২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটনার দায়ে ১৯ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী, তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সদর দপ্তর পিলখানায় বিদ্রোহী জওয়ানদের হামলায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা ও ১৭ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।
নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনেরা ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিলের পর একই দিনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের আইনজীবী বলেন, পিলখানার ঘটনায় সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক ব্যক্তিদের যেভাবে নির্মম কায়দায় হত্যা করা হয়েছে, সম্পদ ভাঙচুরসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ (ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটি) ও জেনোসাইড বলে গণ্য হবে।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সংকটের মুখে ফেলতে ও তাদের স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করতে দুটি শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করে।
আদালতে অভিযোগটি মাত্র দাখিল করা হয়েছে। বিচারিক কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। তবু সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর কথাগুলোকে আমলে নিয়ে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের একজন গবেষক হিসেবে কিছু মতামত তুলে ধরছি।
অভিযোগে পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ ও জেনোসাইড’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে লিপিবদ্ধ আছে। গত ২৪ নভেম্বরের অধ্যাদেশে প্রকাশিত সংশোধনী অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ধারাসহ উপরিউক্ত অপরাধ দুটির সংজ্ঞাগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞাটি পড়লে কয়েকটি শর্ত লক্ষ করা যাবে। সেগুলো হলো রাজনৈতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় কারণে সংঘটিত অপরাধটিকে কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘ব্যাপক’ (ওয়াইডস্প্রেড) বা ‘পদ্ধতিগত’ (সিস্টেমেটিক) আক্রমণের অংশ হিসেবে করা কোনো অমানবিক কাজ হতে হবে [ধারা ৩ (২) (ক), ১৯৭৩ আইন]। সংজ্ঞাটি ১৯৯৮ সালের রোম সংবিধির সংশ্লিষ্ট ধারার সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। তাই আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত কিছু মামলার রায়ে ‘ব্যাপক’ ও ‘পদ্ধতিগত’ বলতে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে, তা আমাদের জানা প্রয়োজন।
যুগোস্লাভিয়ার এমনই একটি মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় বলা হয়েছে, আক্রমণের ব্যাপকতা বলতে আক্রমণের ধরন এবং যাদের আক্রমণ করা হয়েছে, তাদের সংখ্যা ‘বড় আকারের’ হতে হবে। (প্রসিকিউটর বনাম গোতভিনা ও অন্যান্য, আইসিটিওয়াই, ২০১১, প্যারা ১৭০৩) রুয়ান্ডার একটি মামলা এ বিষয়ে উল্লেখ করে, মানবতাবিরোধী অপরাধে ‘ব্যাপক’ বলতে বিস্তৃত আক্রমণ ও টার্গেটেড (লক্ষ্যবস্তু) ব্যক্তিদের সংখ্যাকে নির্দেশ করে। অন্যদিকে ‘পদ্ধতিগত’ বলতে সহিংস কাজের সংগঠিত প্রকৃতিকে বোঝায়, যা অপরিকল্পিতভাবে সংঘটন করা অসম্ভব। (প্রসিকিউটর বনাম গাটেটে, আইসিটিআর, ২০১১, প্যারা ৬৩১)
এ প্রসঙ্গে আরেকটি মামলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের উপাদান হিসেবে ব্যাপকতা, বারবার আক্রমণ, বৃহৎ আকারের পদক্ষেপ, যা সম্মিলিতভাবে একাধিক ভিকটিমের বিরুদ্ধে পরিচালনার কথা বলা হয়েছে (প্রসিকিউটর বনাম মিউসিমা, আইসিটিআর, ২০০০, প্যারা ২০৪)। এসব মামলার রায়গুলো ছাড়াও ‘ব্যাপক’ ও ‘পদ্ধতিগত’ শর্ত দুটিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালত বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। দুটি শর্তের যেকোনো একটি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন হয়েছে বলা যাবে। তাই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ‘ব্যাপক’ শর্তটি সম্পূর্ণভাবে পূরণ না হলেও ‘পদ্ধতিগত’ শর্তটি যদি পূরণ করে, তাহলেই আইসিটি আইনের অধীন এই অপরাধের বিচার করা সম্ভব।
তবে সংজ্ঞাটিতে কেবল ‘বেসামরিক জনগোষ্ঠীর’ ওপর আক্রমণের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু পিলখানা বিদ্রোহ হয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্য ও তাঁদের পরিবারের বেসামরিক সদস্যদের বিরুদ্ধে। তাই ১৯৭৩ সালের আইনের আওতায় শুধু বেসামরিক ১৭ জনের হত্যাকাণ্ডকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলা হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এবার ১৯৭৩ সালের আইনের ধারা ৩(২)(গ) অনুযায়ী ‘জেনোসাইড’-এর সংজ্ঞা অনুসারে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অপরাধটিকে বিশ্লেষণ করা যাক। ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের মতো একইভাবে এখানেও জেনোসাইডের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো জাতীয়, নৃগোষ্ঠী, জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে হত্যাকাণ্ডসহ পাঁচটি অপরাধ করলে তা জেনোসাইড হিসেবে গণ্য হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে এই আইনটিতে আগে ‘রাজনৈতিক গোষ্ঠী’ সুরক্ষিত গোষ্ঠী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা ২৪ নভেম্বরে সংশোধনীর মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার সেনাবাহিনী সদস্য ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপরের চারটি সুরক্ষিত গোষ্ঠীর কোনোটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সম্ভব কি না, তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কারণ, জেনোসাইডের সংজ্ঞা অনুযায়ী সুরক্ষিত গ্রুপগুলোর বৈশিষ্ট্য সুনির্দিষ্ট করা আছে।
