অনিন্দ্য আড্ডা ইতিহাস ও ঐতিহ্য

ময়মনসিংহের ইতিকথা

মোঃ চাঁন মিয়া ফকির

প্রকাশ : ১১-৪-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫১৫৯

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে ১ মে ১৭৮৭ খিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠা করে। ঐতিহাসিক কেদারনাথ মজুমদার ময়মনসিংহের বিবরণ গ্রন্থে ১৭৮৭ খ্রি. ১ মে ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠার তারিখটি উদ্বৃত করেছেন - Board of Revenu's Letter to the collector of Belluah No - 32, Dated 24.04.1787 সূত্র থেকে। F.A sachse জেলা প্রতিষ্ঠার ১৭৮৬ খ্রি. উল্লেখ করেছেন কোন তারিখ উল্লেখ করেননি।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা দখল করে। মোঘলদের কাছ থেকে দেওয়ানী গ্রহণ করে ১৭৬৪ খ্রি.। খাজনা আদায়ের হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে। সে সময় ময়মনসিংহ জেলার আয়তন ছিল বিশাল। শ্রীহট্ট জেলার তরফ, ত্রিপুরা জেলার মেহের, সরাইল, বরদাখাত, পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ, আসামের তুরা ইত্যাদি দূরবর্তী স্থান গুলোও ময়মনসিংহের কালেক্টরের শাসনাধীন ছিল।

১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে ভেলুয়া ময়মনসিংহ থেকে নোয়াখালীর অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৯৯ খ্রিব্দাব্দে আমিরাবাদ তালুক কুমিল্লা (ত্রিপুরা) জেলাধীন হয়। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে পাতিলাদহ রঙ্গপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে সরাইল, দাউদপুর, হরিপুর, বজরা সতেরখন্দ পরগণাগুলো কুমিল্লার সাথে যুক্ত হয়।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সিরাজগঞ্জের কিছু অংশ ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র সিরাজগঞ্জ পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৬৬ সনে আবার বগুড়ার দেওয়ানগঞ্জ এবং ঢাকার আটিয়া ময়মনসিংহের অন্তর্ভক্ত হয়।

রাজস্ব আদায় সহজতর করার জন্য ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্রিটিশ প্রশাসন এই যোগ বিয়োগ করে, ফলে ময়মনসিংহ জেলা অনেক ছোট হয়ে যায়। ছোট পরিসরে রাজস্ব আদায় সহজ। শেষ পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলার আওতায় থাকল টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ এলাকা।

১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইল আলাদা জেলা, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে জামালপুর ০১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে শেরপুর জেলায় রূপান্তরিত হয়। ময়মনসিংহকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এই জেলাগুলোর এরিয়াকে আজও সাধারণ মানুষ বৃহত্তর ময়মনসিংহ বলে থাকেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ জনপদ।

রাস্তাঘাট: কালেক্টর গ্রোস সাহেবই প্রথম কয়েদিদের দ্বারা শহরের মধ্যভাগ ও নদীর পাড় ঘেসে দুটি সড়ক প্রস্তুত করেন (collectors report to the Board of revenue df. 5-11-1800)।

দোকানপাট: বহু পূর্বের আলম বাজার ১৮৭০ সালে নামকরণ করা হয়েছিল আনন্দ মোহন এভিনিউ। যা বর্তমানে বড় বাজার। বর্তমান চকবাজার, ঢাকা জিলা থেকে আগত মুসলমান ব্যবসায়ীদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল। আজ থেকে চল্লিশ বছর পূর্বেও স্বদেশী বাজারে ভাল ভাল কাপড়ের দোকান ছিল। সে সময় স্বদেশী বাজারের সাথে আমপট্টিতে মৌলভীর দোকান কাপড়ের জন্য খুবই বিখ্যাত ছিল। আজ থেকে ৪০/৪৫ বছর আগে স্টেশন রোডে মনোহারি দ্রব্যের অভিজাত দোকান ছিল। ব্যবসায়িরা হবিগঞ্জ থেকে এসে ব্যবসা পরিচালনা করে ছিল। ইংরেজদের আগমনের পূর্বে ব্যবসা বাণিজ্যে কড়ি ও দামড়ীর প্রচলন ছিল। ১৭৯৪ সালে তামার পয়সার প্রচলন হয়। ১৮০০ খ্রীস্টাব্দে কোম্পানী নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন করে।

