করোনায় জনজীবন যখন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ২০২০-এ, তখন, সেই ভয়াবহতার সময়ে অধ্যাপক শিমুল বড়ুয়ার এক টেলিফোনে মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সার্ধশতজন্মবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশিতব্য স্মারকগ্রন্থের জন্য সাহিত্যবিশারদের হাতের লেখার নমুনারূপ সংগ্রহের চেষ্টা আমাকে অভিভূত করেছিল। সকলে সমর্থ না-হলেও শিমুল বড়ুয়া এবং তাঁর বিদূষী স্ত্রী রেবা বড়ুয়া ঠিকই সফল হলেন যথাসময়ে এই স্মারকগ্রন্থ প্রকাশে। ব্যক্তিক উদ্যোগে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বপালনের বিরল উদাহরণ এটি।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কেন প্রাতিস্বিক এবং কেন তাঁকে স্মরণ করা আবশ্যক, তা সম্পাদকগণ যথাযথ গাম্ভীর্য ও সুললিত গদ্যে চমত্কারভাবেই উপস্থাপন করেছেন। সম্পাদকীয় ভাষ্য থেকেই আমরা জানি,—
‘মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩) মধ্যযুগের প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য আবিষ্কার, পাঠোদ্ধার ও সুসম্পাদনার মাধ্যমে বাংলাসাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। জীবদ্দশায় তিনি বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগচর্চার প্রবাদপুরুষে পরিণত হয়েছিলেন।...কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ছাড়াই সাহিত্যবিশারদ স্ব-উদ্যোগে মধ্যযুগের প্রায় এগারো শ পুঁথিসাহিত্য আবিষ্কার, পাঠোদ্ধার, টীকাভাষ্য লিখন ও এসবের পরিচিতিমূলক প্রায় পাঁচশো প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে বাংলাসাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায়ের উন্মোচন করেছেন তিনি।
‘...তিনি শুধু মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের রচিত পুঁথিরই সন্ধান করেননি, হিন্দু ও বৌদ্ধ কবি-সাহিত্যিকদের লিখিত পুঁথিসাহিত্যের আবিষ্কার ও সম্পাদনায়ও সমান মমত্বে উদার অসাম্প্রদায়িক মনন-চিন্তনের পরিচয় দিয়েছিলেন।...
জীবনসায়াহ্নেও তিনি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে (বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলনে) নিজেকে শামিল করেছিলেন।...’
বাংলার এই কীর্তিমান পুরুষের সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম থেকেই কেন তাঁরা (শিমুল-রেবা) যথাযথ মনীষার অধিকারী না-হয়েও এই মহতি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ বা সম্পাদনার কাজে প্রয়াসী হয়েছেন, তার একটা খুব হৃদয়গ্রাহী ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, সাহিত্যবিশারদ চট্টগ্রামের সন্তান এবং সারা জীবন চট্টগ্রামকেই আঁকড়ে থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে কোনোরকম স্মারকগ্রন্থ অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি।
প্রথমত, সে-অভাবমোচন, দ্বিতীয়ত, তিনি জাতীয় ইতিহাসের স্রষ্টা হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় ইতিহাসে তাঁর সম্মান স্থান তেমন করে নির্ধারিত নয়। সেজন্য জাতির নীতিনির্ধারকদের, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটানো এবং তিনি যে একজন ভাষাতাত্ত্বিকও ছিলেন সে-বিষয়ে অবহিতকরণ, প্রকৃত ‘নীতিবাদী বুদ্ধিজীবী’র চারিত্রগত স্বরূপ উপস্থাপন, সধর্মনিষ্ঠ হয়েও কী করে ‘সর্বমানবিকতাবাদী’, ‘অসাম্প্রদায়িক’ মানুষ হওয়া যায়—তার নিদর্শন তুলে ধরা এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নামে কিছু স্মারকচিহ্ন সৃষ্টিকরণ—যেমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা হলের নামকরণ, জন্মভূমি চট্টগ্রামে, বা তাঁর কর্মস্থল চট্টগ্রাম প্রশাসনিক ভবন প্রভৃতি যে কোনো স্থানে তাঁর নামে সড়ক, ভবন বা মিলনায়তন গড়ে তোলা কিংবা তাঁর নামে প্রতিস্থাপন করা প্রভৃতি।—এইসব দাবিদাওয়া সরকারের গোচরীভূত করার জন্যই তাঁরা সভয়ে সবিনয়ে এই কাজে হাত দিয়েছিলেন বলে গ্রন্থের ভূমিকায় জানিয়েছেন।
যৌথ সম্পাদক শিমুল বড়ুয়া ও রেবা বড়ুয়ার বিনয়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটা কথা আমার বলার ইচ্ছা দমন করা যাচ্ছে না। তা হলো, এই মহতি উদ্যোগের তাঁরাই যোগ্যতম ব্যক্তি। কারণ নীরব কবির কবিত্ব যেমন কবির স্মারক-সাক্ষী নয়, তেমনি যাঁরা কোনো কাজেরই নিদর্শন রাখতে পারেননি, তাঁদের যোগ্যতার বড়াই করার মতো কোনো বস্তুগত প্রমাণ নিদর্শনও নেই। শিমুল বড়ুয়া এবং রেবা বড়ুয়াই ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ: সার্ধশতজন্মবর্ষ স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশের সাফল্য ও সার্থকতার হাসি হাসতে পেরেছেন। তাঁদের এ-উদ্যোগকে স্বাগত অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
পুনশ্চ: জীবনগাথা ও জীবনাদর্শ, কর্ম-কীর্তি মূল্যায়ন, আপন আলোয় অবলোকন, স্মৃতিকথা—এই চার পর্বে স্মারকগ্রন্থের লেখাগুলো সন্নিবেশিত। সঙ্গে রয়েছে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নির্বাচিত লেখা, চিঠিপত্র, বংশলতিকা, জীবনপঞ্জি, সম্পাদিত ও রচিত গ্রন্থ-পরিচয় এবং তাঁর সম্পর্কিত গ্রন্থের খোঁজখবর ও আলোকচিত্র।