অনিন্দ্য আড্ডা গল্প

নারীর অবদান ও অদৃশ্য শ্রম

বনশ্রী মিত্র নিয়োগী

প্রকাশ : ২৩-২-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০৫৮

বহুল পরিচিত, আলোচিত ও সমালোচিত জেন্ডার শব্দটি এখন আর গল্প নয়, বাস্তবতা। চাপে পড়ে হোক, বিশ্বাস করে হোক অথবা জেন্ডার নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা উচিৎ না- এই ভেবে হোক, যেভাবেই হোক জেন্ডার এর গুঢ় অর্থ- যা একজন নারী বা পুরুষ হিসেবে আমাদের সামাজিক পরিচয় যে প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত বা সৃষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্যেও বদলে সামাজিকভাবে সৃষ্ট, সে সত্যটিকেই প্রকাশ করে, এটুকু এখন সবার কাছে স্বীকৃত।

সামাজিকভাবে অর্পিত সকল বৈশিষ্ট্য, ভূমিকা, কর্মকান্ড, দায়-দায়িত্ব প্রকাশ করে জেন্ডার। আর এভাবেই আমরা কিভাবে নারী  ও পুরুষ হিসাবে কাজ করবো সেটা ঠিক করে দেয়। প্রচলিত জেন্ডার ধারণায় নারীরা হলো দূর্বল, কোমল হৃদয়, আবেগপ্রবন, শান্ত, নম্র আর পুরুষরা সবল, কঠোর, যুক্তিবাদী, দৃঢ়চেতা, কঠিন ইত্যাদি।

এছাড়া সমাজে একজন নারী বা পুরুষের কি ভূমিকা হবে তাও নির্ধারণ করা হয়। যেমন ঃ রান্না-বান্না, সন্তান লালন-পালন, ঘরের যাবতীয় কাজ, গৃহপালিত পশু-পাখির দেখাশোনা, কৃষি কাজে সাহায্য, বাড়ীর আঙ্গিনায় শাক-সবজী চাষ, বয়োবৃদ্ধদের দেখাশোনা সবই নারীর কাজ। আর আয়-উপার্জন, বিচার-সালিশ, রাজনীতি, বাজার করা ইত্যাদি বাইরের কাজ হলো পুরুষের।

বাংলাদেশে একজন নারীর পক্ষে পুরুষের মতো স্বাধীনভাবে সামাজিক ভূমিকা পালন করা সামাজিক কারনে বাধাগ্রস্ত হয় কারণ এসব বিষয় সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত হয়। তাই সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে অর্পিত নারী পুরুষের এসব বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ ও ভূমিকা পরিবর্তিত হয়।

কিন্তু সমাজ-সংস্কৃতি ভিত্তিক আরোপিত এই প্রথা, আচার-আচরণ এবং স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন সমাজ সংস্কৃতিতে পরিবর্তনীয়। কিন্তু জেন্ডার সম্পর্ক কর্তৃক সৃষ্ট সংস্কৃতি, জাতি, ধর্ম, শ্রেণীভেদে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকম হলেও বিশ্বজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ক্ষেত্রে অভিন্ন। এগুলো হলোঃ নারী পুরুষের দৈনন্দিন কাজ, দায়-দায়িত্ব, ব্যবহৃত সময়ের ক্ষেত্রে ভিন্নতা বা অসমতা। যা মূলতঃ জেন্ডার শ্রমবিভাজনকে চিহ্নিত করে। দ্বিতীয়তঃ পুরুষের তুলনায় সম্পত্তি, অধিকার, পছন্দ, নিয়ন্ত্রণ, সিদ্ধান্তগ্রহণ, ক্ষমতার ক্ষেত্রে নারীর অধিকারহীনতা বা সুযোগের অভাব যা সমাজে নারীর অমর্যাদাজনক, অসম ও অধ:স্তন অবস্থানকে চিহ্নিত করে।

কেন নারীর গৃহকাজ অ-স্বীকৃত ও অবমূল্যায়িত
আদিমতম অবস্থা থেকে কৃষি সভ্যতার উত্তরণের সময় থেকে নারীকে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। মাতৃতন্ত্র থেকে পিতৃতন্ত্রে সমাজ রূপান্তরের ইতিহাস আমাদের অজানা না। কিন্তু তখনও নারীর গৃহশ্রমকে সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি অবদান স্বরূপ স্বীকৃতি দেয়া হতো। মাতৃপ্রধান সমাজে পারিবারিক এবং গৃহস্থালী কাজ নারীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ও নিয়ন্ত্রিত হতো। অন্য দিকে পুরুষের বন-জঙ্গল থেকে ফলমূল আহরণ ও শিকারের মত সামাজিক শ্রম হিসাবে স্বীকার করা হতো।

পরবর্তীতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের উদ্ভবের ফলে নারীর এই গৃহকাজের সামাজিক স্বীকৃতিটি প্রজনন বা পুণ:উৎপাদনমূলক  কাজ হিসাবে পরিবারের ব্যক্তিগত আওতাধীনের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ফলশ্রুতিতে পরিবারে পুরুষের প্রাধান্য দৃশ্যমান হয় এবং নারীর অবস্থান হয় অধ:স্তন ও মর্যাদাহানিকর।

নারীর মজুরীহীন গৃহকাজের অ-স্বীকৃতির পিছনে যে সকল কারন বা যৌক্তিকতা দাঁড় করানো হয়েছে তা হলো :-
* অর্থনৈতিক মানদন্ডে যে সকল কাজের বিনিময়ে মজুরী বা অর্থ উপার্জন করা যায় তাকেই শ্রম বলে অভিহিত করা হয়। সুতরাং মজুরীভিত্তিক শ্রমকে গুণগতভাবে উন্নত এবং মজুরীহীন (টহঢ়ধরফ) শ্রমকে গুরুত্বহীন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর গৃহস্থালী কাজের সাথে যুক্ত করা হয়েছে নারীকে যা মজুরীবীহিন ও সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত না। সেজন্য বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই নারীর গৃহকাজ ও শ্রম এখনো অ-স্বীকৃত ও অবমূল্যায়িত।

* অনেক সময় কাজটি কোন অবস্থানে বা পরিবেশে হচ্ছে সেটাকেও দেখা হয়। কারন গৃহকাজ মানেই পারিবারিক পরিমন্ডলে অর্থ্যাৎ ঘরের মধ্যেই হয়ে থাকে এবং তা মজুরীবিহীন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় নারী যখন নিজের ঘরে সন্তানকে লেখাপড়া শেখান সেটা শ্রম বা কাজ হিসাবে স্বীকৃত না কিন্তু ঐ একই কাজ যখন ঘরের বাইরে দেখা হয় তখন তার স্বীকৃতি পাওয়া যায় কারন এর অর্থমূল্য রয়েছে। একইকাজ ঘরের ভিতরের কারনে মূল্যহীন ও মর্যাদার আওতায় পড়ে না।

* ধান উৎপাদনের ২৩টি কাজের মধ্যে ১৭টি কাজ করে নারী। কিন্তু নারীকে ভাবা হয় কৃষিকাজে পুরুষের সহায়তাকারী। ঘরের অভ্যন্তরে হবার কারনে তা অ-স্বীকৃত ও অ-মূল্যায়িতই থেকে যায়।

* নারীর গৃহকাজের স্বীকৃতিহীনতা ও অবমূল্যায়নে অন্য আরো কারণ রয়েছে যেমন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষিতে ও গ্রহণযোগ্য শিক্ষা, দক্ষতা, সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর সুযোগ সীমিত করে রাখা হয়েছে ফলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি করে। নারী বাধ্য হয় ঘরের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। তাছাড়া পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী নারীর গৃহকাজকে নারীর স্বাভাবিক কাজ ও দায়িত্ব হিসাবে চিহ্নিত করে এবং তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার উপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। তাই নারীদের এই অবদান উপেক্ষিতই থেকে যায়, মূল্যায়ন করা হয় না।

