, আত্মদর্শন, এবং এক প্রকার দেহ-মনের সংহতির উপাসনা। এখানে 'দেহ' কোনো পাপ নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক উপাসনালয়, যেখানে পঞ্চতত্ত্ব, চক্র, নাড়ি ও কুণ্ডলিনীর ভাষায় প্রকাশ পায় অন্তর্গত সত্য।বাউলদের সমাজচ্যুত ‘পাগল’ মনে করা হলেও, প্রকৃত অর্থে তারা এক গভীর জ্ঞানসাধনার পথিক। তাদের গানেই আমরা পাই মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর সহজ, অথচ প্রজ্ঞাসম্পন্ন উত্তর—কে আমি? কোথা থেকে এলাম? কোথায় যাবে আমার প্রাণ? তাই বাউল ও তার গান শুধু বাংলার লোকসংস্কৃতির গর্ব নয়, বরং বিশ্ব-আধ্যাত্মিকতার এক ঐশ্বর্যময় উপহার।

বাউলগানে প্রেমকে দেখা হয় এক পরম সত্যের প্রতীক হিসেবে। বাউলের প্রেম সাধারণ প্রেম নয়, এটি আত্মিক প্রেম—"মনুষ্যরূপী পরম ব্রহ্মের" প্রতি আকুলতা। এই প্রেমের পথেই বাউল পৌঁছাতে চায় তার অন্তর্নিহিত ‘মানুষ ঠাকুর’-এর নিকট, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন 'জীবন দেবতা'। যেমন লালন ফকির গেয়েছেন:

“আমি ওহে লালন বলি,
প্রেম বিনে নয় ভজন ফলি।”

এই প্রেম ব্যক্তিগত আবেগকে ছাড়িয়ে এক সর্বজনীন মানবপ্রেমে রূপ নেয়। বাউলের প্রেমে কোনো জাত-ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, সম্প্রদায়ের গণ্ডি নেই। এই প্রেমেই নিহিত রয়েছে মুক্তির পথ।
আধ্যাত্মিকতা ও আত্মসন্ধান
বাউলগানের মূল দর্শন আত্মসন্ধান ও দেহতত্ত্বনির্ভর আধ্যাত্মিকতা। বাউলরা মনে করে, ঈশ্বর বা ‘সাঁই’ বাহিরে নয়, মানুষরূপে ভিতরেই অবস্থান করছেন। তাই তারা বলে:

“আপন মনে পায় রে, আপন ঠাকুর
দেখবি যদি মন চোখ মেলে।”

আধ্যাত্মিকতার এই যাত্রা শুরু হয় নিজেকে জানো এই চেতনাবোধ থেকে। ঈশ্বরের সন্ধানে তারা বাহিরে না গিয়ে নিজের শরীর ও মনকে বিশ্লেষণ করে, তাকে শুদ্ধ করে তবেই সেই নিরাকার সাঁইয়ের সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে।

মিলন ও বিরহ: প্রেম-আধ্যাত্মিকতার মিলনস্থল-
বাউলগানে প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে একটি অনন্য সেতুবন্ধন হলো মিলন ও বিরহ। এই দুটি অনুভব একইসঙ্গে দেহ ও আত্মার কথকতা। মিলন মানে ঈশ্বরপ্রাপ্তি, আর বিরহ মানে তাঁর অভাববোধ। এই বিরহ-ভাষ্য এক গভীর অন্তর্দাহ, যা প্রেমের আকাঙ্ক্ষাকে তীব্রতর করে তোলে। লালন গেয়েছেন:

“কি সুখে কি দুখে ভাই,
মনেতে সাঁই ধরা থাকে।”

বাউলগানে প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা কেবল ধর্মীয় বা ভাববাদী বিষয় নয়, বরং এক রকম মানবিক জীবনদর্শন। এখানে প্রেম মানে নিজেকে জানার পথ, আর আধ্যাত্মিকতা মানে সেই জ্ঞানকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা। তাই বাউলগান শুধু সংগীত নয়, এটি মানবমন ও ঈশ্বরের মধ্যে এক আত্মিক সেতু—যেখানে প্রেমই পথ, আর আধ্যাত্মিকতা তার গন্তব্য।