অফিস আদালত: ১৭৭১ সালে সদর দেওয়ানী আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসকের বসতবাড়ির কাছেই বর্তমান অফিসার্স বা ময়মনসিংহ ক্লাব যেখানে, সেখানেই দফতর স্থাপিত হয়। ঐ সময় উকিলদের বসার জন্যে ঘর ছিল না। বিরাট আকার ছাতার নীচে উকিলরা নিজ নিজ মোয়াক্কেল নিয়ে বসতেন। কেশবচন্দ্র আচার্য চৌধুরী প্রমুখ প্রসিদ্ধ উকিলরা ছোট ছোট ঘর তৈরি করে তাতে তাদের কাজ চালাতেন। ১৮৮০ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারী বার এসোসিয়েশন গঠিত হয়। তখন এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৪০ জন। জেলা জজ মি.টি.এস কির্কউড (Kirkeood) এই বার এসোসিয়েশন এর প্রথম সভাপতি ছিলেন। জমিদারদের সাহায্যে ২ ফেব্রæয়ারী ১৮৮৫ তারিখে বার লাইব্রেরী গৃহের ভিত্তি স্থাপন করেন সাব জজ পার্বতী কুমার মিত্র। বর্তমান মৃত্যুঞ্জয় স্কুল যেখানে সেখানে বার লাইব্রেরী ছিল। বাবু অনাথবন্ধু গুহ স্কুলের জন্য সাত হাজার টাকায় ঐ ভবনটি ক্রয় করে নেন। ফলে মাসিক কুড়ি টাকা ভাড়ায় একটি টিনের ঘরে বার লাইব্রেরী চলতো। ১৯০১ সালে বর্তমান স্থানে বার লাইব্রেরী স্থাপন করা হয়। ১৮৮৯ সালে বার এসোসিয়েশনের প্রথম নন অফিসিয়াল সভাপতি নিযুক্ত হন কালীশংকর গুহ। ১৮৬৪ সালে যখন অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেটের পদ চালু করা হয় তখন প্রথম অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেট হন রাম গোপালপুরের কাশীকিশোর রায় চৌধুরী। কয়েদীদের জন্য কোন পৃথক জেলখানা ছিলনা কাচারী গৃহের একটি কক্ষে কয়েদীদের রাখা হতো। ১৭৯১ সালে ৬০০০ টাকা ব্যয়ে জেলখানার পাকাগৃহ নির্মিত হয়। ১৩২৬ বঙ্গাব্দে টর্ণেডোতে জেলখানার দেয়াল ভেঙ্গে গেলে নতুন করে তা নির্মাণ করা হয়। প্রশাসনের সবিধার্থে ১৮৮৭ সালে জেলবোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়।

পাঠাগার: ১৮৮৬ সালে টাউন হল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা রাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। এখানে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার স্থাপিত হয়েছিল। পাঠাগারটি করোনেশনের সময় আগুনে পুড়ে গেলে সেখানে আর পাঠাগার প্রতিষ্ঠার কোন রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বর্তমানের পাবলিক লাইব্রেরিটি ছিল বাংলাদেশ পরিষদ, এর আগে ছিল এটি পাকিস্তান কাউন্সিল। তৎকালীন অতিরিক্ত পুুলিশ সুপার জাকির হোসেনের চেষ্টায় ১৯৩১ সালে ৪১ শতাংশ নিজস্ব ভমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম ইনষ্টিটিউট। দুর্গাবাড়িতে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী যা ১৯৭১ সালে অবাঙ্গালীদের দ্বারা ধ্বংস হয়। এতে ছিল অনেক দুর্লভ মূল্যবান বই।