বিখ্যাত ইতালিয়ান আইনবিদ অধ্যাপক আন্তনিও ক্যাসেসে তাঁর ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ল বইয়ে বলেছেন যে জাতীয় গোষ্ঠী নির্ধারিত হয় জাতীয়তা বা সাধারণ জাতীয় উৎসের ওপর ভিত্তি করে। তেমনি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নির্ধারিত হয় প্রচলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভিত্তির ওপর। জাতিগত গোষ্ঠী উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ওপর এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও উপাসনার পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় (দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৮, পৃ: ১৩৮)। এই নৈর্ব্যক্তিক (অবজেক্টিভ) ব্যাখ্যা অনুযায়ী পিলখানা হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের ওপরে উল্লেখ করা চারটি সুরক্ষা গোষ্ঠীর কোনো একটি মধ্যে করা প্রসিকিউশনের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।
অন্যদিকে, বিষয়গত (সাবজেক্টিভ) ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যারা হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দায়ে অভিযুক্ত, তারা হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের যদি উল্লেখিত চার সুরক্ষিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করে ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, তবে তারা সুরক্ষিত গোষ্ঠী হিসেবেই বিবেচিত হবে। (প্রসিকিউটর বনাম জেলিসিচ, আইসিটিওয়াই, ১৯৯৯, প্যারা ৭০) আমাদের আইসিটি ট্রাইব্যুনালে কোন ব্যাখ্যাটি গৃহীত হবে, তা নির্ভর করবে উভয় পক্ষের আইনি যুক্তিতর্কের ওপর।
এ ছাড়া অভিযোগকারীদের আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনী, সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সংকটের মুখে ফেলার উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ এ আইনের আওতায় যাদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, এমন কোনো গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে অপরাধ সংঘটিত হয়নি। সর্বোপরি, জেনোসাইড প্রমাণ করতে হলে জেনোসাইড সংঘটনের বিশেষ উদ্দেশ্য (স্পেশাল ইনটেনশন) প্রমাণ করতে হয়, যা আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা করা খুবই দুরূহ একটি বিষয়।
আইনের সংজ্ঞার এ বিশ্লেষণ ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। ভিকটিম পরিবার অনেক বছর ধরে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের কথা বলেছে। কিন্তু পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হলে তদন্তের প্রতিবেদন শুধু সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটররাই দেখতে পারবেন। এমনকি যে ভিকটিমেরা সাক্ষ্য দেবেন, তাঁরাও লিখিত রিপোর্ট দেখতে পারবেন না। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত রিপোর্ট ভীষণ গোপনীয়তার সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়। জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয় না।
এ প্রসঙ্গে ভিকটিমের সাক্ষ্য প্রদান সম্পর্কে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৩ সালের আইনটির সর্বশেষ সংশোধনীতে সাক্ষীর সুরক্ষা বিষয়ে কিছু ইতিবাচক সংযোজন রয়েছে। যেমন অধ্যাদেশের ধারা ১৯ ট্রাইব্যুনালকে সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছে। তবে ২০১০ সালের খসড়া ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’কে কার্যকারিতা দিলে সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি যথাযথভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।
১৯৭৩ সালের আইনের সংশোধনীতে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। এর ফলে আগামী দিনের বিচারপ্রক্রিয়া পূর্ববর্তী বিচারের মতোই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অধ্যাদেশের ধারা ১১ অনুযায়ী বাদী ও বিবাদীপক্ষ সংশ্লিষ্ট আইনে অভিজ্ঞ বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দিতে পারবেন।
ধারা ১০ অনুযায়ী বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরা ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। তাই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা ছাড়াও এ আইনের অধীন পিলখানা হত্যাকাণ্ড বা অন্য কোনো অপরাধের বিচারকাজে আইনগত কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে তা নিশ্চিতভাবেই সমালোচনার মুখে পড়বে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড ভয়াবহ নির্মম একটি ঘটনা। এর বিশেষ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। ঘটনাটির আগের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর মধ্যে তীব্র অসন্তুষ্টি আছে। সেই নিন্দনীয় অপরাধের বিচার যদি স্বাধীন একটি কমিশন (সরকার অবশ্য ইতিমধ্যেই একটি কমিশন গঠন করেছে) গঠন করার মাধ্যমে ও তদন্ত প্রতিবেদনের পরামর্শ সাপেক্ষে আলাদা ট্রাইব্যুনাল বা প্রচলিত ফৌজদারি আইন অনুযায়ী করা হয়, তাহলেই নিহত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে প্রকৃত ন্যায়বিচার করা হবে।
উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক, যুক্তরাজ্য