ওপেন মেসেজ সম্পাদকীয়

সোয়াই ও কালামুগড়া নদীর আর্তনাদ!

ভূমিখেকোদের দৌরাত্ম্যে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী দুটি নদী

প্রকাশ : ১০-৪-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫১২৫

অনিন্দ্যবাংলা:
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাণ হলো এর নদ-নদী, খাল-বিল, যা বদ্বীপের ধমনীর মতো ছড়িয়ে আছে। তেমনি ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার পুটামারা ব্রিজের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া দুটি ঐতিহ্যবাহী নদী; সোয়াই ও কালামুগড়া আজ অস্তিত্বের সংকটে। হাজারো বছর ধরে খরস্রোতা ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই নদীগুলো এখন ভূমিখেকুদের লালসার শিকার হয়ে বিলীন হওয়ার পথে। স্থানীয় মানুষ ছাড়া অনেকেই এ নদীগুলোর নাম জানেন না, অথচ একসময় এগুলো ছিল এলাকার প্রধান যোগাযোগ ও পরিবেশগত ভারসাম্যের বাহক।

সোয়াই নদী কামারিয়া ইউনিয়নের চাইড়া বিল থেকে উৎপন্ন হয়ে ফতেপুর, চর হরিপুর, চর কৃষ্ণপুর, কামারিয়া, চর ফরিদপুর ও দয়ারামপুর অঞ্চলকে বেষ্টন করে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর এটি ময়মনসিংহ-নেত্রকোণা মহাসড়কের বাগমারা ব্রিজের নিচ দিয়ে বিসকা ইউনিয়নে প্রবেশ করে। নগুয়া, মেছেড়া ফুলচর, কাশিগঞ্জ বাজার, চান্দপুর স্কুল/কলেজ সংলগ্ন এলাকাগুলো পেরিয়ে নদীটি কোদালিয়া গ্রামের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়। একসময়ের খরস্রোতা সোয়াই নদী এখন কেবল নামমাত্র অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। নদীটি হত্যা করা হয়েছে বিভিন্নভাবে; কারো পুকুর তৈরি, কারো দোকান স্থাপন, আবার কোথাও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করে।

কালামুগড়া নদী কোদালিয়া ও তারাটি গ্রামের পাশ দিয়ে গড়ামারা বিল, গাঙ্গিনা বিল, বনপলাশিয়ার খইলসাজান বিল অতিক্রম করে রামপুর ইউনিয়নে প্রবাহিত হয়। সুবুলিয়াপাড়া, ইসলামপুর, বলদিয়া পাড়া গ্রাম হয়ে এটি কালিয়ান ও রাংশা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। কিন্তু বর্তমানে এই নদীর গতিপথ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, ফলে এর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।
এক সময় এই নদীগুলো ছিল প্রাণচঞ্চল। বর্ষায় নৌকায় চেপে লোকজন নাইওর যেত, বড় বড় বজরা নৌকায় বাণিজ্য চলত, পাট পরিবহন করা হতো, নদীর ঘাটগুলো ছিল গ্রামের নারীদের পানির উৎস। তরুণ-যুবকরা সাতার কাটত, নৌকাবাইচ হতো, আর নদীতে পাওয়া যেত নানা প্রজাতির মাছ। মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত হতো খুইয়া জাল, কইজাল, থাপাজাল, খড়াজাল, বরশি ইত্যাদি। বর্ষা মৌসুমে ঘরে ঘরে মাছের ডিমের পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যেত।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নদীগুলো দখল করে ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে শ্রেণি পরিবর্তন করে দখলে নিয়ে পুকুর, দোকান ও অন্যান্য স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। বাগমারা ব্রিজের পূর্ব পাশে রাজাকার রুস্তম আলী ফকিরের ছেলে ও আরও অনেকেই নদীর দুই পাশে পাড় তুলে পুকুর দিয়ে নদী ভরাট করেছেন। কাশিগঞ্জ বাজারের পাশেও অনেকে নদীর জমি দখল করে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না, কারণ ভূমিখেকুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেই হুমকি-ধমকির শিকার হতে হয়।

এই নদীগুলোর দখলদারিত্বের ফলে আশপাশের হাজারো একর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। বর্ষার সময় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, ফলে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আউশ, আমন ও বোরো ফসলের উৎপাদন কমে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশের খাদ্য সরবরাহের ওপর।

বাংলাদেশ নদী কমিশনের গেজেটভূক্ত নদীদখলদারদের দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এই নদীগুলোকে বাঁচানো সম্ভব নয়। প্রশাসন যদি এসিল্যান্ডের মাধ্যমে সিএস, আরএস, বিএস খতিয়ান যাচাই করে, নকশা মাফিক নদীর সীমানা চিহ্নিত করেন তাহলে এখানকার প্রকৃত ভূমি মালিক কে বা কারা তা সহজে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।

সোয়াই ও কালামুগড়া নদী রক্ষার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এগুলো শুধুমাত্র পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকা ও কৃষির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে, নদীগুলো যেন টিকে থাকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন, স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে সচেতন হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ নদী দখল করতে না পারে।

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু