শিশুমনের সবুজ বাগানে স্বপ্নফুল ফোটানো শিশুসাহিত্যিক খালেক বিন জয়েনউদদীন। বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্যে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে নাম। প্রিয় নাম। তিনি সারা জীবন কাঁচা-কোমল ভোরের রোদ্দুরের মতো প্রাণগুলোর কথা ভেবে লিখে গেছেন। তাদের আনন্দ জাগানো ভাবনাগুলো আপন মনে মিশিয়ে রচনা করেছেন শত শত ছড়া, কবিতা। গল্প, জীবনী। প্রবন্ধ-নিবন্ধ। ইশকুল জীবন থেকেই লেখালিখি শুরু করেন তিনি। সব মিলিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ষাটটির অধিক বই। আরো কত গুরুত্বপূর্ণ লেখা অপ্রকাশিত রয়ে গেছে, পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তার হিসেব নেই। লেখার ক্ষেত্রে তাঁর প্রিয় বিষয়গুলো হচ্ছে দেশ, প্রকৃতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেল।
প্রখ্যাত এই শিশুসাহিত্যিকের বেশির ভাগ ছড়া লোকছড়ার ধাঁচে লেখা। কিন্তু প্রত্যেকটি ছড়াই মৌলিক। ছন্দরসে টইটম্বুর। মনছোঁয়া।
তাঁর একটি ছড়া এরকম—
ধান মউ মউ গন্ধে ভরা বাংলাদেশের মাঠ
জল থই থই কচুর পাতা রূপসা নদীর ঘাট।
এই ঘাটেতে কলসি ভরে ভিন গেরামের বউ
তিতলী পাখি একলা চাখে মউরি ফুলের মউ।
(সোনার বরণ দেশ)
আরেকটি ছড়ায় লিখেছেন—
ওই বাড়িতে একটি খুকু সোনার স্বপ্ন গড়ে
এই বাড়িতে একটি খুকু খিদের সাথে লড়ে।
ওই বাড়িতে একটি খুকুর অনেক রকম শখ
এই বাড়িতে একটি খুকুর নেই যে গায়ে ফ্রক।
(ওই বাড়ি এই বাড়ি)
১৯৭৭ সালে মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর পাঠকপ্রিয় ছড়ার বই ‘ধানসুপারি পানসুপারি’। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে ১৯৮১ সালে বের হয় তাঁর অরো একটি জনপ্রিয় ছড়ার বই ‘আতাগাছে তোতাপাখি’। বংলা একাডেমি থেকে ২০২৩ সালে এসেছে ‘নির্বাচিত শিশুকিশোর রচনা’। এছাড়া, বিভিন্ন বিষয়ে লেখা তাঁর আরো কিছু পাঠকপ্রিয় গ্রন্থ হচ্ছে, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই (বাংলা একাডেমি), নলিনীকান্ত ভট্টশালী (শিশু একাডেমি), পালকি চলে গগণ তলে (পরম পাবলিশার্স), একাত্তরের অশোক (নালন্দা), আপিল চাপিল ঘন্টিমালা (জ্যোতি প্রকাশ), বকুল বনে জোছনাপরি (সাকি পাবলিশিং ক্লাব), ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি (ঝিঙেফুল), নির্বাচিত ছড়াকবিতা (সিদ্দিকীয়া পাবলিকেশন্স), মউ ঝুরঝুর পুবাল হাওয়া (সিদ্দিকীয়া পাবলিকেশন্স), বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু (বর্ণায়ন), প্রথম লেখার আনন্দ (বর্ণতরু), দুই বৈশাখীর গল্প (কালান্তর), হূদয় জুড়ে বঙ্গবন্ধু (সম্পাদনা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন), বাংলাদেশের গণহত্যা-১৯৭১ (সম্পাদনা, বর্ণায়ন), হস্তাক্ষরে শামসুর রাহমানের ছড়াকবিতা (সম্পাদনা, বর্ণায়ন), হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লেখা ‘হুমায়ুন নামা’ ইত্যাদি।
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিপথগামী সেনাদের আক্রমণে সপরিবারে নিহত হলে এর প্রতিবাদে প্রথম ‘রাখাল রাজার জন্যে’ শিরোনামে ছড়া লিখে খালেক বিন জয়েনউদদীন ব্যাপক আলোচিত হন। পরে ছড়াটি সিকানদার আবুজাফর প্রতিষ্ঠিত এবং হাসান হাফিজুর রহমান ও উদয়ন চৌধুরী (ইসমাইল মোহাম্মদ) সম্পাদিত ‘মাসিক সমকাল’-এ প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। তাঁকে বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত দুষ্প্রাপ্য তথ্যভাণ্ডার। এ বিষয়ে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে নির্ভুল তথ্য বলে দিতে পারতেন।
খ্যাতিমান এই লেখক ১৯৫৪ সালের ২৪ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার চিত্রাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং একই প্রতিষ্ঠান থেকে এম এ ডিগ্রি অর্জন শেষে ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রতিষ্ঠিত ঢাকা জাদুঘরে (বর্তমানে জাতীয় জাদুঘর) প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ সংগ্রহের লক্ষ্যে সরকার স্থাপিত ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে’ প্রকল্প পরিচালক হাসান হাফিজুর রহমান কর্তৃক নিযুক্ত হন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতারের প্রকাশনা ‘বেতার বাংলা’র সহ-সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরের বিভাগীয় সম্পাদক পদে দীর্ঘদিন সুনামের সাথে দায়িত্বপালন করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা’য় প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও সংগঠক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সঙ্গেও কাজ করেন।
শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি আয়োজিত অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার, এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।
১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ছোটদের কোমল মনে স্বপ্ন জাগানো সবার প্রিয় শিশুসাহিত্যিক, আলোকিত মানুষ খালেক বিন জয়েনউদদীন অগণিত ভক্ত, পাঠক ও স্বজনদের কাঁদিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন সুদীর্ঘকাল, তাঁর সৃষ্টির মাঝে। পাঠকদের হূদয়ে। ভালোবাসায়। এই গুণী লেখকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা