প্রবন্ধ শব্দটির প্রকৃতি প্রত্যয়গত অর্থ হল ‘প্ৰকৃষ্ট বন্ধন’। ‘প্রকৃষ্ট বন্ধন’ বলতে বোঝায় বিষয়বস্তু ও চিন্তার ধারাবাহিক বন্ধনকে। নাতিদীর্ঘ, সুবিন্যস্ত গদ্য রচনাকে প্রবন্ধ বলে। প্রবন্ধ রচনার বিষয়, ভাব, ভাষা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায় কল্পনা শক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে লেখক যে নাতিদীর্ঘ সাহিত্য রূপ সৃষ্টি করেন তাই প্রবন্ধ।
প্রবন্ধ পাঠদানের উদ্দেশ্য-
প্রবন্ধ পাঠদানের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যগুলি হল-
শিক্ষার্থীদের তথ্যবহুল কথা বলার ও লেখার দক্ষতা অর্জন করানো।
শিক্ষার্থীদের যুক্তিবাদী করে তোলা।
গঠন ক্ষমতার উন্মেষ সাধনে প্রবন্ধ একান্ত ভাবে সাহায্য করে।
শব্দ জ্ঞান ও বাক্য পদহিত পদবিন্যাস রীতি সম্বন্ধে ধারণা লাভ করানো।
সাহিত্যে বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় শাখার সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটানো প্রবন্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
প্রবন্ধ পাঠদানের মাধ্যমে নিয়মিত পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যায়।
ইতিহাসের বিভিন্ন শাখা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার জন্য প্রবন্ধ পাঠদান করা জরুরি।
প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য-
ভাষার দক্ষতার বিকাশে প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
শিক্ষার্থীদের বলার দক্ষতাকে উন্নত করে তোলে।
শিক্ষার্থীদের লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রতি আগ্ৰহ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
শিক্ষার্থীদের যুক্তিবাদী করে তুলতে সাহায্য করে।
শ্রেণিবিভাগ-
প্রবন্ধকে প্রধানত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা- ০১. তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ এবং ০২. মন্ময় বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ।
১. তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ-
যে প্রবন্ধে বিষয়বস্তুর প্রাধান্য থাকে তাকেই তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ বলে। লেখকের পান্ডিত্য, জ্ঞানের গভীরতা ইত্যাদি এখানে ভালোভাবে প্রকাশ পায়। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকেই মূলত প্রবন্ধ বলে বিবেচনা করা হয়। এই ধরণের প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে লেখকের বিচার বুদ্ধি ও চিন্তাশীলতা প্রধান।
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে তত্ত্ব ও তথ্যের লক্ষণীয় প্রাধান্য থাকবে।
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিকের ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠা ও মননের গুরুত্ব প্রাধান্য পাবে।
প্রাবন্ধিক বৈজ্ঞানিক তথা বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেবেন।
প্রবন্ধকার শিক্ষক বা পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করবেন।
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধের শ্রেণিবিভাগ-
এই প্রবন্ধের মূলত ৭টি উপভাগ রয়েছে যেগুলি হল-
বিবৃতিমূলক প্রবন্ধ
ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধ
বর্ণনামূলক প্রবন্ধ
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ
চিন্তামূলক প্রবন্ধ
তথ্যমূলক প্রবন্ধ
নীতিকথামূলক প্রবন্ধ
০২. মন্ময় বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ-
