মাদকাসক্তির করালগ্রাসে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন বর্তমান বিশ্বসভ্যতা। মাদকের ভয়াবহ ছোবলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুবসমাজ। মাদকাসক্তিতে তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ আজ দিকভ্রান্ত ও ধ্বংসপ্রায়। আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ এই যুবসমাজ। তারা বিভিন্নভাবে মাদকে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। মাদক চোরাচালানীদের খপ্পরে পড়ে কেউ কেউ হয়ে উঠছে এদের বাহক ও গিনিপিগ। একজন তরুণের স্বপ্নভরা কৈশোরের ইতিবাচক বিশ্বাসগুলো ভাঙছে দিন–রাত। আশে পাশে অরাজকতা বৈষম্য–শোষণ দেখতে দেখতে বর্তমানে তরুণরা আস্থা হারাচ্ছে জীবনে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাস থাকছে না, আর্থিক কাঠামো এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাসেও তাদের শ্রদ্ধা নেই। হতাশায় নিমজ্জিত যুবসমাজ দিশাহীন জীবনযাপন করছে। উচ্চশিক্ষিত বেকারেরাও এই মিছিলে শামিল হচ্ছে। মাদকাসক্তির ভয়াবহতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম একটি বড় অংশ এই মাদকের ভয়াবহতায় ধ্বংস হওয়ার পথে। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। লঙ্ঘন হচ্ছে দেশে প্রচলিত আইন। অহরহ বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। তাই বর্তমানে সমাজ ও দেশের জন্য মাদকাসক্তি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকের নীল নেশা আজ তার বিশাল থাবা বিস্তার করে চলেছে এ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এ এক তীব্র নেশা। হাজার হাজার তরুণ এ নেশায় আসক্ত। এ মরণনেশা থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করা না গেলে এ হতভাগ্য জাতির পুনরুত্থানের স্বপ্ন অচিরেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য অংশ আজ এক সর্বনাশা মরণনেশার শিকার। যে তারুণ্যের ঐতিহ্য রয়েছে সংগ্রামের, প্রতিবাদের, যুদ্ধ জয়ের, আজ তারা নিঃস্ব হচ্ছে মরণনেশার করাল ছোবলে। মাদক নেশার যন্ত্রণায় ধুঁকছে শত–সহস্র তরুণ প্রাণ। ঘরে ঘরে সৃষ্টি হচ্ছে হতাশা। ভাবিত হচ্ছে সমাজ।
মাদকের ভয়াবহতা এতই বেশি যে, মাদকসেবীর আশেপাশে থাকা মানুষও মাদক সৃষ্ট অসুস্থতা থেকে বাঁচতে পারে না। অন্যের সেবন করা মাদকের ধোঁয়া যদি আপনি গ্রহণ করেন, তখন তাকে বলা হয় পেসিভ স্মোকিং। পেসিভ স্মোকিং এর ফলে শিশুদের ব্রঙ্কাইটিস, এজমা, এমনকি নিউমোনিয়াও পর্যন্ত হতে পারে। প্যাসিভ স্মোকিং বেশিরভাগ সময় সরাসরি ধূমপানের চেয়েও বেশি ক্ষতি করে। শিশু অবস্থায় পেসিভ স্মোকিং বেশি হলে বড় হয়ে তাদেরও ধূমপানের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সারা পৃথিবীতে তরুণ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো নিয়ে একটি তালিকা বানাতে গেলে মাদকাসক্তি বোধ হয় সবার উপরের দিকেই থাকবে। খারাপ জেনেও মানুষ কেন মাদক গ্রহণ করে? কেন একবার ছেড়ে দেওয়ার পরও মানুষ আবার মাদকে আসক্ত হয়ে যায়? আপনার অতি প্রিয় কেউ মাদকাসক্ত হলে কীভাবে তাকে এই মরণ ছোবল থেকে মুক্ত করবেন? এজন্য মাদক বিষয়ে আপনাকে বিস্তারিত জানতে হবে। আসলে এই মাদক কী? চলুন জেনে নিই। মাদকদ্রব্য হচ্ছে সেসব বস্তু যা গ্রহণের ফলে স্নায়ুবিক বৈকল্যসহ নেশার সৃষ্টি হয়। সুনির্দিষ্ট সময় পর পর তা সেবনের দুর্বিনীত আসক্তি অনুভূত হয় এবং কেবল সেবন দ্বারাই সে তীব্র আসক্তি (সাময়িক) দূরীভূত হয়। এর কুপ্রভাব ও ভয়াবহতা মারাত্মক। আফিম বানানো হয় পপি গাছের ফুল থেকে। একই সাথে ব্যথা কমানো আর আনন্দময় অনভূতি তৈরী করতে এই আফিম ব্যবহার করা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ সাল থেকে। উনিশ শতাব্দীতে এই আফিম থেকে আলাদা করা হয় ‘মরফিন’। পরে পরীক্ষাগারে বানানো হয় হিরোইন।
১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে ওষুধ কোম্পানিগুলো ব্যথানাশক হিসাবে এই মরফিন জাতীয় দ্রব্যের ব্যাপক প্রচলন করে। নেশা সৃষ্টিকারী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াকে লুকিয়ে এর প্রচলন করা হয়। যার ফলে এই মাদকের কবলে পড়ে হাজার হাজার মানুষ।
মস্তিষ্কের কোষে এন্ডোরফিন নামক রাসায়নিক ব্যথার অনুভূতি জাগায়। এই আফিম জাতীয় মাদক এন্ডোরফিনের রিসেপ্টরগুলোকে বন্ধ করে দেয়। সাথে মস্তিষ্ককে ডোপামিন আর এড্রেনালিন তৈরিতে সাহায্য করে। ফলে নিজের মধ্যে ভালো লাগা শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে মস্তিষ্কের কোষে আফিম জাতীয় পদার্থের প্রতি টলারেনস বাড়ে। ফলে একই অনূভুতি পেতে অনেক বেশি মাদকের প্রয়োজন হয়। জন্মায় আসক্তি। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, মাদক গ্রহণের প্রতি যে নির্ভরশীলতা ও প্রবণতা তাকেই মাদকাসক্তি বলা যায়। বর্তমানে গবেষকরা মাদকাসক্তিকে ব্রেনের ডিসওর্ডার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একটি রোগের যখন সুনির্দিষ্ট লক্ষণ থাকে না কিংবা রোগ প্রমাণের মত যথেষ্ট তথ্য থাকে না, তখন তাকে ডিসওর্ডার বলা হয়। একে ডিসওর্ডার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, কারণ মাদক মস্তিষ্কের চিন্তা প্রক্রিয়া, ডোপামিন নিঃসরণের মাধ্যমে ভালো লাগাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য পরিবর্তন ঘটায়। দীর্ঘদিন এই পরিবর্তন চলতে থাকলে মানুষের মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