যোগাযোগ: ১৮৮৬ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সূর্যকান্ত আচার্য এই রেল যোগাযোগের জন্য তখন দুই লক্ষ টাকার জমি দান করেছিলেন। ১৮৯৮ সালে রেল পথ জামালপুরে সম্প্রসারিত হয়। আরো পরে চট্টগ্রাম, গৌরীপুর, জারিয়া, মোহনগঞ্জ- শাখায় রেল লাইন যুক্ত হয়। প্রথম সড়কপথ ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল, ঢাকা চালু হয়। পরে ১৯৮১ সালের ১ মে চালু হয় ময়মনসিংহ ভালুকা ঢাকা রোড। ময়মনসিংহে প্রথমাবস্থায় চলাচলের যানবাহন ছিল না পরে চালু হয় ঘোড়ার গাড়ী, ব্যক্তিগত টমটম, পালকী সদৃশ দুই ঘোড়ার গাড়ী ছিল। ঘোড়ার গাড়ীর প্রধান আড্ডা ছিল গাঙ্গিনাপাড় যেখানে এখন মসজিদ, হকার মার্কেট ও প্রবাহ বিদ্যানিকেতন রয়েছে। ১৯৩৮ সালে জনৈক ব্যক্তি দুটি রিক্সা আমদানী করলে তা দেখার জন্য ও তাতে উঠে বেড়ানোর জন্য লোকের ভীড় লেগে থাকত। বর্তমানে শহরে যানবাহনের ভীড়, ঘোড়ার গাড়ী নেই তবে শখ করে পার্ক ও সার্কিট হাউজের আশে পাশে ঘোড়ার গাড়ীতে সৌখিন লোকদের চড়তে দেখা যায়।

ডাক যোগাযোগ: জেলা স্থাপনের সাথে সাথে ডাক চালু হয়। অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ ভাগে কলিকাতা থেকে ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহে ৬ দিনে ডাক আসত। ১৭৯১ সনের ১৫ জুলাই সেহড়াতে একটি ডাকঘর স্থাপিত হয়েছিল। তখন কালেক্টর নিজেই ছিলেন পোস্টমাস্টার। মানি অর্ডার চালু হয় ১৮৮০ সালে ১৯০৭ সালে স্থাপিত হয় টেলিগ্রাফ।

