দেশের খ্যাতিমান বামপন্থি বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমর ইন্তেকাল করেছেন। রোববার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা। তিনি জানান, ‘অসুস্থ অবস্থায় বাসা থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বিস্তারিত তথ্য পরবর্তীতে জানানো হবে।’
বদরুদ্দীন উমর ছিলেন বাংলাদেশের বাম ধারার রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। একাধারে তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী। তার লেখালেখি এবং চিন্তাচর্চা দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
চলতি বছর সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করলেও তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনোটি গ্রহণ করিনি। এখন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ। কিন্তু তাদের দেওয়া এই পুরস্কারও গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তিন খণ্ডে), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতি’, ‘বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তর’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ’, এবং ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক’।
তার পিতা আবুল হাশিম ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও প্রগতিশীল মুসলিম লীগ নেতা। বদরুদ্দীন উমর নিজেও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও লেখালেখি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৯৬৮ সালে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে সম্পূর্ণরূপে বামপন্থি বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭০-৭১ সালে তিনি গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দলীয় মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে তিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ লেখক শিবির, কৃষক ফেডারেশন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি সমাজ পরিবর্তনের কাজে সক্রিয় ছিলেন।
তার আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “আমার জন্ম হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরে ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর, রোববার, দুপুর দুটোয়।”
প্রগাঢ় জ্ঞান, সততা ও একাগ্রতার মাধ্যমে বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি ও বিশ্লেষণে সক্রিয় ছিলেন।