বছরখানেক পূর্বে যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল, যে আন্দোলনের ছাত্ররা নিজেদের 'মুক্তিযোদ্ধা' হিসেবে দাবি করেছিল, সেই আন্দোলনের হাত ধরে নবগঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম 'জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)'-তে সাবেক 'ফ্যাসিবাদী' সরকারের বিতর্কিত ও অযোগ্য নেতৃত্বের কথিত পুনর্বাসন গভীর উদ্বেগ ও প্রশ্ন তৈরি করেছে। বিশেষত, নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলায় এনসিপির সদ্য প্রকাশিত কমিটিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম শুভ'র মতো একজন বিতর্কিত ব্যক্তির প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি সর্বমহলে তীব্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তার বিরুদ্ধে একজন 'জুলাই যোদ্ধা'কে হুমকি দেওয়া এবং এ নিয়ে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করার ঘটনা এই বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ঢাকা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শুভ, যিনি একসময় বড় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে নিজেকে জাহির করতেন, তার বিরুদ্ধে টিসিবি কার্ড বিক্রি, তদবির, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং নেতাকর্মীদের হুমকি-ধমকির অভিযোগ রয়েছে। মোহনগঞ্জ উপজেলায় এনসিপির সমন্বয়ক কমিটিতে তার প্রধান সমন্বয়ক হওয়ার প্রমাণস্বরূপ প্রকাশিত ছবিতেও তার নাম সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি, এক 'জুলাই যোদ্ধা'কে হুমকির অভিযোগ ওঠার পর শুভ পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান জানান, যা তার ঔদ্ধত্যের প্রমাণ হিসেবেই দেখছেন অনেকে। এই ঘটনার প্রতিবাদে মুশফিকুর রহমান নামে আরেক 'জুলাই যোদ্ধা' রফিকুলের বিরুদ্ধে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলেছে।
শুধু নেত্রকোণা নয়, দেশের অন্যান্য প্রান্তেও এনসিপির কমিটি গঠন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মাদারীপুরে এনসিপির সমন্বয়ক কমিটিকে স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা 'পকেট কমিটি' আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেখানে জুলাই বিপ্লবের সাথে সম্পর্কহীন এক শিল্পপতিকে (শহীদুল ইসলাম হাওলাদার) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নীলফামারীতেও কমিটি গঠনে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে কারণ এতে সাবেক আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ন্যাপের পতিত নেতারা এবং এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর হামলাকারীরাও স্থান পেয়েছে। জয়পুরহাটে আওয়ামী লীগের জেলা সহ-সভাপতির এনসিপির ইফতার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং নওগাঁয় আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ সাবেক এক ব্যক্তির এনসিপিতে যোগদানের ঘটনাও একই ধরনের প্রবণতা নির্দেশ করে। নালিতাবাড়িতেও (শেরপুর) এনসিপি কমিটিতে সাবেক আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন নেতার অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ উঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যাদের দ্বারা নিজেদের রাজনৈতিক দল পরিচালিত হয়নি সঠিকভাবে, যারা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন এবং যাদের জনসমর্থন প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের হাতে যদি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল হিসেবে গঠিত এনসিপির মতো একটি নতুন দলের ভার অর্পণ করা হয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর সংশয় তৈরি হয়। 'এনসিপির ককপিটে আওয়ামী পাইলট' – এই উপমা এখন দেশের রাজনৈতিক মহলে ঘুরে ফিরছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান। অথচ, যদি সেই আন্দোলনের ছাতার তলায় বিতর্কিত ও পুরোনো আমলের সুবিধাভোগী রাজনীতিকদের পুনর্বাসন ঘটে, তাহলে জনগণের আস্থা হারানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই অর্জিত স্বাধীনতা কতদিন টিকবে, এবং দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে গভীর সংশয় তৈরি হয়েছে জনমনে।