বাউল দর্শনে দেহতত্ত্ব—
বাউল দর্শন ও গানে ‘দেহতত্ত্ব’ একটি গভীর ও রহস্যময় ধারণা, যা আধ্যাত্মিক চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে। বাউলদের মতে, মানুষের শরীর কেবল বস্তুগত কাঠামো নয়, বরং এক পরম সত্য, চেতনা ও সাঁইয়ের (ঈশ্বরের) আবাসস্থল। তাই দেহকে তুচ্ছ বা মোহময় বলে উপেক্ষা করা নয়, বরং দেহের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের উপলব্ধি সম্ভব—এটাই বাউলদের বিশ্বাস।

১. দেহই সাধনার ক্ষেত্র
বাউলদের মতে, দেহ হলো এক আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্র। এই দেহে রয়েছে ৯ দরজা, ৭৮ হাজার নাड़ी, এবং ১৪টি প্রধান তত্ত্ব, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে পরম সাঁইয়ের আসন। লালন ফকির বলেছিলেন:

“এই দেহের মধ্যেই সাঁই,
বাহিরে খোঁজা বৃথা যায়।”
এখানে তিনি দেহকে মন্দির হিসেবে কল্পনা করেছেন, যার ভিতরেই বাস করেন পরমসত্তা।

২. যোগতত্ত্ব ও কুণ্ডলিনী
বাউল সাধনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যোগতত্ত্ব ও কুণ্ডলিনী জাগরণ। বাউলরা বিশ্বাস করেন, দেহের নিচের অংশে ‘কুণ্ডলিনী’ নামে এক শক্তি শয়ান অবস্থায় রয়েছে। সাধনা ও প্রেমযোগের মাধ্যমে এই শক্তি ক্রমে ঊর্ধ্বগামী হয়ে শরীরের বিভিন্ন চক্র বা কেন্দ্রে প্রবাহিত হয়, এবং অবশেষে চূড়ান্ত চক্রে পৌঁছে ‘সাঁই’-এর সঙ্গে মিলন ঘটে।

৩. দেহতত্ত্বে নারী-পুরুষের সংহতি
বাউল দর্শনে নারী-পুরুষ সম্পর্ককে কেবল যৌনতা নয়, বরং এক গূঢ় আধ্যাত্মিক মিলন হিসেবে দেখা হয়। বাউলদের মতে, পুরুষের দেহে রয়েছে নারী, আর নারীর দেহে পুরুষ। এই দেহগত দ্বৈততা ও সংহতি থেকেই জন্ম নেয় পূর্ণতা। এই ধারণা ‘সাহজিয়া দর্শন’-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
“নারী ভজে যে জন,

সাঁই পায় সে মন।”
— লালন
এখানে নারী হচ্ছে রূপক; আত্মিক প্রেমের মাধ্যমে দেহকে উপাসনার মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

৪. দেহতত্ত্ব ও সাধনার স্তর
বাউল সাধনায় দেহতত্ত্বের বিভিন্ন স্তর রয়েছে:
• কায় সাধনা – দেহ ও নাড়ি শুদ্ধ করার চর্চা
• মনের সাধনা – ভেতরের কামনা-বাসনা দমন করে হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করা
• শব্দ সাধনা – দেহের ভিতরের অনাহত শব্দ শুনে আত্মোপলব্ধি
• রস সাধনা – দেহের রসকে নিয়ন্ত্রণ করে আত্মিক শক্তিকে জাগানো
এই সাধনাগুলো বাউলগানে রূপ নিয়েছে দার্শনিক কবিতার মতো ভাষায়।

৫. দেহতত্ত্বের চূড়ান্ত লক্ষ্য: আত্মসাক্ষাৎ
বাউলরা দেহতত্ত্বের মাধ্যমে সেই আত্মাকে চিনতে চান, যিনি শরীরের মধ্যেই বাস করছেন। বাহ্যিক রীতিনীতির প্রতি অবিশ্বাস করে তারা আত্মানুসন্ধানের এই পথ বেছে নেয়। দেহতত্ত্ব তাদের কাছে ঈশ্বরকে পাওয়ার, উপলব্ধির, আর প্রেমের পথে হাঁটার একটি সশরীর পদ্ধতি।
দেহতত্ত্ব বাউল গানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এখানে দেহকে অপবিত্র নয়, বরং পবিত্রতার আধার মনে করা হয়। দেহের ভেতরেই ঈশ্বর, প্রেম, সাধনা—সবকিছুর উৎস। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক নয়, বরং এক ধরনের দার্শনিক প্রতিবাদও, যা বহিঃআড়ম্বর, জাতপাত, বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান—সবকিছুকে প্রত্যাখ্যান করে মানুষের নিজস্ব দেহ ও চেতনাকেই উপাসনার কেন্দ্র করে তোলে।