সংগীত ও চিত্ত বিনোদন: আমার মানুষ গান গায়, গান বাজানায় ময়মনসিংহ পিছিয়ে ছিল না কোন সময়ই। জমিদারদের পৃষ্ঠাপোষকতায় সংগীত চর্চা চলত। ময়মনসিংহে এসে সংগীত চর্চা করেছেন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ আলাউদ্দিন খাঁ, এনায়েত খাঁ, বেলায়েত খাঁ, সালমত আলী, নজাকত আলী, মোহাম্মদ আলী, খাদিম হুসেন খাঁ, মীর কাশিম খাঁ প্রমুখ। এ শহরে প্রথম সিনেমা হল লক্ষীনারায়ন পিকচার প্যালেস পরে এর নাম হয় ছায়াবানী। আমরাবতী নাট্য মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে। এই নাট্য মন্দিরে অভিনয় করেছেন অহীন্দ্র চৌধুরী, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস প্রমুখ। শশীকান্ত আচার্য তিন লক্ষ টাকা ব্যয়ে প্যারিস থেকে একটি সংগীত সিড়ি (Music stair case) এনে শশীলজে স্থাপন করেন। এই সিড়ি বেয়ে উঠলে বিশেষ ধরনের সংগীতের সুর বেজে উঠত। গৌরীপুরের জমিদার চীনা মিস্ত্রী দিয়ে ত্রিশের দশকে নির্মাণ করলেন দ্বিতল টিন কাঠের সুরম্য গৃহ। সমগ্র বাংলায় এমন একটি দৃষ্টি নন্দন গৃহ নেই। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি যাদুঘর। নদীর পাড়ে রয়েছে জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা। বর্তমানে চিত্তবিনোদনের জন্য রয়েছে একাধিক পার্ক। সাধারণ মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য রয়েছে ৪টি সিলেমা হল।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: ময়মনসিংহ জিলা স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তখন এর নাম ছিল হার্ডিঞ্জ স্কুল (১৮৪৬ খ্রি. এর নভেম্বর)। ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সিটি স্কুল। ১৯০১ সালের ১৮ জুলাই সিটিকলেজিয়েট স্কুলে একটি কলেজ চালু হয়। ১৯০৮ সালে কলেজ অন্যত্র সরীয়ে এর নামকরণ হয় আনন্দমোহন কলেজ, ১৯৬৪ সালের ১ অক্টোবর কলেজটি সরকারী কলেজে রূপান্তরিত হয়। গোলকপুরের কুমার উপেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী ১৮৭৩ সালে আলেকজান্ডার বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তাগাছার জমিদার প্রফুল্ল আচার্য পাঁচ একর জমি দান করলে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে তার মায়ের নামে বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুল হয়। অনাথবন্ধু গুহ ১৯০১ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারী তার পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেন মৃত্যুঞ্জয় স্কুল। জগদীশ চন্দ্র গুহের প্রচেষ্টায় ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠত হয় এডওয়ার্ড ইনস্টিটিশন। ১৯০৬ সালে ময়মনসিংহ ন্যাশনাল স্কুল, ১৯৪৪ সালে মুসলিম গালর্স স্কুল, ১৯৪৩ সালে মুসলিম (পলিটেকনিক) স্কুল, ১৯২৭ সালে রাধা সুন্দরী গার্লস স্কুল স্থাপিত হয়। ১৯৪৩ সালের ২ জানুয়ারী ব্রহ্মপুত্র তীরে কুমার উপেন্দ্র বিদ্যাপীঠ। ১৯০৭ সালে মহাকালী বালিকা বিদ্যালয় (মহাকালী পাঠশালা), ১৯৪৮ সালে কায়েদে মিল্লাত হাই স্কুল স্থাপিত হয় বর্তমানে এটি ময়মনসিংহ উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬৫ সালে আখতারুজ্জামান কলেজ স্থাপিত হয় বর্তমানে এটি ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয়। ১৯৬৯ সালের ১ জুলাই আলমগীর মনসুর মিন্টু কলেজ, ১৯৭২ সালে প্রবাহ বিদ্যা নিকেতন, ১৯৭০ সালে মুকুল ফৌজ পরিচালিত মুকুল নিকেতন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ময়মনসিংহের পূর্বের নাম নাসিরাবাদের নামে একটি ছেলেদের হাই স্কুল ও একটি মেয়েদের হাই স্কুল রয়েছে। ১৯৫৯ সালে মুমিনুন্নেছা মহিলা কলেজ, ১৯৮০ সালের ১ মার্চ সরকারী কলেজে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (পুরুষ), ১৯৫২ সালে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ মহিলা স্থাপিত হয়। ১৯৬৮ সনে কলেজ অব এডুকেশন মৌলিক শিক্ষা একাডেমী আরো পরে ন্যাশনাল একাডেমী ফর প্রাইমারী এডুকেশন নামে পরিচিত হয়। ১৯৬৩ সালে পলিটেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউট, ১৯৬৭ সালে লকলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে পুলিশ লাইনে একটি হাই স্কুল স্থাপিত হয়। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯৬১ সালের ১৪ আগষ্ট পূর্বে এটি ভেটেরিনারী (১৯৫৭) কলেজ ছিল। ১২০০ একর জমিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত। ১৯৬২ সালে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং লিটন মেডিকেল স্কুলটির বিলুপ্তি ঘটে। পাকিস্থান আমলের শেষের দিকে রাবেয়া মেমোরিয়াল মডেল গার্লস স্কুলটিই ময়মনসিংহ মহিলা ক্যাডেট কলেজে রূপান্তরিত হয়। ১৮১৩ সালে রামগোপলপুরের যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তার পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাশী কিশোর টেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউট।