যে প্রবন্ধে বিষয় চিন্তা অপেক্ষা ব্যক্তি হৃদয়ই প্রাধান্য পায় তাকে মন্ময় বা ব্যক্তিগত বা আত্মগৌরবী প্রবন্ধ নামে অভিহিত করা হয়। লেখক ব্যক্তিগত প্রবন্ধে হাস্যরস উচ্ছ্বাসের মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এই ধরণের প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
যুক্তি ও মননশীলতার পরিবর্তে লেখকের হৃদয়াবেগেরই প্রাধান্য থাকবে।
ব্যক্তিগত প্রবন্ধ জ্ঞানের বিষয়কেও লঘু কল্পনায় রঞ্জিত করে হাস্যোচ্ছ্বলে পরিবেশন করে।
ব্যক্তিগত প্রবন্ধে বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্যকে আত্মগত ভাবরসে স্নিগ্ধ করে পাঠকের চারদিকে একটা সুন্দর শান্ত পরিমণ্ডল গড়ে তোলে।
ব্যক্তিগত প্রবন্ধে লেখক স্বাধীনভাবে আপন চিন্তাশক্তি দিয়ে মনের কথা ব্যক্ত করেন তা পাঠক চিত্তে গিয়ে কৌতুকের উদ্রেক করে।
প্রবন্ধ লেখার নিয়ম-
একটি ভালো প্রবন্ধ লেখার জন্য কী কী বিষয় মাথায় রাখতে হবে এবং কেমনভাবে গড়ে তুলবেন প্রবন্ধের দেহ, তা নিম্নে আলোচনা করা হল। প্রবন্ধকে তিনটি অংশে বিভাজন করে নেওয়া প্রয়োজন– ভূমিকা, বিষয়বস্তু এবং উপসংহার।
০১. ভূমিকা-
ভূমিকা রচনার প্রবেশপথ। প্রবন্ধ রচনার জন্য একটি প্রাসঙ্গিক ভূমিকা দিতে হয়। এতে যে বিষয়ে রচনা হবে, তার আভাস এবং সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। টপিকের সঙ্গে মিল আছে, এমন একটি আকর্ষণীয় কথা দিয়ে ভূমিকা লেখা শুরু করুন। এই অংশে এমন কিছু ইঙ্গিত দেবেন যাতে কোন বিষয় এবং বিষয়টির কোন কোন দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাইছেন সেই সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে যায়। ভূমিকা সংক্ষিপ্ত রাখার চেষ্টা করবেন।
০২. বিষয়বস্তু বা মূল বক্তব্য-
বিষয়বস্তু বা মূল বক্তব্যই হচ্ছে রচনার প্রধান অংশ। এই অংশে রচনার মূল বিষয়বস্তুর সামগ্রিক পরিচয় স্পষ্ট করতে হয়। বিষয় বা ভাবকে পরিস্ফুট করার জন্য প্রয়োজনে ছোট ছোট অনুচ্ছেদ ব্যবহার করতে পারেন। তবে লক্ষ্য রাখবেন অনুচ্ছেদগুলোর ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে।
০৩. উপসংহার-
উপসংহার ভূমিকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়বস্তু আলোচনার পর এই অংশে একটা সিদ্ধান্তে আসা হয়, আর এই সিদ্ধান্তে আসাটাকেই বলা হয় উপসংহার। এখানে আপনি বর্ণিত বিষয়ে আপনার নিজস্ব মতামত বা অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ তুলে ধরবেন। উপসংহার পড়ার পর যেন মনে হয়, এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য পূর্ণতা পেলো। মনে রাখবেন উপসংহারে কোনোরকম নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করবেন না।
এছাড়াও প্রবন্ধ লেখার জন্য যে সকল বিষয়গুলি ফলো করার চেষ্টা করবেন, সেগুলি হল-
ক. ভাষা-
প্রবন্ধ কথাটির অর্থই হলো প্রকৃষ্ট বন্ধন। তাই প্রবন্ধের ভাষা হবে সুগঠিত, তাই প্রবন্ধের ভাষা যথাসম্ভব সহজ সরল ও সাবলীল রাখার চেষ্টা করবেন।
খ. যৌক্তিকতা-
প্রবন্ধের প্রাণ হলো যুক্তি। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতকে যুক্তির দ্বারা উপস্থাপিত করতে হবে। পর পর যুক্তি সাজিয়ে প্রবন্ধকে সিদ্ধান্তের স্তরে নিয়ে যেতে হবে। যুক্তি সাজানোর জন্য তথ্যের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। তথ্য আপনার যুক্তির প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
গ. তথ্যনির্ভরতা-
তথ্য ছাড়া প্রবন্ধ কখনোই ভালো হতে পারে না। তাই আপনার সাধারণ জ্ঞান বাড়াতে হবে। আপনার সেই সাধারণ জ্ঞানকে প্রবন্ধে ব্যবহার করুন। এছাড়া সম্ভাব্য টপিকের উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুখস্থ রাখাও দরকার।
ঘ. সৃজনশীলতা-
নিজের বুদ্ধি দিয়ে ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করুন এবং সেই বিশ্লেষণকেই রচনায় তুলে ধরুন।