ঢাকা | বঙ্গাব্দ
ওপেন মেসেজ মুক্তমত

ল্যান্ড পুলিশ কেন দরকার ?

  • আপলোড তারিখঃ 14-01-25 ইং |
  • নিউজটি দেখেছেনঃ 100008 জন

ল্যান্ড পুলিশ কেন দরকার ?

বাংলাদেশে ভূমি অপরাধ একটি গুরুতর সমস্যা যা দেশের অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং নাগরিকদের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। 

"ভূমি রক্ষা পুলিশ বাহিনী" গঠন করলে এই সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব। একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমি বিরোধ, জমি দখল, এবং অপরাধ প্রতিরোধ করে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা যাবে। এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। ল্যান্ড পুলিশিং বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয় একটি মতবিনিময় সভা করতে পারেন। হতে পারে আলোচনা।।


ল্যান্ড পুলিশ শব্দটি নতুন শোনালেও কিন্তু  বিভিন্ন দেশ এবং প্রেক্ষাপটে এ ধরনের পুলিশং ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন-


১. বাংলাদেশ পুলিশের ল্যান্ড ও এস্টেট বিভাগ-


বাংলাদেশে পুলিশের একটি বিভাগ রয়েছে, যা জমি ও সম্পত্তি বিষয়ক বিষয়াদি পরিচালনা করে। ল্যান্ড ও এস্টেট শাখা নামে পরিচিত এই বিভাগটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্সপেক্টর জেনারেল (AIG) ল্যান্ড ও এস্টেট এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, ড. মো. সাইফুল্লাহ বিন আনোয়ার এই দায়িত্বে রয়েছেন।

যোগাযোগের জন্য ইমেইল: aigland_estate@police.gov.bd

ফোন: ০১৩২০-০০০২৪০


২. ল্যান্ডেসপোলিজাই 

(জার্মানির রাজ্য পুলিশ)


জার্মানিতে "ল্যান্ডেসপোলিজাই" অর্থ রাজ্য পুলিশ।

প্রতিটি ফেডারেল রাজ্যের নিজস্ব পুলিশ বাহিনী রয়েছে, যা তাদের এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ প্রতিরোধ এবং তদন্ত, এবং জরুরি অবস্থার ব্যবস্থাপনার জন্য দায়িত্বশীল।

এই পুলিশ বাহিনী প্রতিটি রাজ্যের সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়।

(সূত্র: en.wikipedia.org)


৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অফ ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (BLM) আইন প্রয়োগকারী সংস্থা


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যুরো অফ ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (BLM) এর নিজস্ব আইন প্রয়োগকারী বাহিনী রয়েছে।

তারা সরকারি জমিতে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে, ভাঙচুর, লুটপাটের মতো অপরাধ তদন্ত করে এবং BLM-পরিচালিত জমিতে দর্শনার্থী ও কর্মচারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে।

(সূত্র: blm.gov)


ভূমি অপরাধ ও ভূমি রক্ষায় বিশেষায়িত পুলিশ বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রস্তাবিত পরিকল্পনা-


বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে ভূমি অপরাধ একটি জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। ভূমি দখল, দলিল জালিয়াতি, ভূমি বিরোধ, এবং সরকারি জমি বেদখলের মতো সমস্যাগুলো দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি বিশেষায়িত পুলিশ বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রজেক্ট পরিকল্পনায় একটি "ভূমি পুলিশ" বা "ল্যান্ড প্রোটেকশন ফোর্স" গঠনের প্রস্তাব এবং কার্যক্রমের বিবরণ উপস্থাপন করা হয়েছে।


ভূমি অপরাধের বর্তমান চিত্র :


ক. ভূমি দখল: সরকারি ও বেসরকারি জমি জোরপূর্বক দখল করা।


খ. জালিয়াতি: জমির দলিল, খতিয়ান বা দাগ নম্বর জাল করে অবৈধ দখল।


গ. বিরোধ: পারিবারিক এবং সামাজিক জমি সংক্রান্ত বিরোধ।


ঘ. অবৈধ স্থাপনা: সরকারি বা ব্যক্তিগত জমিতে অবৈধ নির্মাণ।


ঙ. দুর্নীতি: ভূমি অফিসে দুর্নীতি এবং অবৈধ কাজের অনুমোদন।


বাংলাদেশে ভূমি অপরাধ মোকাবিলায় একটি বিশেষায়িত পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজনীয়তাকে কয়েকটি দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যেমন-


১. বিশেষায়িত দক্ষতা: ভূমি বিষয়ক আইনি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান সহ পুলিশ বাহিনী অপরাধ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।


২. সুবিচার নিশ্চিতকরণ: জমি সংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা।


৩. সরকারি সম্পত্তি রক্ষা: বেদখলকৃত সরকারি জমি পুনরুদ্ধার করা।


৪. সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা: নাগরিকদের জমি ও সম্পত্তির অধিকার সংরক্ষণ।


৫. অপরাধ প্রতিরোধ: ভবিষ্যতের জন্য ভূমি অপরাধের প্রবণতা কমানো।


যেমন হতে পারে ল্যান্ড পুলিশ।। 


ক. বাহিনীর নাম:

ভূমি রক্ষা পুলিশ বাহিনী 


খ. কাঠামো ও বিভাগসমূহ:

এই বাহিনীকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হবে:


গ. জাতীয় সদর দপ্তর: ঢাকায় অবস্থিত। দেশের সব ভূমি-সংক্রান্ত অপরাধের মনিটরিং ও সমন্বয় করবে।


ঘ. প্রাদেশিক ইউনিট: বিভাগীয় পর্যায়ে থাকবে, যা স্থানীয় ভূমি অফিস, জেলা প্রশাসন, এবং পুলিশের সহযোগিতায় কাজ করবে।


ঙ. মাঠ পর্যায়ের দল: প্রত্যেক উপজেলায় ছোট ইউনিট থাকবে, যারা সরাসরি ভূমি বিরোধ, দখল, এবং অপরাধ মোকাবিলা করবে।


জনবল ও নিয়োগ:

ক. আইনজীবী, জরিপকারী, এবং তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি দক্ষ দল গঠন করা হবে।


খ. বাহিনীতে বিশেষ প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্য, ভূমি বিশেষজ্ঞ, এবং আইটি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হবে।


গ. প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে ভূমি আইন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, এবং বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।


প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম:


ক. ডিজিটাল ডাটাবেস: প্রতিটি জমির ডিজিটাল রেকর্ড তৈরি করা হবে।


খ. ড্রোন: জমির প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ড্রোন ব্যবহার করা হবে।


গ. জিপিএস ট্র্যাকিং: জমি পরিমাপ এবং দখল শনাক্ত করতে জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করা।


ঘ. সাইবার ইউনিট: অনলাইনে জমি জালিয়াতি বা অপরাধ চিহ্নিত করার জন্য সাইবার সিকিউরিটি টিম।


১. ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ:


ভূমি জালিয়াতি, দখল, এবং বিরোধ প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ।


সরাসরি অভিযোগ গ্রহণ এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা।


২. সরকারি জমি পুনরুদ্ধার:


সরকারি খাস জমি বা বেদখল হওয়া জমি পুনরুদ্ধারে অভিযান পরিচালনা।


অবৈধ স্থাপনা অপসারণ এবং জমি পুনরায় বরাদ্দ।


৩. ডিজিটাল সেবা:

নাগরিকদের জমি সংক্রান্ত তথ্য সহজে পেতে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।


অনলাইনে অভিযোগ গ্রহণ এবং প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের সুযোগ।


৪. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি:


ভূমি আইন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ক্যাম্পেইন।


স্থানীয় পর্যায়ে কর্মশালা আয়োজন এবং বিনামূল্যে পরামর্শ প্রদান।


৫. দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি:

জমি বিরোধের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা এবং মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি।


৬. সমন্বয়:

ভূমি অফিস, স্থানীয় প্রশাসন, এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন।


ল্যান্ড পুলিশ বাহিনীর নাগরিক সুবিধা


১. অভিযোগের সরলীকরণ:

নাগরিকরা সরাসরি "ভূমি রক্ষা পুলিশ" এর কাছে জমি সংক্রান্ত অভিযোগ জানাতে পারবে।


২. দ্রুত সেবা:

বিশেষায়িত বাহিনী দ্রুত তদন্ত এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে জমির প্রকৃত মালিকানা যাচাই সহজ হবে।


৩. সুরক্ষা:


নাগরিকদের জমি রক্ষায় আইনি সহায়তা প্রদান। অবৈধ দখল বা হুমকির ক্ষেত্রে পুলিশি সুরক্ষা।

৪. তথ্যের স্বচ্ছতা:

নাগরিকরা একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেস থেকে নিজেদের জমির তথ্য দেখতে পারবে।


জমির সব লেনদেন এবং মালিকানা পরিবর্তন অনলাইনে রেকর্ড হবে।


প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ধাপসমূহ-

প্রথম ধাপ: গবেষণা ও পরিকল্পনা: ভূমি অপরাধের বর্তমান অবস্থা নিয়ে গবেষণা।


আইনি কাঠামো গঠন এবং বাজেট নির্ধারণ।


দ্বিতীয় ধাপ: বাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণ: সদস্য নিয়োগ এবং ভূমি আইন ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ।


তৃতীয় ধাপ: প্রযুক্তি স্থাপন: জমির ডিজিটাল রেকর্ড তৈরির জন্য সিস্টেম তৈরি।


অভিযোগ গ্রহণ ও প্রসেসিংয়ের জন্য একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম স্থাপন।


চতুর্থ ধাপ:

কার্যক্রম শুরু: প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলকভাবে ২-৩টি বিভাগে কাজ শুরু। সফল হলে দেশব্যাপী বিস্তার।


বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ:

ক. দুর্নীতি: ভূমি সংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত।


খ. অর্থায়ন: বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট প্রয়োজন।

গ. সামাজিক বাধা: কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের সম্ভাবনা।


সমাধান:

ক. দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর আইন এবং স্বচ্ছতার ব্যবস্থা।

খ. সরকারি ও আন্তর্জাতিক তহবিলের মাধ্যমে অর্থায়ন।

গ. জনগণের সমর্থন পেতে প্রচারণা ও সচেতনতা কর্মসূচি।


বাংলাদেশে ভূমি অপরাধ একটি গুরুতর সমস্যা যা দেশের অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং নাগরিকদের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। "ভূমি রক্ষা পুলিশ বাহিনী" গঠন করলে এই সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব। একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমি বিরোধ, জমি দখল, এবং অপরাধ প্রতিরোধ করে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা যাবে। এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।


–মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু 

ভূমি গবেষক ও পরামর্শক

ই-মেইল : anindamintu@gmail.com