নারীর অবদান দৃশ্যমান করা প্রয়োজন
শুধু অর্থনৈতিক মূল্য না থাকার কারনে বা মজুরীহীন হওয়ায় নারীর সারাদিনের কাজ গুরুত্বহীন বা মূল্যায়ন করা হবে না এই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন খুব জরুরী।
জাতীয় আয়, উৎপাদন, শ্রমশক্তি ইত্যাদি অর্থনৈতিক তত্ত্বে নারীর অবদান ও ভূমিকা সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের ব্যাখ্যায় সমাজে সৃষ্ট বৈষম্য ও নারীর অধ:স্তন অবস্থানকে চিরস্থায়ী রূপ দিয়েছে। পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর অর্থনীতিতে ভূমিকা ও অবদান বেড়েই চলেছে। কিন্তু বদলায়নি তার গৃহস্থালী কাজ, দায়-দায়িত্ব ও ভূমিকা, বেড়েছে কাজের বোঝা।
প্রচলিত ধারণায় পরিবারের পুরুষরাই অর্থ উপার্জনের জন্য নির্ধারিত পরিবারের ভরণ-পোষনের জন্য অর্থ উপার্জনের জন্য আর জীবন ধারনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়, বাকী সকল কাজের ভার নারীর উপর। কিন্তু শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মূল্যমান ধরা নেই বলে নারীর গৃহস্থালী কাজ স্বীকৃতিহীন ও মর্যাদাহানিকর কাজ হবে ? অথচ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও সিপিডি’র গবেষণায় দেখা গেছে ঃ-
*  একজন নারী প্রতিদিন গড়ে গৃহকাজে ৭.৭ ঘন্টা ব্যয় করে, অন্যদিকে এধরনের কাজে একজন পুরুষ গড়ে সময় ব্যয় করে  মাত্র ২.৫ ঘন্টা।
* একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২.১টি কাজ সম্পন্ন করে যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভূক্ত হয় না। পুরুসের ক্ষেত্রে এধরনের কাজের সংখ্যা ২.৭টি।
* প্রতিস্থাপন পদ্ধতি অনুযায়ী নারীদের সম্পন্ন করা জাতীয় আয়ের হিসাব অন্তর্ভূক্ত হয়না এমন কাজের প্রাক্কলিত বার্ষিক মূল্য (২০১৩-১৪ অর্থ বছরে) জিডিপি’র প্রায় ৭৬.৮% এর সমপরিমান।
* অনুরূপভাবে গ্রহণযোগ্য মূল্য পদ্ধতি (খানার বাইরে) অনুযায়ী উপরোক্ত কাজের প্রাক্কলিত বার্ষিক মূল্য (২০১৩-১৪ অর্থ বছরের) জিডিপি’র প্রায় ৮৭.২% এর সমপরিমান।
* উপরোক্ত কাজের মূল্যমান নারীদের লব্ধ মোট আয়ে (সিপিডি’র খানা জরিপ থেকে প্রাক্কলিত) ২.৫ থেকে ২.৯ গুণ।

শুধু বাংলাদেশেই না, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই পুরুষের চাইতে নারীরা অনেক বেশি কাজ (মজুরীসহ ও মজুরীবিহীন) করলেও অর্থনৈতিক প্রাপ্তিতে নারীর অংশ নাই বললেই চলে বা অনেক কম। জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান যথাযথভাবে প্রতিফলিত হলে পুরুষরাই মূলত: আয় উপার্জন করে এই ভ্রান্ত ধারণা দূর হতো।

গৃহশ্রমের মূল্যায়নের মাধ্যমে জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃতি লাভ করে জাতিসংঘ, ওখঙ প্রভৃতি বৈশ্বিক সংস্থা কর্তৃক উৎসাহিত করা হলেও বাংলাদেশে এখনও দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু গবেষণা পরিচালিত হয়েছে।

নারীর এসকল অদৃশ্য অবদানের স্বীকৃতি প্রদান হয়তো তাৎক্ষনিকভাবে নারীর জন্য দৃশ্যমান অর্থনৈতিক মূল্য বা মঙ্গল বয়ে আনতে সাহায্য করবে না কিন্তু শুধু স্বীকৃতির সুদূর প্রসারী প্রভাবটিও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা জাতীয় অর্থনীতিতে গৃহশ্রমের অন্তর্ভূক্তি নারীদের অদৃশ্য অবস্থা থেকে মুক্ত করে নারীশ্রমকে দৃশ্যমান করে তুলবে। অন্যদিকে নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন প্রচলিত জাতীয় আয় সংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে গুণগতভাবে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদানকেও তুলে ধরবে।

সর্বোপরি গৃহকাজে নিয়োজিত লক্ষ-কোটি নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দক্ষতার উন্নয়নে রাষ্ট্রকে অধিক মনোযোগী করে তুলবে এবং নারীর অধিকার ও মানবাধিকার ভোগ ও চর্চার পথ সুগম হবে।