সকল খবর মহাবিশ্বের খবর

মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের কৃতিত্ব জীবদ্দশায় পাননি যে বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক

নিজস্ব প্রতিবেদক, অনিন্দ্যবাংলা

প্রকাশ : ২৯-১২-২০২৪ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫১২৬

দিনটি ছিল ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ সাল। যুক্তরাজ্যের সাময়িকী পত্রিকা ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ’ সেদিন প্রথম পাতায় বিরাট করে এক

সেটা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেকার দুই গুরুত্বপূর্ণ শহর মহেঞ্জোদারো আর হরপ্পা আবিষ্কারের কাহিনী। সারা বিশ্বে হৈহৈ পড়ে গেল সেই খবরে।

তার আগে পর্যন্ত কারও ধারণা ছিল না যে, ভারতেও থাকতে পারে হাজার হাজার বছরের পুরনো কোনো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ।

প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন প্রধান, প্রখ্যাত প্রত্নত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শাল। খবরের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল প্রচুর ছবি, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।

আবিষ্কারের খবর ছাপে। লেখা হয়, গ্রিসের ‘টিরিনস্’ ও ‘মাইসিনে’র মতো প্রাচীন শহর খুঁজে পাওয়া গেছে ভারতে।

তবে মার্শাল তার প্রতিবেদনে এটা উল্লেখ করেননি যে সিন্ধু সভ্যতার ওই দুই প্রাচীন শহর আবিষ্কারের কৃতিত্ব আসলে ছিল দুই ভারতীয় পুরাতত্ত্ববিদের। তাদের একজন আবার বাঙালি – নাম রাখালদাস ব্যানার্জী।

তিনি ছিলেন পুরাতত্ত্ব বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মী এবং প্রশিক্ষিত প্রত্নতত্ত্ববিদ, যিনি মহেঞ্জোদারো খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্যজন, দয়ারাম সাহানি, আবিষ্কার করেছিলেন হরপ্পা।

ভারতীয়রা স্কুলের ইতিহাস বইয়ে পড়ার সুবাদে ছোট থেকেই জানে যে রাখালদাস ব্যানার্জীই খুঁজে পেয়েছিলেন মহেঞ্জোদারো। তবে বিশ্ব সেই নামটি জানতো না অনেক বছর। রাখালদাস ব্যানার্জী তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জন মার্শালকে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের যে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন, সেটাও প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল।

সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হওয়ার একশো বছর পর মহেঞ্জোদারো নিয়ে রাখালদাস ব্যানার্জীর জমা দেওয়া মূল সরকারি রিপোর্টটি পুনর্গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি।

জন মার্শালকে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার নিয়ে রাখালদাস ব্যানার্জী যে মূল রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলেন, তার একটি কপি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক হাতে পান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ওই রিপোর্টের গুরুত্ব। সেটির ছবি তুলে রেখেছিলেন সেই অধ্যাপক। আমি সেগুলো যোগাড় করি। মূল রিপোর্টের সঙ্গে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের যেসব ছবি ছিল, তার কিছুটা নানা জায়গা থেকে খুঁজে পাই। আবার যেসব ছবি পাইনি, সেগুলি পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারো থেকে আমার সূত্রের মাধ্যমে ছবি তুলে আনিয়েছি।

রাখালদাস ব্যানার্জী বলছেন, প্রাগৈতিহাসিক স্থল হিসাবে আমার মহেঞ্জোদারো খুঁজে পাওয়াটা একটা দুর্ঘটনা। সেটা ছিল ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাস। আশপাশে বেরিয়েছিলাম চিতল হরিণ শিকার করতে। কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলে ওই জায়গায় পৌঁছে যাই। সেখানে একটা চাঁছুনি (যা দিয়ে মাটি ইত্যাদি চেঁছে তোলা হয়) খুঁজে পাই, যেটা আসলে একটা নিউমিলিটিক ফ্লিন্ট (এক ধরণের জীবাশ্ম)। একই রকম জিনিষ পাশের জেলা সুক্কুরের রোহরি থেকেও কয়েক বছর আগে খুঁজে পেয়েছিলেন ব্র্যাডফোর্ড। সেগুলো এখন কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে রাখা আছে

তিনি লিখেন, ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেট’এর সাতই নভেম্বর, ১৯২৮ সালের যে মূল সংস্করণটি কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে, সেখানে এভাবেই নিজের প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মজীবন তথা ভারতের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক আবিষ্কার নিয়ে লিখেছিলেন রাখালদাস ব্যানার্জী।

প্রথমবার মহেঞ্জোদারো যাত্রার কিছুদিন আগেই ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলের কর্তা হিসাবে পুনেতে যোগ দিয়েছেন। তার বন্ধু ও প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. সুনীতি কুমার চ্যাটার্জী তার ‘দ্রাভিডিয়ান অরিজিনস অ্যান্ড দ্য বিগিনিংস অফ ইন্ডিয়ান সিভিলাইজেশন’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে রাখালদাস ব্যানার্জী সিন্ধু নদের অববাহিকা অঞ্চলে আদতে গিয়েছিলেন আলেকজান্ডারের স্থাপন করে যাওয়া বিজয়স্তম্ভ ও শিলালিপির খোঁজে।

রাখালদাস ব্যানার্জীর ভাষ্যমতে জন মার্শাল ১৯২৪ সালের মে মাসের আগে মহেঞ্জোদারোর ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। ওই পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ারও বেশ কয়েক মাস পরে, ১৯২৫ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে জন মার্শাল প্রথম মহেঞ্জোদারোতে গিয়েছিলেন বলে লিখেছেন রাখালদাস ব্যানার্জী।

গবেষক দীপান ভট্টাচার্য বলছেন, এর অর্থ হলো লন্ডনের পত্রিকায় যেসব তথ্য ও ছবি ছাপা হয়েছিল জন মার্শালের নামে, সেগুলো আসলে রাখালদাস ব্যানার্জী এবং তার সহকর্মীদের তোলা। অথচ কোথাও তাদের কৃতিত্ব স্বীকার করা হলো না। জন মার্শাল নিজে একজন অত্যন্ত পণ্ডিত প্রত্নতত্ত্ববিদ। তার কাজের ব্যাপকতা বিশাল। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশই নেই। কিন্তু অন্য কারও আবিষ্কারের স্বীকৃতি না দেওয়াটাও তো ঠিক না।

দীপান ভট্টাচার্য আরও বলছিলেন যে লন্ডনের পত্রিকায় সেই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে রাখালদাস ব্যানার্জীর মূল রিপোর্টে নানা অসঙ্গতি রয়েছে, বিস্তারিত তথ্য নেই – এসব কথা বলেন জন মার্শাল। জন মার্শালের পর যিনি পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন, সেই হ্যারল্ড হারগ্রিভস মূল রিপোর্টটি রাখালদাসকে ফেরত পাঠান।

দীপান হারগ্রিভস চিঠিতে লিখলেন যে জন মার্শালই নাকি তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যাতে রিপোর্টটি রাখালদাসকে ফেরত পাঠানো হয়। যদি তিনি চান, সেটি প্রকাশ করতে পারেন, এমন কথাও লেখা হলো।