বাউলতত্ত্ব সাধনে— 
বাউলগানে সাধারণত যেসব তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়, তা মূলত আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও মানবিক চিন্তাধারার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এই তত্ত্বগুলো বাউলদের গান, সাধনা ও জীবনদর্শনের ভিত গঠন করে। নিচে বাউলগানে ব্যবহৃত প্রধান তত্ত্বগুলো আলোচনা করা হলো:

১. দেহতত্ত্ব
বাউল দর্শনের অন্যতম মূলভিত্তি।
• বাউলের মতে, ঈশ্বর বা "সাঁই" এই দেহেই বিরাজ করেন।
• দেহের বিভিন্ন অংশ, নাড়ি, চক্র, রস, বায়ু—সব কিছুই সাধনার উপাদান।
• দেহকে পরিষ্কার ও নিয়ন্ত্রিত রেখেই আত্মোপলব্ধি সম্ভব।
উদাহরণ:
“এই দেহেতে আছে রতন, জানে না সে মূড়াখান।”
— লালন


২. মানবতত্ত্ব
বাউল দর্শনে মানুষই ধর্ম ও ঈশ্বরের মূর্ত রূপ।
• জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদ—সব বাতিল করে "মানুষ"কেই প্রধান করে তোলে।
• ঈশ্বরের সন্ধান পেতে হলে আগে মানুষকে ভালোবাসতে হবে।
উদাহরণ:
“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?”
— লালন

৩. প্রেমতত্ত্ব
প্রেম বাউলদের কাছে পরম সাধনার পথ।
• এটি শুধুমাত্র মানবিক প্রেম নয়, বরং এক আত্মিক ও ঈশ্বরলগ্ন প্রেম।
• প্রেমের মাধ্যমে সাঁই-এর মিলনই চূড়ান্ত লক্ষ্য।
উদাহরণ:
“প্রেম ছাড়া সাধন হয় না,
প্রেমই পাথেয় বাউলের।”

৪. সূফিতত্ত্ব / মনোতত্ত্ব (প্রভাব)
বাউলরা সুফি প্রভাবিত। তারা মনে করে,
• মনই ঈশ্বরের বাসস্থান।
• মনকে যদি সঠিক পথে চালিত করা যায়, তবে ঈশ্বর-সাক্ষাৎ সম্ভব।
উদাহরণ:
“মন রে, তুই আপনি আপনি ভাবস্ কেমন?”
— লালন

৫. রসতত্ত্ব
দেহের ভিতরে যে ‘রস’ প্রবাহিত হয়, তার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনাই রসতত্ত্ব।
• সাধনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এটি।
• এটি যৌনতা নয়, বরং আত্মিক শক্তির রূপান্তর।
এই তত্ত্ব সাহজিয়া ও তান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

৬. চক্রতত্ত্ব ও কুণ্ডলিনী (প্রভা প্রকৃয়া)
বাউল দর্শনে দেহে বিভিন্ন "চক্র" (energy center) ধারণা রয়েছে।
• কুণ্ডলিনী শক্তি দেহের নিচে ঘুমিয়ে থাকে।
• সাধনার মাধ্যমে এই শক্তিকে জাগিয়ে উপরদিকে নিয়ে যেতে হয়, যেখানে মিলন ঘটে।
এই তত্ত্ব যোগ সাধনার অংশ।

৭. বিরহতত্ত্ব
বিরহ বা বিচ্ছেদের বেদনা বাউলগানে এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি।
• ঈশ্বরের অভাববোধেই জন্ম নেয় বিরহ।
• এই বিরহই প্রেমকে তীব্র করে, এবং মিলনের আকাঙ্ক্ষা জাগায়।
উদাহরণ:
“আমি একদিনও না দেখিলাম তারে,
মন রে, কেমনে রাখি স্থির।”

৮. সাহজতত্ত্ব (সাহজিয়া প্রভাব)
‘সহজ পথেই ঈশ্বরলাভ’—এই দর্শন বাউলদের ভাবনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।
• জটিল আচার, তীর্থ, মন্ত্র, রীতি-নীতিকে বর্জন করে সহজ-সরল প্রেম ও মানবতার পথে ঈশ্বরপ্রাপ্তি সম্ভব।
লালনের গানে এটি প্রকট:
“সহজ মানুষ ভজে রে ভাই,
সহজ পথেই তরে।”

