প্রেম, ভালোবাসা ও সম্পর্ক—এসব মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু যখন এগুলো সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সীমারেখা অতিক্রম করে, তখন তা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি ১১ বছর বয়সী একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্কের কারণে মায়ের ক্যানসার চিকিৎসা মাঝপথে রেখে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের এক করুণ উদাহরণ।
এই ঘটনা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বর্তমান সমাজের গভীর সমস্যার প্রতিচ্ছবি। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এত অল্প বয়সী একটি শিশু প্রেম ও পালানোর মতো একটি সিদ্ধান্ত নিল? এটি কি সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব, পারিবারিক নজরদারির অভাব, নাকি নৈতিক শিক্ষার ঘাটতির ফল?
প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে শিশুরা এখন অনেক আগেই প্রাপ্তবয়স্কদের মতো চিন্তা করতে শিখছে। সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ তাদের এমন কিছুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা তাদের বয়স ও মানসিক পরিপক্বতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রেম, সম্পর্ক, ও স্বাধীনতার সংজ্ঞা তারা গ্রহণ করছে সিনেমা, টিভি সিরিজ, বা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের কাছ থেকে, যেখানে বাস্তবতার চেয়ে রোমান্টিসিজম বেশি গুরুত্ব পায়।
একটি শিশু যখন পরিবারের পরিবর্তে বাইরের দুনিয়ার শেখানো আদর্শের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে, তখন সে ভুল সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। তার অভিজ্ঞতা কম, বাস্তবতা বোঝার ক্ষমতা সীমিত। তার কাছে হয়তো প্রেম মানেই সবকিছু ত্যাগ করা, যা সে নাটক, সিনেমা বা টিকটকের ভিডিওতে দেখে এসেছে। কিন্তু এই ধরনের প্রেম কি আসলেই প্রেম, নাকি শুধু একটি সাময়িক মোহ?
অপ্রাপ্তবয়স্কদের প্রেম, পালিয়ে যাওয়া বা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার আরেকটি কারণ হলো পারিবারিক সংযোগের অভাব। ব্যস্ততার কারণে বাবা-মা সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। বিশেষ করে অসুস্থতার মতো পরিস্থিতিতে যখন মা-বাবা নিজেরাই বিপর্যস্ত, তখন সন্তানদের আবেগীয় প্রয়োজন হয়তো ঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না। এই অভাব অন্য কোথাও পূরণ করার চেষ্টা থেকেই অনেক শিশু ও কিশোর ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
এই ঘটনাগুলোর পেছনে শিক্ষা ব্যবস্থারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের স্কুলগুলোতে নৈতিক শিক্ষা বা জীবনের বাস্তব দিক নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা হয় না। পাঠ্যবইয়ে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও সম্পর্কের গুরুত্ব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা থাকলেও, বাস্তব জীবনে এগুলোর প্রয়োগ কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে শিশুদের জানানো হয় না।
এই ধরনের পরিস্থিতির সমাধান খুঁজতে হলে আমাদের পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। প্রথমত, পরিবারে সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা নিজেদের সমস্যাগুলো খোলাখুলি বলতে পারে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক ও বাস্তব জীবনমুখী শিক্ষা বাড়াতে হবে, যাতে শিশুরা ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে শেখে। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং শিশুদের সঠিক তথ্য ও সুস্থ বিনোদনের দিকে ধাবিত করতে হবে।
প্রেম কখনোই খারাপ নয়, বরং এটি মানবজীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিগুলোর একটি। কিন্তু এই অনুভূতিকে যদি বয়স, বাস্তবতা ও নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালিত করা না হয়, তাহলে তা ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেম ও পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো সমাজের জন্যই বিপজ্জনক। আমাদের উচিত একে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা, যাতে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।