অনিন্দ্য আড্ডা লোক বাংলা

গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলা !

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু

প্রকাশ : ৯-২-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫১১৪

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। একসময় গ্রামের শিশু ও যুবকরা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় মেতে থাকত। খোলা মাঠে দলবেঁধে খেলার মাধ্যমে তাদের শৈশব কাটত দুরন্তপনায় ভরা। কিন্তু আজ মাঠ-বিল-ঝিল হারিয়ে যাওয়া, আধুনিক সভ্যতার প্রভাব ও কালের বিবর্তনে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো মহাকালের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামীণ খেলাগুলো আমাদের আদি ক্রীড়া সংস্কৃতির অংশ ছিল, যা গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করত।

বর্তমানে গ্রামীণ খেলাগুলো বিলুপ্ত হতে হতে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। একসময় গ্রাম বাংলায় প্রচলিত ছিল হা-ডু-ডু, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বৌছি, কানামাছি, ডাংগুলি, গাদন, খো-খো, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ, ঘুড়ি ওড়ানো, মার্বেল খেলা, লাটিম খেলা, পুতুল খেলা, টোপাভাতি, এক্কাদোক্কা, ওপেনটি বায়োস্কোপ, এলাটিং বেলাটিং, গুটি খেলা, রুমাল চুরি, গোলাপ-টগর, পানিঝুপ্পা, গাইগোদানি, কানামাছি, চোর ডাকাত, লাঠিখেলা, বলীখেলা, সাতচাড়া, ষোলগুড্ডা, ইচিং বিচিং, আগডুম বাগডুম, ঝুম ঝুমা ঝুম, নোনতা বলরে, কপাল টোকা, বউরানী, ছক্কা, ব্যাঙ্গের মাথা, আইচ্চা ভাঙ্গা, এক্কাদোক্কা, কুৎ কুৎ, মইলা, রাম সাম যদু মদু, চোর ডাকাত, সাতচাড়া, থিলো এম্প্রেস, ষোলগুড্ডা, বুঝাবুঝি, বদন, লাপা লাপি, লগো লগো, ডালিম খেলা ইত্যাদি। কিন্তু আজ এই খেলাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে শুধুই গল্প। অনেকেই এসব খেলার নাম শুনে হাসে, কারণ তারা এসব খেলার সাথে পরিচিত নয়।

# কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রামীণ খেলাধুলা:

# হা-ডু-ডু (কাবাডি)

হা-ডু-ডু বা কাবাডি বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলা। এটি একটি দলগত খেলা যেখানে দুটি দল অংশ নেয়। খেলোয়াড়দের শ্বাস না নিয়ে প্রতিপক্ষের অর্ধেকে প্রবেশ করে এবং স্পর্শ করে ফিরে আসতে হয়। এটি শারীরিক ক্ষমতা, দ্রুততা এবং কৌশলের সমন্বয়।

# দাঁড়িয়াবান্ধা
দাঁড়িয়াবান্ধা একটি গ্রামীণ খেলা যেখানে দুজন প্রতিযোগী একে অপরের হাত ধরে টানাটানি করে। এটি শারীরিক শক্তি এবং ধৈর্যের খেলা।

# গোল্লাছুট
গোল্লাছুট একটি মেয়েলি খেলা। এটি সাধারণত মাটির তৈরি ছোট গোলাকার পাথর বা গুলি দিয়ে খেলা হয়। খেলোয়াড়রা একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে গুলিগুলি সংগ্রহ করে এবং পয়েন্ট অর্জন করে। এটি দক্ষতা এবং ধৈর্যের খেলা।

# বৌছি

বৌছি একটি গ্রামীণ খেলা যা সাধারণত শিশুরা খেলে। এটি একটি সরল খেলা যেখানে একটি ছোট গর্তে বল বা পাথর ফেলে স্কোর করা হয়। এটি সহজ সরল নিয়মে খেলা যায় বলে গ্রামাঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়।

# ডাংগুলি
ডাংগুলি একটি সরল কিন্তু উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। এটি সাধারণত দুটি দলে খেলা হয়। এক দল একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে (যেমন একটি কাঠের টুকরো) আঘাত করে এবং অন্য দলটি তা ফেরত আনার চেষ্টা করে। এটি গ্রামীণ শিশু ও যুবকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়।

# পুতুল খেলা

পুতুল খেলা গ্রামীণ মেয়েদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। মাটির বা কাঠের পুতুল দিয়ে তারা বিভিন্ন গৃহস্থালি কাজের অনুকরণ করে। এটি তাদের সৃজনশীলতা এবং সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

# টোপাভাতি/জুলাবাতি
টোপাভাতি বা জুলাবাতি মেয়েদের আরেকটি প্রিয় খেলা। এতে মাটির হাঁড়ি-বাসন ও পাতার ছাউনি দিয়ে খেলাঘর বানানো হয়। মেয়েরা রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়ার অভিনয় করে।

# এক্কাদোক্কা/চাড়া
এক্কাদোক্কা বা চাড়া মেয়েদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। ভাঙ্গা মাটির হাড়ি বা কলসির টুকরা দিয়ে চাড়া বানিয়ে খেলা হয়। এটি দক্ষতা ও কৌশলের খেলা।


# ওপেনটি বায়োস্কোপ
ওপেনটি বায়োস্কোপ মেয়েদের আরেকটি প্রিয় খেলা। দুটি মেয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত ধরে দরজা তৈরি করে, অন্যরা লাইন ধরে ঘুরতে থাকে এবং ছড়া আবৃত্তি করে।

# গুটি খেলা
গুটি খেলা মেয়েদের আরেকটি প্রিয় খেলা। মাটির পাঁচটি গোল টুকরা নিয়ে খেলা হয়। এটি মনোযোগ ও হাতের ক্ষিপ্রতার খেলা।

# ঘুড়ি ওড়ানো
ঘুড়ি ওড়ানো ছেলেদের একটি জনপ্রিয় খেলা। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গ্রামাঞ্চলে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম পড়ে যায়। এটি আনন্দ ও প্রতিযোগিতার খেলা।

# কানামাছি
কানামাছি একটি জনপ্রিয় খেলা যেখানে একজনের চোখ বেঁধে তাকে অন্যদের ধরতে হয়। এটি মজা ও উত্তেজনায় ভরা খেলা।

# রুমাল চুরি
রুমাল চুরি খেলায় সবাই গোল হয়ে বসে এবং একজন চোর রুমাল রেখে আসে। অন্যরা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।

# গোলাপ-টগর
গোলাপ-টগর খেলায় দুটি দল অংশ নেয়। এক দলের সদস্যরা ফুলের নাম ধরে ডাক দেয় এবং বিপক্ষ দলের সদস্যরা তা ধরার চেষ্টা করে।

# উপসংহার:
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো আমাদের সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। কিন্তু আধুনিকতার প্রভাবে এই খেলাগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্মের কাছে এই খেলাগুলোকে পৌঁছে দেওয়া এবং আমাদের ক্রীড়া ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য গ্রামীণ ক্রীড়া ফেডারেশন গঠন ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। শুধু এইভাবেই নয় আগামী প্রজন্ম আমাদের গ্রামীণ খেলাধুলার ঐতিহ্যকে জানতে ও বুঝতে পারবে।