বাউলগানে ব্যবহৃত তত্ত্বসমূহ দেহ, মন, প্রেম, রস, বিরহ, সহজতা এবং মানবতাবাদের এক গূঢ় মিলন। এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে এবং সবকটি মিলেই গঠিত হয় এক গভীর আধ্যাত্মিক পথ, যা বাহ্যিক ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে মুক্ত, মানবিকতা ও আত্মিক প্রেমে পরিপূর্ণ।

বাউলগানে চক্রতত্ত্ব ও কুণ্ডলিনী: দেহের আধ্যাত্মিক মানচিত্র
বাউল দর্শনে দেহ কেবল একটি শারীরিক অবয়ব নয়, বরং এক পূর্ণাঙ্গ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র। এই দেহে আছে চক্র, নাড়ি, রস, বায়ু, শব্দ, এবং কুণ্ডলিনী। এই তত্ত্বগুলোর মূল উৎস যোগদর্শন, তান্ত্রিক সাধনা, এবং সাহজিয়া ভাবধারা, যার সঙ্গে বাউলগান গভীরভাবে সংযুক্ত।

চক্রতত্ত্ব: দেহের সাতটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র
বাউলদের মতে, মানবদেহে সাতটি মূল চক্র (energy centers) রয়েছে, যেগুলো শুদ্ধ সাধনার মাধ্যমে জাগ্রত হতে পারে। প্রতিটি চক্র একেকটি আধ্যাত্মিক স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে।
ক্রমচক্রের নামঅবস্থানগুণ / উদ্দেশ্য
১.মূলাধার মলদ্বারের নিচে কুণ্ডলিনীর আসন, জাগরণ শুরু
২.স্বাধিষ্ঠান যৌনাঙ্গের কাছে কাম, রস, প্রজনন শক্তি
৩.মণিপুর নাভিমূল আত্মবিশ্বাস, শক্তি
৪.অনাহত হৃদয়-প্রেম, সহানুভূতি
৫.বিশুদ্ধি গলার কাছে বাক্‌শক্তি, সত্য
৬.আজ্ঞা ভ্রূমধ্য তৃতীয় চোখ, অন্তর্দৃষ্টি
৭.সহস্রার মস্তকের শীর্ষে পরম ব্রহ্মের সঙ্গে মিলন, সিদ্ধি 

সহস্রার চক্র হলো সর্বোচ্চ চক্র, যেখানে সাধক 'সাঁই'-এর সঙ্গে মিলে যায়।
কুণ্ডলিনী শক্তি: সাঁইয়ের ঘুমন্ত জ্যোতি
কুণ্ডলিনী হচ্ছে মানবদেহে অবস্থিত এক ঘুমন্ত আধ্যাত্মিক শক্তি, যা সাধারণত মূলাধার চক্রে কুণ্ডলিত (সর্পাকৃতি) অবস্থায় থাকে। বাউল সাধকরা বিশ্বাস করেন, এই শক্তিকে প্রেম, গান, সাধনা ও দেহতত্ত্ব চর্চার মাধ্যমে জাগ্রত করতে হয়।
• কুণ্ডলিনী যখন প্রতিটি চক্র ভেদ করে উপরে উঠতে থাকে, তখন সাধক একের পর এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করে।
• সর্বশেষে সহস্রার চক্রে পৌঁছে সাধক ‘সাঁই’-এর সঙ্গে আত্মিক মিলন অনুভব করে।
এই কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করার পথেই ঘটে আত্মসিদ্ধি।
নাড়িতত্ত্ব: ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না
বাউল দর্শনে দেহের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত তিনটি মূল নাড়ি (energy channel) উল্লেখযোগ্য:

১. ইড়া (চন্দ্রনাড়ি)
• বামে অবস্থিত
• চন্দ্রের প্রকৃতি বহন করে
• ঠান্ডা, ধীর, স্তব্ধ ও মননশীল শক্তি
• দেহের বাম পাশ দিয়ে ওঠে

২. পিঙ্গলা (সূর্যনাড়ি)
• ডানে অবস্থিত
• আগুনের গুণ ধারণ করে
• উত্তেজনা, কর্ম, সাহস ও সক্রিয়তা
• দেহের ডান পাশ দিয়ে ওঠে