চিকিৎসা কেন্দ্র: ১৮৮৫ সালে প্রথম হাসপাতাল স্থাপিত হয়। গৌরীপুরের জমিদার বিশ্বেশ্বরী দেবী এই হাসপাতাল স্থাপনে সাহায্য করেছিলেন। উক্ত হাসপাতালে মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য মেকেঞ্জি আই ওয়ার্ড নামে একটি চক্ষু চিকিৎসালয়ও যুক্ত করেন। মুক্তাগাছায় বিদ্যাময়ী দেবীর অর্থ সাহায্যে মহিলা চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৫০ সালে কৃষ্টপুরে ক্যাথলিক মিশন কর্তৃক একটি হাসপাতাল চালু হয়েছিল, ১৯৬১ সালে যক্ষারোগীদের জন্য একটি টি.বি. ক্লিনিক চালু হয়েছিল। বর্তমানে মেডিকেল কলেজের সঙ্গে ৫০০ বেডের আধুনিক হাসপাতাল রয়েছে। ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে একটি সামরিক হাসপাতাল আছে। এছাড়াও পুলিশ লাইনে পুলিশ কর্মচারীদের জন্য একটি হাসপাতাল, জেলখানায় কয়েদিদের জন্য জেলে একটি হাসপাতাল রয়েছে। এদুটি হাসপাতালে তেমন কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই।

ধর্ম ও সমাজ চিত্র: হিন্দু প্রধান ময়মনসিংহের হিন্দু জমিদাররাই ছিলেন এর মালিক। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল মুসলিমরা। তবে প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল না সামাজিক দিক দিয়ে বর্ণ হিন্দুদের দৃষ্টিতে তারা ছিল চন্ডালেরও নীচ পর্যায়ের। মুসলমানরা কোন মিষ্টির দোকানে ঢুকতে পারত না। শহরে গরু জবাই করতে পারত না (শহর ময়মনসিংহের ইতিকথা- আহমদ তৌফিক চৌধুরী)। মৃতুঞ্জয় স্কুলে হিন্দু ছাত্রদের সাথে মুসলমান ছাত্ররা একই বেঞ্চে বসতে পারত না। পরবর্তীকালে কিছু মুসলমান নেতা মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে আসেন। মৌলভী হামিদ উদ্দিন ময়মনসিংহের প্রথম গ্রেজুয়েট প্রথম মুসলমান এডভোকেট, তিনি যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন। চক বাজারে মুসলমানরা প্রায় পানে দুইশত বৎসর পূর্বে এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পাকিস্থান প্রতিষ্ঠিত হওযার পর মসজিদের সম্প্রসারণ কাজ চলে যা এখনও চলমান এই বড় মসজিদের পরেই প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে জেলা স্কুলের মোড়ের মসজিদটি। শোনা যায় লাহোর জমাদার নামে কোন এক ব্যক্তি ঐখানে টিনের জুম্মাঘর স্থাপন করেছিলেন। সরকার বাড়ী মসজিদ পাটগোদাম মসজিদ, গুলকীবাড়ী ইদন নেছার মসজিদ, শহরতলী এলাকার হাজী বাড়ীর মসজিদ বেশ পুরাতন।

হিন্দু মন্দিরের মধ্যে শিব মন্দির (বড় বাজার সংলগ্ন) প্রায় দুইশত বৎসরের পুরাতন। জুবিলীঘাটের আখড়া, মহারাজা রোডের কানাই বালাই মন্দির, দুর্গাবাড়ী দশভুজার মন্দির, গাঙ্গিনারপাড়ে ব্রাহ্মমন্দির (বর্তমানে লকলেজ) সার্কিট হাউজ মাঠের পাশে নববিধান ব্রাহ্ম মন্দির উল্লেখযোগ্য। ১৮৫৪ সালে ময়মনসিংহে ব্রাহ্ম- সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮০৮ খ্রি. স্থাপিত হয়েছিল সার্কিট হাউজ সংলগ্ন এ্যাংলিকান গীর্জাঘর। The Australian Victorian Baptist Foreign Mission স্থাপিত হয়। ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে এটিই এখানকার প্রথম খৃষ্টান মিশন। ১৯৬৭ সালে Baptist Church প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যাথলিকরা আসে অনেক পরে। ১৯২৭ সালে ফাদার ফিনার কৃষ্টপুরে সাধু পেট্টিকের গির্জার ভিত্তি স্থাপন করেন।