বাংলাদেশে যেসব মাদকদ্রব্যের সেবন সর্বাধিক সেগুলো হলো গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, রেকটিফাইড স্পিরিট, মদ, বিয়ার, তাড়ি, পঁচুই, ঘুমের ওষুধ, প্যাথেড্রিন ইনজেকশন ইত্যাদি। এসব মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে নেশা সৃষ্টিকে মাদকাসক্তি বলা হয়। যেসব পরিবারে পারিবারিক বন্ধন শিথিল, মা–বাবা, ভাই–বোনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা কম, সেসব পরিবারের সদস্যরাই মাদকাসক হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অধিকাংশ মাদকাসক্তের গড় বয়স ১৮–৩২ বছর। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, এ সময়টিই জীবনের সোনালি সময়। এ সময়ই মানুষ পরিবার, দেশ জাতি তথা বিশ্বের জন্য বেশি শ্রম দেয়। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং চোরাচালানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক প্রসার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ। মাদকের নিষ্ঠুর ছোবলে এবং অংকুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বহু তরুণের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। মাদকদ্রব্য তরুণ সমাজের এক বিরাট অংশকে অকর্মণ্য ও অচেতন করে তুলেছে। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার অবক্ষয় ঘটাচ্ছে মূল্যবোধের। ফলে সুস্থ সামাজিক বিকাশ, সুন্দর পরিবেশ ও ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক ও জাতীয় জীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়িক স্বার্থে হেরোইন আসছে নানা পথে নানা মাধ্যমে। ব্যবহার করছে স্বপ্নভাঙা মেরুদণ্ডহীন যুবক সমাজ। মধ্যবিত্ত ও সচেতন সমাজই নেশার শিকার, এদের স্বপ্ন ও প্রাপ্তির মধ্যে আসমান জমিন তফাত। পরিণতি উর্বর মেধার অপমৃত্যু, উজ্জ্বল পরমায়ুর অবক্ষয়।
আমাদের যুবসমাজকেও মাদকের হাত থেকে রক্ষার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় ও প্রতিরোধ আন্দোলনে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এর পূর্বশর্ত হিসেবে ধূমপান ও মাদকবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থা তথা সরকারের। কেননা দেশে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা করা, অপরাধ প্রবণতা দমন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। শক্ত হাতে মাদকাসক্তির মতো অন্যতম অপরাধ দমন করতে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বের সকল দেশকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। এর উৎপাদন, বিপণন ও পাচার রোধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে সচেতন হতে হবে। তাহলে এ ব্যবস্থার উত্তোরণ অনেকাংশে সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এজন্য সকল দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সজাগ থেকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
মাদকাসক্তির ভয়াবহ পরিণাম থেকে বর্তমান সময় ও মানুষকে বাঁচাতে হলে এই ভয়াল ব্যাধির বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বেকারত্বের অভিশাপ মানুষকে মাদকাসক্ত করে। তরুণদের কর্মসংস্থান করলে তারা কর্মময় জীবনযাপন করবে। শিক্ষার যথার্থ প্রসার ঘটলে, মানুষের নৈতিক জ্ঞান অর্জিত হলে নেশাগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা কমবে। সবচেয়ে বড় কথা, মাদকাসক্তদের যেমন নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা জরুরি তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মাদকব্যবসায়ীদের আইনানুগভাবে শাস্তি দেওয়া। বাংলাদেশে কোনো মাদক ব্যবসায়ী বা চোরাকারবারীর উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে এমন তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
সরকারি মহল থেকে করে গণমাধ্যম, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সমাজকর্মী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদসহ সকল শ্রেণি মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মাদক প্রতিরোধ সম্ভব।
লেখক: অধ্যক্ষ, বোয়ালখালী হাজী মো: নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।