৩. সুষুম্না (মধ্যনাড়ি)
• মাঝখানে অবস্থিত
• কেবল তখনই সক্রিয় হয়, যখন ইড়া-পিঙ্গলা সুষম হয়
• এই পথেই কুণ্ডলিনী উঠে চক্র ভেদ করে সহস্রারে পৌঁছায়
বাউলগানে এই তিনটি নাড়ির কথা সরাসরি না বলা হলেও, দেহতত্ত্বের বর্ণনায় ইঙ্গিত স্পষ্ট।

🕉 চক্রতত্ত্ব ও বাউলগানের অভিব্যক্তি
বাউলরা সরাসরি যোগিক শব্দ ব্যবহার না করলেও গানের মধ্যে এই তত্ত্বগুলো লুকিয়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ:
“দেহেতে রহিয়াও দেহের খবর নাই,
দেহ চিনলে সাঁই চিনবি রে ভাই।”
— লালন

এখানে দেহের অভ্যন্তরীণ সংগঠন (চক্র, নাড়ি, কুণ্ডলিনী) বোঝার আহ্বান আছে। তারা মনে করে, দেহের মধ্যেই আছে মহাসত্য, এবং সাধনার মাধ্যমে দেহ-চেতনার স্তর ভেদ করেই সেই সত্যে পৌঁছাতে হয়।

বাউলগানে চক্রতত্ত্ব, কুণ্ডলিনী ও নাড়ি—এই ধারণাগুলো যুক্ত হয়ে এক অত্যন্ত গভীর দেহতাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক দর্শন তৈরি করে। এই তত্ত্বগুলো শুধু তত্ত্বগত নয়, বরং বাস্তব সাধনার পথ। প্রেম, সাধনা, বিরহ, ও গানের মাধ্যমে সাধক ধীরে ধীরে নিজের দেহচেতনা উন্মোচন করে সহস্রারে পৌঁছাতে চায়—সেখানেই তার ‘সাঁই’, সেখানেই চূড়ান্ত মুক্তি।

বাউলগানের অন্তর্নিহিত দেহতত্ত্ব, চক্রতত্ত্ব, কুণ্ডলিনী শক্তি ও নাড়িপথের ব্যাখ্যা আমাদের এক বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক ভুবনের সন্ধান দেয়। এখানে দেহ কেবল মাটির গড়া শরীর নয়; বরং এক অলৌকিক সাধনার ক্ষেত্র, এক জীবন্ত মন্দির—যার অভ্যন্তরে গোপনে বাস করছেন 'সাঁই'। বাউলরা বিশ্বাস করেন, বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান বা মন্দির-মসজিদে ঈশ্বরের সন্ধান নয়, বরং নিজ দেহের গভীরে, চক্র ভেদ করে, সুষুম্না পথে কুণ্ডলিনীর উত্থানের মাধ্যমেই চূড়ান্ত সত্যের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব। এই দর্শনে ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না, মূলাধার থেকে সহস্রার পর্যন্ত চক্রসমূহ কেবল দেহতত্ত্বের প্রযুক্ত বিষয় নয়, বরং প্রেম, বিরহ, মানবতা ও আত্মসাধনার প্রতীক। বাউলের গান তাই হয়ে ওঠে শুধুই সংগীত নয়, বরং এক গভীর দর্শনের কণ্ঠস্বর—যেখানে প্রেম হচ্ছে জাগরণের শক্তি, দেহ হচ্ছে পথ, এবং সহস্রার চক্র সেই চূড়ান্ত গন্তব্য যেখানে সাধক একাকার হয়ে যায় তার ‘সাঁই’-এর সঙ্গে।
এইভাবে, বাউলগানের দেহতত্ত্ব আমাদের শেখায় "নিজেকে জানো, তাহলেই ঈশ্বরকে পাবে"—এই চিরন্তন সত্য। এটি একটি অন্তর্মুখী জীবনবোধ, যা প্রেম, সাধনা ও আধ্যাত্মিকতার সুতীব্র আলোয় মানবজীবনকে উন্মোচিত করে।

সতর্কীকরণ: উক্ত আর্টিকেলটি লেখকের নিজস্ব চিন্তা ও মতামত। আর্টিকেল বিষয়ে কোন আলোচনা-সমালোচনার জন্য অনিন্দ্যবাংলা সম্পাদক দায়ী নয়।