ওপেন মেসেজ সম্পাদকীয়

ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের মঞ্চ ভাঙা; স্মৃতি, সংস্কৃতি ও শিল্প সংকট।

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু

প্রকাশ : ৩০-৪-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০৮০

"সাহিত্য সংসদের মঞ্চ ভেঙে ফেলছে..." ; এই খবরটি যেন হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে দিল ময়মনসিংহের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষদের হৃদয়। যারা জেনেছেন, তারা হতভম্ব, যারা দেখেছেন, তারা ক্ষুব্ধ, যারা স্মরণ করেন, তারা শোকাহত। কারণ এটি কোনো সাধারণ কাঠামো ছিল না; এটি ছিল একটি জীবন্ত নিদর্শন; ময়মনসিংহের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার এক জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ।

এই মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল প্রায় তিন দশক আগে, স্বপ্নের মতো এক সময়ে। একজন সংস্কৃতিপ্রেমী স্থপতি তাঁর নিজের হাতে এর নকশা করেছিলেন, এবং সরাসরি উপস্থিত থেকে এর নির্মাণ তত্ত্বাবধান করেছিলেন। সে সময় এই মঞ্চটি ছিল তরুণ কবি, নাট্যকর্মী, সাহিত্যিকদের প্রাণকেন্দ্র ; মাঠে বসে আবৃত্তি, কবিতা পাঠ, ছোট ছোট নাট্যাংশ, সংগীতানুষ্ঠান; সব মিলিয়ে এক অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতিক্ষেত্র। পার্কের গাছপালা, প্রকৃতি আর কবিতার চেতনা মিলিয়ে এক অনিন্দ্য সমাহার।

সাম্প্রতিক যে দুঃখজনক সিদ্ধান্তে এই মঞ্চটি গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে, তাকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। একটি শহরের সৌন্দর্য বাড়াতে কিংবা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়; তবে সেটি করতে গিয়ে যদি ঐতিহ্য, স্মৃতি এবং সাংস্কৃতিক চর্চার এক নিরীহ আশ্রয়স্থল ধ্বংস হয়, সেটি নিছক ভুল নয়; তা একটি সাংস্কৃতিক অপরাধ।

প্রশ্ন জাগে; কার নির্দেশে, কোন স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত? একটি পার্কে সাংস্কৃতিক মঞ্চ থাকা কি অপরাধ? এটি কি শহরের রূপ নষ্ট করছিল? নাকি অন্য কোনো 'উন্নয়নের' পথচিহ্ন এঁকে দিতে গিয়ে এই মঞ্চকে 'বাধা' মনে হয়েছে?

ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ শুধু একটি সংগঠন নয়; এটি ছিল আন্দোলন, চেতনা, এবং নাগরিক মননের প্রতিফলন। ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে এই সংসদ এই অঞ্চলের সংস্কৃতি চর্চায় এক অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। নিয়মিত আবৃত্তি চর্চা, নাট্যপ্রশিক্ষণ, শিশুদের জন্য সাহিত্য পাঠ, আঞ্চলিক কবিতা উৎসব, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান; এসবের সূতিকাগার ছিল এই মঞ্চটি। বহু গুণীজন; সেলিনা হোসেন, হায়াৎ সাইফ, হুমায়ূন আহমেদ, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ থেকে শুরু করে সমসাময়িক অনেক নবীন-প্রতিভা এই মঞ্চকে কেন্দ্র করেই উঠে এসেছেন।

এই মঞ্চ ভেঙে ফেলা মানে একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ভেঙে ফেলা। মানে সাহিত্যের প্রাঙ্গণকে নির্বাসনে পাঠানো। যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা হয়তো বুঝতে পারেননি; ময়মনসিংহের সংস্কৃতি চর্চা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি এ অঞ্চলের পরিচয়।

আমরা প্রশাসনের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাই; এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত হোক। দোষীদের চিহ্নিত করে সাংস্কৃতিক স্থান পুনরুদ্ধারে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। মঞ্চটি পূর্বের নকশা অনুযায়ী পুনর্নির্মাণ হোক এবং এর সামনে একটি ফলকে লেখা থাকুক; "সংস্কৃতি কখনো মুছে যায় না"।

এই ভুল শুধরে নেওয়াই এখন সবচেয়ে বড় ইতিবাচক বার্তা হতে পারে; ময়মনসিংহবাসী এবং দেশের সকল সংস্কৃতিপ্রেমীর কাছে।
সংস্কৃতির শহরকে রক্ষা করুন। স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখুন। সাহিত্যের সুরক্ষায় প্রশাসন জাগ্রত হোক।

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু
সম্পাদক, অনিন্দ্যবাংলা
www.anindabangla.com