খেলাধুলা: ময়মনসিংহের খেলাধুলার গৌরব আছে। ১৯১০ সালে পন্ডিতপাড়া এথলেটিক ক্লাব স্থাপিত হয়। তদানীস্তন জেলা জজ জে.ডি. কারগিল এর প্রথম প্রেসিডেন্ট। ১৯২৭ সালে কলিকাতার মোহনবাগান ক্লাব পন্ডিত পাড়া ক্লাবের আমন্ত্রণে খেলতে আসে। গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রাকিশোর চৌধুরী ১৯২৮ সালে ক্লাবভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯২২ সাল থেকে একটানা ১৮ বৎসর এই ক্লাব লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। এই ক্লাবের ফুটবল প্লেয়ার পাখীসেন কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে আছেন। কলিকাতা মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের অনুসরণে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব স্থাপিত হয়। শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরী কেম্ব্রিজ থেকে এল.এস.বি ডিগ্রি নিয়ে ফিরে এসে ক্রিকেট খেলার প্রচলন করেন।

সংবাদপত্র: বিজ্ঞাপনী প্রথম সংবাদ পত্র প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দে। ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রকাশিত এক কালের আরো যে সব পত্রিকা এর মধ্যে ভারত মিহির, চারুবার্তা পরে চারু মিহির, সৌরভ, পল্লীশ্রী, পল্লীসেবক, ময়মনসিংহ সমাচার, জাগরণ, চাষী, হানিফী, পল্লীবার্তা, ভাস্কর, স্বদেশ সম্পদ, হাফেজ শক্তি, পতাকা, শিক্ষা প্রচার, আর্য্যপ্রভা, বাঙ্গালী, সঞ্জীবনী, আরতি, বিশ্ব সহৃদ, ইসলাম আভা, প্রয়াস, সংগ্রামী বাংলা, উচ্চারণ, তিলোত্তমা, কালানল, শুভ্রশিখা, পাপড়ি, শাশ্বত বাংলা, জনমত শিক্ষক সহৃদ, দীনদনিয়া, যুগবাণী, ভোরের শানাই, আগামী ফসল, পয়গাম, মহুয়া, মোমেনশাহী, শ্যামলী (মহিলা পত্রিকা) Equity (প্রথম ইংরেজী পত্রিকা) ইত্যাদি।

ক্লাব ও সাহিত্য সংস্থা : ময়মনসিংহে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে বহু সাহিত্য সংগঠন ও ক্লাব। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাইফেল ক্লাব। ১৯৫৮ সালে প্রেস ক্লাব। সাহিত্য সংগঠন গুলির মধ্যে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শুক্রবাসরীর সাহিত্য সংসদ। উৎসাহী নবীন সাহিত্যিকদের নিয়ে গঠিত হয়। ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ (১৯৮০ খ্রি. ২১ মে) এর একটি প্রধান চালিত কার্যক্রম বীক্ষণ পাঠচক্র।

ঐতিহ্যবাহী এই পুরাতন ময়মনসিংহ বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অষ্টম বিভাগ, ১২ (বার) তম সিটি কর্পোরেশন। হালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপিত হয়েছে। শিক্ষা নগরী নামে খ্যাত ময়মনসিংহের নাগরিক হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করি।

তথ্যসূত্র:

* ময়মনসিংহের সাময়িকী ও সংবাদপত্র আলী আহমদ খান আইয়োব

* ময়মনসিংহের জীবন ও জীবিকা, ময়মনসিংহ জেলা দ্বিশত বার্ষিকী সারকগ্রন্থ।

* ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন, দরজি আব্দুল ওয়াহাব।

* ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ,শ্রীকেদারনাথ মজুমদার।